জাতীয়রাজনীতি

এমপি জাফর আলমের যত অপকর্ম

মোহনা অনলাইন

 

কক্সবাজার ১ সংসদীয় আসন চকরিয়া – পেকুয়া আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী ও বর্তমান সংসদ সদস্য জাফর আলমের নানা বির্তকিত কর্মকান্ডে অতিষ্ঠ দুই  উপজেলার পাঁচ লক্ষাধিক জনগণ। দীর্ঘদিন ধরে তার জুলুম অত্যাচারে এলাকার মানুষ মুখ না খুললেও এখন খুলতে শুরু করেছে। 

সরকারি বনভূমি দখল, জমি দখল, চিংড়ি ঘের দখল, গরুচুরি, সাধারণ মানুষের জমি দখল করে মার্কেট নির্মাণসহ অনেক অভিযোগ রয়েছে স্বতন্ত্র প্রার্থী জাফর আলমের বিরুদ্ধে। এছাড়াও আলোচনায় এসেছে গত বছরের ১৫ আগস্ট সাঈদীর গায়েবানা জানাজায় গুলি চালিয়ে মানুষ হত্যা।

জানাযায় তার এসব অভিযোগের কারণে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামীলীগের মনোনয়ন পাননি। এবার তাকে প্রতিহত করতে এ দুই উপজেলার মানুষ এখন ঐক্যবদ্ধ হয়েছে।  জাফর আলম এমপি হওয়ার পর গেল পাঁচ বছরে ফুলে ফেঁপে উঠেছে তাঁর সম্পদ। বেড়েছে স্ত্রী ও পুত্রের সম্পদও। চকরিয়া-পেকুয়ায় তাঁর কথাই যেন আইন! রয়েছে নিজস্ব বাহিনী। পাহাড় কাটা, নদী দখল ও অবৈধভাবে বালু উত্তোলনে ওই বাহিনীকে কাজে লাগান তিনি।

 

গত বছরের ১৫ আগস্ট অস্ত্রধারীর পাশে দাঁড়িয়ে মিছিলে নেতৃত্ব দিয়ে আলোচনায় আসেন স্বতন্ত্র প্রার্থী জাফর আলম। স্ত্রী শাহেদা বেগমের নামে ক্রয় করা জমি দখল নিতে সোহেল নামে এক ছাত্রলীগ নেতা নিহত হন। এ পর্যন্ত জাফর আলমের নেতৃত্বে মিছিল থেকে তার বাহিনী গুলি চালিয়ে অন্তত প্রতিপক্ষের ৫জন রাজনীতিক কর্মীকে হত্যা করেছে। তার ভাতিজা জিয়াবুল হক ও ভাগিনা মিজানুর রহমান গড়ে তুলেছেন নিজস্ব বাহিনী। সেই বাহিনীর নেতৃত্বে চকরিয়া ও পেকুয়া উপজেলায় অপরাধ জগত নিয়ন্ত্রণ করছেন।

 

জাফর আলম গত ১৯ ডিসেম্বর একটি নির্বাচনী সভায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে নিয়ে সমালোচনা করায় তাকে চকরিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগ সভাপতির পদ থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়। ২০১৮ সালে প্রথম সাংসদ নির্বাচিত হন। অল্প সময়ে মালিক হয়েছেন বিপুল অর্থ সম্পদের। এমপি হওয়ার পাঁচ বছরে তাঁর সম্পদ বেড়েছে দশ গুণ। তাঁর স্ত্রী শাহেদা বেগম স্কুল শিক্ষিকা। স্বামী এমপি হওয়ার পর ফুলে ফেঁপে উঠেছে তাঁর সম্পদও। যা এবারের নির্বাচনী হলফনামায় উঠে এসেছে।

 

অবৈধভাবে বিপুল সম্পদ অর্জনের অভিযোগে এমপি জাফর আলম ও তাঁর পরিবারের তিন সদস্যের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান শুরু করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। এর অংশ হিসেবে গত বছরের সেপ্টেম্বরে দুদকের কক্সবাজার কার্যালয়ে জাফর আলম, তাঁর স্ত্রী শাহেদা বেগম, ছেলে তানভির সিদ্দিকী তুহিন ও মেয়ে তানিয়া আফরিনকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। দুদকের একটি সূত্র বলছে, জাফর আলম ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে সরকারি জমি ও জলমহাল দখল, মাদক ব্যবসা, চাঁদাবাজি এবং অবৈধভাবে বালু বিক্রি করে ২৩টি দলিলে ২৪ একর জমি নামে-বেনামে কিনে নেওয়ার তথ্য পাওয়া গেছে। এ ছাড়া চকরিয়া ও পেকুয়ায় তিনটি মার্কেট রয়েছে তাঁর, আছে কয়েকটি গাড়ি। সব মিলিয়ে প্রায় শতকোটি টাকার সম্পদের মালিক তিনি।

