
উরুগুয়ের সাবেক প্রেসিডেন্ট, বামপন্থি বিপ্লবী থেকে জনপ্রিয় নেতা হয়ে ওঠা হোসে ‘পেপে’ মুজিকা ৮৯ বছর বয়সে মারা গেছেন। মঙ্গলবার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এক বার্তায় তার মৃত্যুর খবর জানান দেশটির বর্তমান প্রেসিডেন্ট ইয়ামান্দু ওর্সি।
২০২৪ সালে মুজিকার গলায় ক্যানসার ধরা পড়ে। পরে সেটি যকৃতে ছড়িয়ে পড়ে। মৃত্যুর ঘোষণা দিয়ে ওর্সি লেখেন, “গভীর দুঃখের সঙ্গে আমাদের সহকর্মী পেপে মুজিকার মৃত্যু ঘোষণা করছি। আপনি আমাদের যা দিয়ে গেছেন, এবং মানুষের প্রতি যে ভালোবাসা দেখিয়েছেন, তার জন্য কৃতজ্ঞতা।”
২০১০ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত উরুগুয়ের প্রেসিডেন্ট ছিলেন মুজিকা। তার শাসনামলে তিনি পরিবেশবান্ধব সংস্কার, সমকামী বিয়েকে বৈধতা, গাঁজা ব্যবহারের নিয়ন্ত্রণ শিথিলসহ নানা সাহসী পদক্ষেপ গ্রহণ করেন।
বিশ্বজুড়ে তিনি পরিচিত ছিলেন তার সরল জীবনযাপনের জন্য। প্রেসিডেন্ট থাকাকালেও তিনি রাজধানী মন্টেভিডিওর উপকণ্ঠে নিজ ফুলচাষের খামারে থাকতেন। এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, “রাজনীতি বিলাসে ডুবে গেলে তা মানুষের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। রাজনীতিকদের সাধারণ মানুষের মতো জীবন যাপন করা উচিত, বিশেষ সুবিধাপ্রাপ্তদের মতো নয়।”
তার মৃত্যুতে লাতিন আমেরিকার বামপন্থি নেতারা শোক জানিয়েছেন।
মেক্সিকোর প্রেসিডেন্ট ক্লাউডিয়া শেইনবাউম লেখেন, “তার প্রজ্ঞা, দূরদর্শিতা ও সরলতা লাতিন আমেরিকা ও বিশ্বের জন্য এক উদাহরণ হয়ে থাকবে।”
চিলির প্রেসিডেন্ট গ্যাব্রিয়েল বোরিচ লেখেন, “তিনি আমাদের দেখিয়ে গেছেন, সবকিছু আরও ভালোভাবে করা সম্ভব।”
কলম্বিয়ার প্রেসিডেন্ট গুস্তাভো পেট্রো লিখেছেন, “বিদায় বন্ধু। আশা করি একদিন লাতিন আমেরিকার একটি নিজস্ব সংগীত থাকবে, যা আমাদের ঐক্যের প্রতীক হবে।”
মুজিকা ছিলেন সেই প্রজন্মের প্রতীক, যারা ২০ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে লড়াই করে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা রেখেছেন।
তরুণ বয়সে তিনি তুপামারোস নামক এক সশস্ত্র বামপন্থি আন্দোলনের নেতা ছিলেন, যারা ব্যাংক ডাকাতি, শহর দখল ও পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িত ছিল।
তিনি একাধিকবার গ্রেপ্তার হন এবং প্রায় এক দশক একা কারাবন্দি থাকেন। ১৯৭৩ সালে সেনা অভ্যুত্থানের পর উরুগুয়ে সামরিক শাসনের অধীনে যায়, যা ছিল গুম, নির্যাতন ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের সময়কাল। ১৯৮৫ সালে গণতন্ত্র ফিরে আসলে মুজিকাসহ অন্যান্য বিদ্রোহীরা সাধারণ ক্ষমায় মুক্তি পান।
পরে তিনি ‘ফ্রেন্তে অ্যাম্পলিও’ নামক মধ্য-বাম জোটে যোগ দিয়ে সক্রিয় রাজনীতিতে ফেরেন। ৭৪ বছর বয়সে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। তার নেতৃত্বে গর্ভপাত ও সমকামী বিয়েকে বৈধতা দেওয়া হয়, গাঁজা বৈধকরণে অগ্রণী ভূমিকা রাখেন, এবং নবায়নযোগ্য জ্বালানিকে গুরুত্ব দিয়ে দেশকে পরিবেশবান্ধব রাষ্ট্রে পরিণত করেন।
তার স্ত্রী লুসিয়া তোপোলানস্কি, যিনি তুপামারোস আন্দোলনের সময়ই তার সঙ্গে যুক্ত হন, পরবর্তীতে উরুগুয়ের ভাইস প্রেসিডেন্ট হন।
মুজিকার সাধারণ জীবনধারা তাকে “বিশ্বের সবচেয়ে গরিব প্রেসিডেন্ট” উপাধি এনে দেয়। তিনি প্রেসিডেন্ট থাকাকালেও থাকতেন একটি সাধারণ খামারে এবং চলাফেরা করতেন পুরনো নীল রঙের ভক্সওয়াগন বিটল গাড়িতে।
২০২২ সালে আল জাজিরাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, “আমরা একজন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন করি, কিন্তু আচরণ করি যেন একজন রাজা নির্বাচন করেছি—লাল গালিচা, প্রাসাদ, রাজকীয় আচরণ। কিন্তু দোষ শূকরছানার নয়, যারা তার পিঠ চুলকায়, তাদের।”
প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব ছাড়ার পরও তিনি লাতিন আমেরিকার বিভিন্ন দেশে রাষ্ট্রপ্রধানদের শপথ অনুষ্ঠানে যোগ দেন এবং নিজ দেশের রাজনীতিতে সক্রিয় থাকেন।
২০২৪ সালের সেপ্টেম্বরে তার ক্যানসার কিছুটা নিয়ন্ত্রণে এলেও ২০২৫ সালের জানুয়ারিতে জানা যায়, তা যকৃতে ছড়িয়ে পড়েছে।
শেষ বয়সে তিনি বলেন, “সত্যি বলতে, আমি মরতে চলেছি। তবে একজন যোদ্ধার বিশ্রামের অধিকার তো থাকেই।”