বগুড়ায় ধর্ষণ মামলাঃ ‘ওসি বললেন, ছাত্রীর সাথে প্রভাষকের কঠিন সম্পর্ক ছিল’
আতিক রহমান, বগুড়া প্রতিনিধি

বগুড়ার ধুনট থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা কৃপা সিন্ধু বালার বিরুদ্ধে ধর্ষণের আলামত নষ্টের অভিযোগ উঠেছে। গত ২ আগস্ট ধর্ষনের শিকার এক যুবতির মা বগুড়ার পুলিশ সুপার বরাবর এ অভিযোগ দায়ের করেন।
অভিযোগের পর পুলিশ সুপার দু’জন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার এবং কোর্ট ইন্সপেক্টরকে সদস্য করে তিন সদস্য বিশিষ্ট একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেন। পরে মামলার তদন্তভার দেয়া হয় বগুড়া জেলা পুলিশের গোয়েন্দা পুলিশকে।
ধর্ষিতার মা অভিযোগে উল্লেখ করেন, তার মেয়েকে ধর্ষণের বিষয়টি জানার পর তিনি ধুনট থানায় মামলা দায়ের করেন। মামলাটির তদন্তকারী কর্মকর্তা ছিলেন থানার ওসি কৃপা সিন্ধু বালা। তদন্ত চলাকালীন তদন্তকারী কর্মকর্তা আসামী মুরাদুজ্জামান মুকুলের কাছ থেকে ধর্ষণের ভিডিও, মোবাইল ফোনসহ গত ১২ মে উদ্ধারের পর তাকে গ্রেফতার করে।
এরপর তদন্তকারী কর্মকর্তা গত ১৪ মে তাকে ডেকে ধর্ষণের ভিডিওগুলো দেখান এবং তাকে জানান উদ্ধার হওয়া ভিডিওগুলো সিডি করে উদ্ধারকৃত ফোনের সাথে সিআইডিতে পাঠানো হবে। কিন্তু তদন্তকারী কর্মকর্তা জব্দ তালিকায় এবং আলামত ফরেনসিকে পরীক্ষার জন্য পাঠানো তালিকায় উদ্ধার হওয়া ভিডিও এর সিডি করে সেই সিডি পাঠানোর বিষয় উল্লেখ না করে শুধুমাত্র উদ্ধার হওয়া ২টি মোবাইল উল্লেখ করে ফরেনসিকে পরীক্ষার জন্য পাঠিয়েছেন।
অভিযোগে আরো উল্লেখ করা হয়, পরবর্তীতে তিনি জানতে পেরেছেন তদন্তকারী কর্মকর্তা গত ১৯ মে আদমদীঘি থানায় কর্মরত এসআই প্রদীপ কুমার এর কাছে ফোন দুটি পাঠিয়ে সকল তথ্য ধ্বংস করেছেন। ফলে উক্ত ফোন দুটি হতে কোন ভিডিও পাওয়া যাবে না বলে তারা মনে করছেন। তদন্তকারী অফিসারকে মামলাটি বর্তমানে তদন্ত পরিচালনা করা অবস্থায় তিনি ও উল্লেখিত স্বাক্ষীগণ ধর্ষণের অশ্লীল ভিডিও চার্জশীটে উল্লেখ করে চার্জশীট দাখিলের অনুরোধ করেন। কিন্তু তদন্তকারী অফিসার মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে আসামীকে রেহাই করার জন্য ভিডিও এর কথা চার্জশীটে উল্লেখ না করে দায়সারাভাবে চার্জশীট দাখিলের চেষ্টা করছেন বলে অভিযোগে তিনি উল্লেখ করেন।
ধর্ষিতার মা বলেন, ফরেনসিকে আসামীর মোবাইল থেকে পাওয়া ভিডিও সিডি আকারে এবং মোবাইলসহ পাঠানোর কথা ছিলো। কিন্তু শুধুমাত্র মোবাইল ফোন ফরেনসিকে পাঠানো হয়। তিনি এ বিষয়ে থানার ওসি কৃপা সিন্ধা বালার কাছে জানতে চাইলে ওসি বলেন, মোবাইলে আপনার মেয়ের কোন ভিডিও ছিলো না। কিছু পাওয়া যায়নি। অথচ তিনি নিজে আমাদের ডেকে মোবাইল থেকে উদ্ধার হওয়া ভিডিও দেখিয়েছেন। সেখানে আমার মেয়ের সাথে আসামী মুরাদের অশ্লীল ভিডিওর পাশাপাশি অন্য আরো বেশ কয়েকজন মেয়ের সাথে তার অশ্লীল ছবি ও ভিডিও ছিলো।
