আশ্রয়ন প্রকল্পের নামে পুকুর খনন তবে সেই মাটি যাচ্ছে ইট ভাটায়

মোঃ রাশেদুল ইসলাম, নাটোর প্রতিনিধি

নাটোর সদর উপজেলার হালসা ইউনিয়নের গোকুলনগর বিলে তিন ফসলি জমিতে, আশ্রয়ন প্রকল্পের নামে, পুকুর খনন করছেন উপজেলা প্রশাসন। তবে সেই মাটি যাচ্ছে ইট ভাটায়। আর জেলা প্রশাসক বলছেন, আশ্রয়ন প্রকল্পে মাটি সরবরাহে কোন অনিয়ম বা জনভোগান্তি সৃষ্টি হলে, জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে, ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

পার্শ্ববর্তী জমির মালিকরা বলছেন, পুকুর খননের কারণে তাদের জমিতে জলবদ্ধতা সৃষ্টি হবে। ফলে সময় মতন ফসল ফলাতে বিঘ্ন ঘটবে। আর পথচারীরা বলছেন, দিনেরাতে অবৈধ মাটিবাহী ট্রাক্টর চলাচলের কারণে’ একদিকে বিনষ্ট হচ্ছে সরকারি সড়ক, অপরদিকে ব্যাঘাত করছে ঘুম ও পথ চলাচলে।

 

গুগল নিউজে ফলো করুন Mohona TV গুগল নিউজে ফলো করুন Mohona TV
অবৈধ মাটিবাহী ট্রাক্টর চলাচল

জমি মালিক মো. সাত্তার আলী বলেন, ‘ফসল উৎপাদন করতে যে অর্থ ব্যয় হয়, ফসল বিক্রি করে সেই অর্থ পাওয়া যায় না। ফলে প্রতিবছরেই লোকসান গুনতে হয়। অনেকেই মৎস্য ব্যবসা করে লাভবান হয়েছেন। তাই আমি আমার জমিতে পুকুর খননকেই, লাভজনক বলে মনে করে, পুকুর খনন করছি।’

পার্শ্ববর্তী জমির মালিক মো. ইয়াকুব আলী বলেন, ‘এই বিলের ওই জমিতে পুকুর খনন করা হলে, আমার জমি আগামী বছর জলবদ্ধতায় পড়বে। আমি সময় মতন ফসল ফলাতে পারবো না। নিরুপায় হয়ে আমার জমিতেও পুকুর খনন করতে হবে। এভাবেই এই বিল একদিন হারিয়ে যাবে।’

বিলের কৃষক জমির উদ্দিন বলেন, ‘ফসলি জমির মধ্যে পুকুর খনন করা হলে, বিলের অস্তিত্বই শেষ হয়ে যায়। পুকুরের পাড়ে বসতগড়ে ইঁদুর। একদিকে যেমন জলবদ্ধতা সৃষ্টি হয় অন্যদিকে ইঁদুরের উৎপাত বাড়ে। প্রশাসন কত বিঘা অনুমোদন দিয়েছে, তা জানা নেই, তবে এখানে প্রায় ৬ বিঘা জমিতে পুকুর খনন করা হচ্ছে। ’

 

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন অভিজ্ঞ পুকুর খননকারী বলেন, ‘১ বিঘা জমি থেকে প্রায় ৫ শত ট্রাক্টর মাটি উত্তোলন করা যায়। সেই হিসেবে ৬ বিঘা জমি থেকে প্রায় ৩ হাজার ট্রাক্টর মাটি উত্তোলন করা সম্ভব।’

ভ্যানচালক আলাল মিয়া বলেন, ‘দ্রুত গতির মাটিবাহী ট্রাক্টর গোকুলনগর থেকে, দত্তপাড়া পান মোকাম হয়ে, মহাসড়ক দিয়ে চলে যাচ্ছে ইটভাটায়। এই মাটিবাহী অবৈধ ট্রাক্টর চলাচলের কারণে, পথ চলতে সমস্যা হচ্ছে। অন্যদিকে রাস্তার আয়ুও কমে যাচ্ছে।’

ট্রাক্টর চালক মো. আলাল বলেন, ‘চারটি ট্রাক্টর দিয়ে ইটভাটায় মাটির সরবরাহ করা হচ্ছে। পুকুর খননকারি শফিক সরকারিভাবে অনুমোদন নিয়েছেন বলে আমি শুনেছি। প্রতিদিন গড়ে প্রায় অর্ধশত ট্রাক্টর মাটি ইটভাটায় সরবরাহ করা হচ্ছে।’

