নাটোর জেলা জুড়ে চলছে অবাধে কৃষি জমিতে পুকুর খনন

মোঃ রাশেদুল ইসলাম, নাটোর প্রতিনিধি

নাটোরের বড়াইগ্রাম, গুরুদাসপুর ও লালপুরে সরকারী নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে কৃষি জমিতে চলছে অবাধে পুকুর খনন। কৃষি জমির এমন ধ্বংসযজ্ঞ চললেও প্রশাসনের ভূমিকা রহস্যজনক। নামমাত্র কিছু অভিযান চললেও প্রভাবশালীরা থেকে যাচ্ছেন ধরা ছোঁয়ার বাইরে। তাই দিনে রাতে অবাধে চলছে তিন ফসলের জমিতে পুকুর খননের কাজ। এতে করে শুধু কৃষি জমিই নষ্ট হচ্ছে না পরিবেশের উপরও বিরুপ প্রভাবের আশংকা রয়েছে। এছাড়া মাটি বহনকারী রাশিয়ান ট্রাক্টর চলাচলের কারণে সড়ক-মহাসড়কেরও ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে। দ্রুত এর অবসান না হলে জলাবদ্ধতাসহ পরিবেশে বিরুপ প্রভাব পড়ারও আশংকা করছেন কৃষি সংশ্লিষ্টরা।

মাটি ব্যবসায়ী আালাউদ্দিন (ছদ্মনাম) জানান, ১ একর জমিতে ১০ ফিট গভীর পুকুর খনন করে মাটি উত্তোলন হয় ৩,৩০০ গাড়ী। যার বিক্রয় মূল্য ১১০০ টাকা গাড়ী হিসেবে প্রায় ৩৬ লাখ ৩০ হাজার টাকা।

গুগল নিউজে ফলো করুন Mohona TV গুগল নিউজে ফলো করুন Mohona TV

বড়াইগ্রামের কৃষক দেলোয়ার হোসেন জানান, ফসল চাষাবাদে সেচ, সার, কীটনাশক, লেবার ইত্যাদির খরচ বেশী। কিন্তু তুলনামূলকভাবে মৎস্য চাষে খরছ কম, লাভ বেশী হওয়ায় পুকুর খনন করায় কৃষকরা।

সরিষাহাট গ্রামের ভুক্তভোগী কৃষক গোলাম মোস্তফা ও আনসার মন্ডল জানান, মাঠে যেভাবে ফসল নষ্ট করে পুকুর খনন করছে, এভাবে পুকুর খনন করলে আবাদযোগ্য জমি দ্রুত হ্রাস পাবে।

তারা আরো জানান, তারানগর গ্রামের মৃত দবির হাজীর ছেলে সমসের আলী প্রায় ১৭ বিঘা আবাদি জমিতে পুকুর খনন করছেন। তারমধ্যে আমাদের ২ ভাইয়ের ৪২ শতাংশ আবাদি জমিতে জোর করে পুকুর খননের চেষ্টা করছে। ইতিমধ্যে কিছু অংশ খনন করে ফেলেছে। উপজেলা প্রশাসন বরাবর দরখাস্ত করেও কোন প্রতিকার পাওয়া যায়নি।

তারানগর গ্রামের বিপন হোসেন বলেন, “জমি নষ্ট করে অপরিকল্পিত ভাবে পুকুর খনন করায় জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হবে। আমরা গরীব মানুষ। আমাদের অল্পই জমি, আবাদ না হলে খাব কি? অনেককে বলেছি কার কথা কে শুনে।”

সরিষাহাটের নূর ইসলাম জানান, “এলাকায় ৮/১০ টি এস্কোভেটর (ভেকু) দিয়ে পুকুর খনন করছে। এক-একটি পুকুরের আয়তন ১০/১২ বিঘা। এই মাঠে সকল জমিতেই রসুন, গম, পাট, সরিষা চাষ হয়। এসব আবাদ নষ্ট করে পুকুর খনন করছে প্রভাবশালী অসাধু মাটি ব্যবসায়ীরা। আমার যেগুলো জমি রয়েছে সব জমিতেই রসুন চাষ করেছি। এরপর থেকে জলাবদ্ধতার কারণে এ জমিগুলোতে কোন ফসল হবে না।”

সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, নাটোরের বড়াইগ্রাম উপজেলার তারানগর,সরিষাহাট, শ্রীরামপুর, বাগডোব, বাজিতপুর, মানিকপুর, আদগ্রাম, পিওভাগ এলাকায় অসাধু মাটি ব্যবসায়ী আদম আলী, সাইদুর রহমান সহ অন্যান্য আরো অনেকেই সরকার দলীয় নেতাদের সহযোগিতায় খনন করছে পুকুর।

পাশাপাশি উপজেলার বনপাড়া, রাজাপুর, বাগডোব, জোয়াড়ী,আহমেদপুর, কামারদহ, কুমরুল, চান্দাই, দাসগ্রাম, গাড়ফা, সাতৈইল, মহানন্দগাছা, জোয়াড়ী সহ বিভিন্ন এলাকায় অর্ধ শতাধিক এস্কোভেটর (ভেকু) দিয়ে পুকুর খনন চলছে।