 

২০১৮ সালের নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার সময় তার অস্থাবর ও স্থাবর সম্পদ ছিল ১ কোটি ৫৯ লাখ ৮০ হাজার ৯৯৩ টাকা। যেখানে তার নিজের নামে ছিল ৯৭ লাখ ৪০ হাজার ৪৯৩ টাকার সম্পদ আর স্ত্রীর নামে ছিল ৬২ হাজার ৪০ টাকার ৫০০ টাকার সম্পদ। যৌথ মালিকানা বা তার আয়ের ওপর নির্ভরশীলদের কোন আয় ছিল না।

২০২৩ সালে এসে তার বার্ষিক আয়, অস্থাবর ও স্থাবর সম্পদ দাঁড়িয়েছে ১৬ কোটি ৫৭ লাখ ৩৪ হাজার ৩০৫ টাকা। যেখানে রয়েছে তার নিজের নামে ১০ কোটি ৭৮ লাখ ৬৩ হাজার ৮৯ টাকার সম্পদ। স্ত্রীর নামে রয়েছে ২ কোটি ২১ লাখ ৭১ হাজার ২৫৪ টাকা, যৌথ মালিকানায় রয়েছে ৩ কোটি ২৩ লাখ ৯০ হাজার ৩৫৭ টাকা এবং তার আয়ের ওপর নির্ভরশীলদের রয়েছে ৩৩ লাখ ৯ হাজার ৬০৩ টাকার সম্পদ। অর্থাৎ এমপি জাফর আলমের ৫ বছরে সম্পদ বেড়েছে ১০ দশমিক ৩৭ গুণ।

 

পেকুয়ায় সরকারি জলাশয় ও ড্রেন ভরাট করে মেয়ে ও তাঁর স্বামীর নামে নিউমার্কেট নির্মাণ করেছেন জাফর আলম। যার বাজার মূল্য প্রায় আট কোটি টাকা। এই মার্কেট নির্মাণে সদর ইউনিয়নের বাইম্যাখালীর মো. আলমগীরের এক একর জায়গা দখলের অভিযোগ রয়েছে। পরে এ ব্যাপারে আদালতে মামলাও করা হয়। মেয়ের নামে মার্কেট নির্মাণে পেকুয়া ইউনিয়ন পরিষদ সংলগ্ন ৬০০ মিটার দৈর্ঘ্য ও ৫ মিটার প্রস্থের রাস্তাটিও দখল করার অভিযোগ উঠেছে এমপির বিরুদ্ধে। এতে ১২-১৫টি পরিবার অবরূদ্ধ হয়ে পড়েছে।

 

অন্যের জমি দখল করে চকরিয়া পৌরসভা ৪ নম্বর ওয়ার্ডে ছেলে তুহিন ও মেয়ে তানিয়ার নামে আরেকটি মার্কেট নির্মাণ করছেন এমপি জাফর আলম, যার বাজার মূল্য দুই কোটি টাকা। সিস্টেমপ্লাজা নামে আরেকটি মার্কেট রয়েছে তাঁর, যার বাজার মূল্য প্রায় ১৫ কোটি টাকা। ছেলে ও মেয়ের নামে চিরিংগার বিভিন্নস্থানে পানির দামে জায়গা কিনেছেন তিনি। এছাড়া ছেলে তুহিনের নামে তিনটি বিলাসবহুল গাড়ি কিনেছেন বলে জানান স্থানীয়রা। স্ত্রী শাহেদা বেগমের নামে রয়েছে শফিংমল শাহেদা কমপ্লেক্স। এত কিছুর পরও ছেলেকে মালয়েশিয়ায় পড়ানোর আড়ালে অর্থ পাচারের অভিযোগও রয়েছে এমপি জাফরের বিরুদ্ধে।