ধুনট থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) কৃপা সিন্ধু বালা ধর্ষণের আলামত নষ্টের অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, এটা সম্পূর্ণ মিথ্যা কথা। ওই মেয়েটা স্ট্যাবলিস্ট করার চেষ্টা করছে তাকে ভিডিও দেখিয়ে ধর্ষণ করেছে। আসলে ওদের মাঝে কঠিন সম্পর্ক হয়েছিল। আসামী এবং ওই মেয়েদের পাশাপাশি দরজা ছিলো, দুই বাড়ি থেকেই সবাই যার যার কাজে যেত আর তারা দু’জন একা থাকতো। আসামীর মোবাইলে কোন ভিডিও পাওয়া যায়নি। আমরা তাৎক্ষণিক মোবাইল দেখেছি। সেখানে আসামীর পারিবারিক ছবি ছিলো। এটা মিথ্যা অভিযোগ। আসামীর মোবাইল ফরেনসিকের জন্য সিআইডিতে পাঠানো হয়েছে। রিপোর্ট এলে মামলার চার্জশীট হবে।
মামলার বাদীদের পক্ষ থেকে এসপি স্যারের কাছে অভিযোগ দিয়েছে। এরপর এসপি স্যার তদন্ত কমিটি গঠন করেছেন। মামলার তদন্তভার ডিবিতে দিয়েছেন। আমরা মামলা গত ১৮ তারিখে ডিবিকে বুঝিয়ে দিয়েছি। বগুড়ার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (অপরাধ) আব্দুর রশিদ জানান, একটা অভিযোগ হয়েছে ওসির কাছে থেকে কিছু ভিডিও পাচ্ছে না তারা। এ নিয়ে তিন সদস্য বিশিষ্ট একটি তদন্ত কমিটি হয়েছে। তদন্ত এখনও চলছে। তদন্ত রিপোর্ট যখন দেবো তখন আপনারা এসপি স্যারের কাছে জেনে নেবেন।
উল্লেখ্য, বগুড়ার ধুনটে দশম শ্রেণীর এক স্কুল ছাত্রীকে ধর্ষণের অভিযোগে মুরাদুজ্জামান মুকুল নামের এক প্রভাষককে চলতি বছরের ১২ মে গ্রেফতার করে পুলিশ। মুরাদুজ্জামান মুকুল ধুনটের জালশুকা হাবিবুর রহমান কলেজের ইসলামের ইতিহাস বিভাগের প্রভাষক ছিলেন। পরে ঐ ছাত্রীকে বিভিন্ন সময় ভয়ভীতি দেখিয়ে কয়েক মাস যাবৎ ধর্ষণের অভিযোগে গ্রেফতার হওয়ায় তাকে কলেজের চাকরি থেকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়।
মুকুলের বাড়ি উপজেলার এলাঙ্গী ইউনিয়নের শৈলমারী গ্রামে। তার স্ত্রীও একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষিকা। গ্রেফতার মুকুল ধুনট পৌর এলাকার দক্ষিণ অফিসারপাড়া এলাকার একটি বাসার নিচতলায় ভাড়া থাকতেন। ঐ বাড়ির মালিকের দুই বছর বয়সী মেয়ে খেলাধুলা করতে প্রায়ই মুরাদুজ্জামানের ফ্লাটে যাওয়া-আসা করতো। সেই সুবাদে বাড়ির মালিকের বড় মেয়ে দশম শ্রেণির ছাত্রীও সেখানে যেত। এদিকে মুকুলের স্ত্রীও স্কুলের শিক্ষিকা হওয়ায় তিনি বাড়িতে থাকতেন না। এই সুযোগে মুরাদুজ্জামান গ্রেফতার হওয়ার কয়েক মাস আগে মেয়েটিকে জোড়পূর্বক ধর্ষণ করে। সে সময় ধর্ষণের ভিডিও রেকর্ড করা হয়। এরপর ওই ভিডিও ফেসবুকে ভাইরাল করে দেওয়ার হুমকি দিয়ে একাধিকবার ধর্ষণ করেন তিনি।