লালপুর উপজেলার কদিমচিলান, পানঘাটা, দুয়ারিয়া, চাঁদপুর, ধলামানিকপুর, ঘাটচিলান, সেখচিলান, পাল্লা ভবানীপুর, চকনাজিরপুর এলাকায় প্রায় ৩০/৩৫ টি এস্কোভেটর দিয়ে পুকুর খনন চলছে।

গুরুদাসপুর উপজেলার চাপিলা, নাজিরপুর, রশিদপুর, মকিমপুর, বিন্নিবাড়ি, পাঠানপাড়া, কাছিকাটা, নয়াবাজার, আলীপুর সহ বিভিন্ন এলাকায় মাটি ব্যবসায়ী শরীফুল ইসলাম, মিল্টন , রুবেল, আলম , জাহিদ, হান্নান মাষ্টার, জাহাঙ্গীর, শাহীন সহ অনেকেই প্রায় এক শত এস্কোভেটর দিয়ে পুকুর খনন করে পুকুরের মাটি বিক্রি করছে উপজেলার বিভিন্ন ইট ভাটা সহ বিভিন্ন মানুষের বাড়িতে বাড়িতে ও বিভিন্ন জায়গায়। সেই সাথে পাকা-কাঁচা এবং মহাসড়ক ব্যবহার করছে মাটি বহনকারী ট্রাক্টর ও কুত্তা গাড়ি। এতে ক্ষতি হচ্ছে রাস্তাঘাট, ঘটছে দুর্ঘটনা, নষ্ট হচ্ছে পরিবেশ।

ট্রাক্টর মালিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, প্রতিটি গাড়ীর মাটি বিক্রি হচ্ছে ১০০০ টাকা থেকে ১২০০ টাকায়। সেই সাথে গাড়ীগুলো চালাতে দেখা যায় অধিকাংশই অপ্রাপ্ত চালক। যাদের বয়স পনের থেকে বিশের মধ্যে। এদের কোন ড্রাইভিং লাইসেন্স বা গাড়ি চালানোর কোন বৈধ কাগজপত্র নেই।

এছাড়া অনেকেই ভিটেমাটিতে করা আম, লিচু, কাঁঠাল বাগান কেটে সাময়িক লাভের আশায় পুকুর খনন করছেন। এলাকাবাসী জানান, মাঝে মধ্যে প্রশাসনের লোক দেখানো অভিযান চললেও কোনোভাবেই বন্ধ হচ্ছেনা কৃষি জমির এমন ধ্বংসযজ্ঞ। এর সাথে উপজেলা প্রশাসনের কিছু অসৎ কর্মকর্তারা জড়িত থাকায় কোন পদক্ষেপই কার্যকর হচ্ছেনা বলে নাম প্রকাশে অনেকেই এই প্রতিবেদককে জানান। ঘটনার সাথে জড়িত প্রভাবশালীরা সব সময়ই থেকে যাচ্ছে ধরা ছোঁয়ার বাইরে।

নাটোর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক আব্দুল ওয়াদুদ বলেন, “পুকুর খনন উদ্বেগজনকভাবে বাড়ছে। তিন ফসলি জমির পরিমান ২০১৫-১৬ অর্থ বছরে ১৪৮৭৪৩ হেক্টর। ২০১৯ সালে তা কমিয়ে দাড়িয়েছে ১২৭১৮৭ হেক্টরে। কৃষি জমি কমছে। আমরা আইন শৃঙ্খলা মিটিংয়ে জেলা প্রশাসকের সাথে আলোচনা করবো। তিন ফসলি জমি কোনভাবেই নষ্ট করা যাবে না।”

নাটোর জেলা মৎস্য কর্মকর্তা আবুল কালাম বলেন,“নাটোরে পুকুর খনন অনেক বেড়ে গেছে। গত ৫ বছরে নাটোর জেলায় মাছ উৎপাদন বেড়েছে ৯৫০০ টন। কারণ ২০১৩-১৪ মওসুমে আবাদি জমির পরিমান ছিল ১৫৩৬৭৪ হেক্টর, ২০১৪-১৫ মওসুমে ছিল ১৫০৮৩৮ হেক্টর, ২০১৫-১৬ মওসুমে তা কমিয়ে হয় ১৪৮৭৪৩ হেক্টর, ২০২২-২৩ মওসুমে তা আরো কমিয়ে গেছে। ২০১৬-১৭ অর্থ বছরে জেলায় পুকুরের সংখ্যা ছিল প্রায় সাড়ে ৩৫ হাজার। তা ২০২২-২৩ মওসুমে বেড়ে অনেক বেশী হয়েছে। আমরা কোনভাবেই চাইনা জমি নষ্ট করে পুকুর খনন। নাটোরে যে পরিমান মাছের চাহিদা রয়েছে তার থেকে বেশী উৎপাদন হচ্ছে।”