জানাযায়,  জমির মালিককে এক ধরনের বিপদে ফেলে তার পর জমি বিক্রি করতে বাধ্য করেন এমপি জাফর আলম। এভাবে পৌরসভার ৯ নম্বর ওয়ার্ডে মেয়ে তানিয়া আফরিনের নামে দুই একর জমি কিনে তা ভরাট করে দখলে নিয়েছেন। যার মূল্য দুই কোটি টাকার বেশি।

 

এমপি জাফরের বিরুদ্ধে আরও অভিযোগ হলো, তিনি চকরিয়া বাস টার্মিনালের পূর্ব পাশে জলাশয় দখল ও ভরাট করে কয়েকজনের কাছে বিক্রি করেছেন। রামপুর মৌজায় গ্রামীণ ব্যাংকের নামে বরাদ্দ ৩০০ একরের চিংড়ি প্রজেক্ট এক চেয়ারম্যানকে দিয়ে রাতারাতি দখল করে নিয়েছেন। বরইতলী-মগনামা সড়কে নবনির্মিত বানৌজা শেখ হাসিনা ঘাঁটি সড়কে মাটি দেওয়ার নাম করে মছনিয়া কাটা এলাকায় সাবাড় করেছেন বিশাল পাহাড়।

 

পেকুয়ায় একটি সংযোগ সড়ক নির্মাণের সরঞ্জাম রাখা হয়েছে উপজেলা ক্রীড়া কমপ্লেক্স মাঠে। এতে খেলার মাঠে আর খেলা হচ্ছে না। দুই বছর ধরে এই অবস্থা। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মেসার্স জামিল ইকবালের দাবি, এমপি জাফরের নির্দেশনায় অস্থায়ীভাবে তারা সেখানে নির্মাণ সামগ্রী রেখেছেন। তবে স্থানীয়রা জানিয়েছেন, বড় লেনদেনে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে খেলার মাঠটি ব্যবহার করতে দিয়েছেন এমপি জাফর। পুরো মাঠে এখন ইট-বালু ও কংক্রিটের স্তুপ। জিমনেশিয়ামটি থাকার জন্য ব্যবহার করছেন শ্রমিকরা। অভিযোগ রয়েছে, মতের অমিল হলে দলের লোককেও ছাড় দেন না সংসদ সদস্য জাফর আলম।

 

তাঁর কারণে চকরিয়া-পেকুয়ায় আওয়ামী লীগে বিভক্তি। বিগত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নৌকা প্রতীকে ভোটে জয়ী হলেও এখন দলের নিয়মনীতির তোয়াক্কা করেন না তিনি। কক্সবাজার জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সদস্য এস এম গিয়াস উদ্দিন বলেন, ‘গেল ইউপি নির্বাচনে এমপি জাফরের কারণেই নৌকার অধিকাংশ প্রার্থীর পরাজয় হয়েছে। চকরিয়া উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপিত ফজলুল করিম সাঈদীর অভিযোগ, ‘চকরিয়া-পেকুয়ার আওয়ামী লীগের ত্যাগী নেতাকর্মীকে বাদ দিয়ে বিএনপি-জামায়াতের লোকজন নিয়ে নিজস্ব বলয় তৈরি করেছেন এমপি জাফর আলম। তাদের দিয়ে এমন কোনো অপকর্ম নেই, যা তিনি করছেন না।’

 

ফজলুল করিম সাঈদী আরও বলেন, ‘এমপি তাঁর বাহিনী দিয়ে শতকোটি টাকার জমি দখল করেছেন। প্যারাবন কেটে দখল করেছেন প্রায় দুই হাজার একর চিংড়ি চাষের জমি। নদীতে অবৈধভাবে বাঁধ দিয়ে মাছ চাষ করছেন।’ কক্সবাজার জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক সালাহ উদ্দিন আহমেদ সিআইপি বলেন, জাফর আলম এমপি হওয়ার পর চকরিয়া-পেকুয়ার সন্ত্রাসী-অস্ত্রধারী ও ডাকাতদের নিয়ে ‘জাফর লীগ’ গঠন করেছেন। যারা জায়গা দখল, পাহাড় কাটা ও নদী থেকে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন করছে। এত কিছুর পরও ভয়ে কেউ মুখও খুলছে না।

 

 

author avatar
Online Editor SEO
Show More

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button