পুকুর খননকারী মো. শফিক বলেন, ‘আশ্রয়ন প্রকল্পে ১ হাজার ট্রাক্টর মাটি সরবরাহ করতে হবে। এই নিমিত্তে ৩ বিঘা জমিতে পুকুর খননের অনুমোদন দিয়েছেন সদর উপজেলা প্রশাসন। প্রতি ট্রাক্টর মাটির দাম ধরা হয়েছে ৪ শত টাকা।

তবে আশ্রয়ন প্রকল্পে পৌঁছাতে আমার খরচ হচ্ছে ৫ শত টাকা। তাই খরচ পুসিয়ে নিতে কিছু মাটি ইটভাটায় এবং পার্শ্ববর্তী মানুষের কাছে বিক্রি করা হচ্ছে।’ অনুমোদিত জায়গা ছাড়াও বাড়তি জমি জুড়ে পুকুর খনন করা হচ্ছে কেন ? এমন প্রশ্নের কোন উত্তর তিনি দেননি।

নাটোরের তরুণ সাংবাদিক, বুলবুল আহমেদ বলেন, ‘নাটোরে ফসলি জমি অত্যন্ত উর্বর। সেই জমিতে দীর্ঘদিন ধরেই পুকুর খনন করা হচ্ছে। কৃষকরা ফসল উৎপাদনের চেয়ে মৎস্য ব্যবসা লাভজনক মনে করছেন। ফলে কৃষকরা পুকুর খননের দিকে ঝুঁকছেন।

এখন বিষয়টা হচ্ছে সরকারিভাবে আইন প্রণয়ন করা দরকার, যার জমি সে যা ইচ্ছা তাই করবে। নইলে কঠোর হস্তে পুকুর খনন করা বন্ধ করতে হবে। এই অনুমতি দেওয়া আর অনুমোদন পাওয়ার মধ্যে যে খেলা চলছে, তাতে প্রশাসনের অসাধু কর্মকর্তা, কর্মচারী, পুলিশ প্রশাসন, সাংবাদিকসহ অনেকেই হাতিয়ে নিচ্ছে বিপুল পরিমাণ অর্থ।

কৃষক কিন্তু ঠিকই পুকুর খনন করছেন, মধ্যে থেকে তার বাড়তি ব্যয় হচ্ছে। আশ্রয়ন প্রকল্পের মাটি দেওয়ার ক্ষেত্রে সাধারণত যা হচ্ছে, হয়তো বিল ঠিকই উত্তোলন করা হবে। কিন্তু মাটি সরবরাহকারী একটি টাকাও পাবে না। এমনটাই আমরা দেখে আসছি। ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে কৃষক। তাই আমি মনে করি এই অনুমোদন দেওয়ার খেলাটা বন্ধ হওয়া দরকার।’

সদর উপজেলার সহকারী কমিশনার (ভূমি) মো. জোবায়ের হাবিব বলেন, ‘আশ্রয়ন প্রকল্পের কাজের জন্য, মাটির চাহিদা পূরণে, ওই জমিতে পুকুর খননের অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। যদি ইটভাটায় এই মাটি সরবরাহ করা হয়, তাহলে পুকুর খনন বন্ধ করে দেওয়া হবে।’

এ ব্যাপারে জেলা প্রশাসক শামীম আহমেদ বলেন, ‘আশ্রয়ন প্রকল্পে মাটি সরবরাহে যদি কোন অনিয়ম বা জনভোগান্তি সৃষ্টি হয়, সে বিষয়ে সার্বিকভাবে প্রশাসনের পক্ষ থেকে, সকল ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’

নাটোরে ফসলি জমিতে পুকুর খনন বন্ধ করা সম্ভব হচ্ছে না। বাড়তি ব্যয় করেই কৃষকরা তাদের জমিতে খনন করছে পুকুর। সচেতন মহলের নাগরিকরা মনে করছেন, অবাধে পুকুর খননের অনুমতি দেওয়া হোক। নইলে পুকুর খনন একবারে বন্ধ করা হোক। আর সরকারি কাজে সরকারি খাল বা নদী থেকে মাটির চাহিদা পূরণ করা উচিত বলে তারা মনে করছেন।

 

author avatar
Editor Online
Show More

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button