বড়াইগ্রাম থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আবু সিদ্দিক বলেন, “পুকুর খনন বন্ধে আমরা যেখানে যখন খবর পাচ্ছি, উপজেলা প্রশাসন মোসা. মারিয়াম খাতুনের নেতৃত্বে অভিযান পরিচালনা করছি।”

বড়াইগ্রাম উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোসা. মারিয়াম খাতুন বলেন, যে বড়াইগ্রাম উপজেলা সহ নাটোর জুড়েই ফসলি জমি কেটে পুকুর খনন করা হচ্ছে। এতে আশংকাজনক ভাবে কৃষি জমির পরিমান হ্রাস পাচ্ছে। এতে কৃষি ফসল উৎপাদনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। অবৈধভাবে পুকুর খনন বন্ধে উপজেলা প্রশাসন বিধিবিধানের মধ্যে থেকে বিভিন্ন অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে।

কিন্তু এটি যথেষ্ঠ নয়, পুরোপুরি পুকুর খনন অবৈধভাবে বন্ধ করার জন্য সকল পর্যায়ে সন্মানিত জন প্রতিনিধি বৃন্দ, পুলিশ বিভাগ, এবং শিক্ষিত গন্যমান্য সচেতন ব্যক্তিদের সকলে একসঙ্গে ব্যক্তি পর্যায় থেকে সচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে। সবাইকে একযোগে পুকুর খনন বন্ধে কাজ করতে হবে তবেই এটি নির্মূল হবে।

বড়াইগ্রাম উপজেলা চেয়ারম্যান ডা. মো. সিদ্দিকুর রহমান পাটোয়ারী বলেন, “নাটোর জেলায় কোথাও পুকুর খনন করা যাবে না। কারণ আমাদের দেশে যে পরিমান মাছের চাহিদা প্রয়োজন তার থেকে বেশী উৎপাদন হচ্ছে। দেশনেত্রী মাননীয় প্রধান মন্ত্রী বলেছেন, তিন ফসলি জমি নষ্ট এবং কোন প্রকল্প নেয়া যাবে না। এবিষয়ে কোর্টের নির্দেশনা রয়েছে। পুকুর খনন বন্ধে সবাইকে একযোগে এগিয়ে আসতে হবে।”

জেলা প্রশাসক শামিম আহমেদ বলেন,  পুকুর খনন বন্ধে তারা জোর প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন। আর্থিক জরিমানার সাথে জেল প্রদানও করছেন তারা। উপজেলা নির্বাহী অফিসার ও সহকারী কমিশনার (ভূমি)গণ তৎপর রয়েছেন। ভবিষ্যতে পুকুর খনন বন্ধে সরকারী নির্দেশ পালনে তারা তৎপর থাকবেন।

নাটোর-৪ (বড়াইগ্রাম-গুরুদাসপুর) আসনের সংসদ সদস্য অধ্যাপক আব্দুল কুদ্দুস বলেন, “পুকুর খননের বিষয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশ ও মহামান্য হাইকোর্টের নিষেধাজ্ঞা রয়েছে তিন ফসলি জমিতে পুকুর না কাটার জন্য। প্রশাসন কেন বন্ধ করে না  এটা আমার বোধগম্য নয়। রাজনৈতিক নেতাদের দায়িত্ব হচ্ছে প্রশাসনকে সহযোগিতা করা। যদি প্রশাসনকে উল্টো দিকে কেহ সহযোগিতা করে তাহলে প্রশাসনের কিছু করার নাই। অবৈধভাবে ইনকাম আয় করার জন্য এগুলো করছে তারা। বিশেষ করে আমাদের এলাকায় পুকুর খনন বেশী হচ্ছে,আমি এলাকায় এবসেন্স থাকার কারণে পুকুর খননের সুযোগ বেশী পেয়েছে। কোনো অবস্থানেই কৃষি জমি কেটে পুকুর বানানো যাবে না।”

এহেন অবস্থায় একদিকে যেমন পরিবেশ ও জলবায়ুর উপর বিরুপ প্রভাব পড়ছে, তেমনি জনজীবনে নানা সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে। মাটি বহনের জন্য অবৈধ ট্রাক্টর সড়ক-মহাসড়কে অবাধে চলাচল করায় অল্পদিনেই নষ্ট হচ্ছে রাস্তাঘাট। এছাড়া অদক্ষ চালক দ্বারা গাড়ি চালানোর কারণে ঘটছে দূর্ঘটনাসহ প্রাণহানিও। তাই অবিলম্বে এমন ধ্বংসলীলা বন্ধের দাবী স্থানীয়দের। এদিকে নাটোরের সিংড়ায়, বাগাতিপাড়া, লালপুর, গুরুদাসপুর সহ জেলার সবকটি উপজেলা মাটি বহনকারী ডক্টর ও কুত্তা গাড়ির নিচে পড়ে নিহত হয়েছেন শিশু সহ পাঁচ থেকে সাত জন।

 

author avatar
Editor Online
Show More

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button