খেলাধুলা

শান্ত-সাকিব নৈপুণ্যে বিশ্বকাপে দ্বিতীয় জয়ে সপ্তমস্থানে উঠলো বাংলাদেশ

মোহনা অনলাইন

নাজমুল হোসেন শান্ত ও অধিনায়ক সাকিব আল হাসানের ব্যাটিং নৈপুণ্যে ওয়ানডে বিশ্বকাপে দ্বিতীয় জয়ের দেখা পেয়েছে  বাংলাদেশ ক্রিকেট দল। মঙ্গলবার (৭ নভেম্বর) নিজেদের অষ্টম ম্যাচে বাংলাদেশ ৩ উইকেটে হারিয়েছে শ্রীলংকাকে। বিশ্বকাপে এই প্রথম শ্রীলংকাকে হারালো টাইগাররা।

এই জয়ে ৮ ম্যাচে ৪ পয়েন্ট নিয়ে টেবিলের সপ্তমস্থানে উঠলো বাংলাদেশ। এতে ২০২৫ সালে আইসিসি চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে খেলার আশা বেঁচে থাকলো বাংলাদেশের। এই হারে বিশ্বকাপের লিগ পর্ব থেকে বিদায় নিশ্চিত হলো শ্রীলংকার। ৮ ম্যাচে ৪ পয়েন্ট নিয়ে টেবিলের অষ্টমস্থানে আছে লংকানরা।

চারিথ আসালঙ্কার সেঞ্চুরিতে প্রথমে ব্যাট করে ৪৯ দশমিক ৩ ওভারে সব উইকেট হারিয়ে ২৭৯ রান করে শ্রীলংকা। ১০৫ বলে ১০৮ রান করেন আসালঙ্কা। জবাবে শান্তর ৯০ ও সাকিবের ঝড়ো ৮২ রানের সুবাদে ৫৩ বল বাকী রেখে টানা ছয় ম্যাচ হারের পর জয়ের দেখা পায় বাংলাদেশ। ব্যাটিংয়ের আগে বল হাতে ২ উইকেট নেয়ায় ম্যাচ সেরা হন সাকিব।

দিল্লিতে টস জিতে প্রথমে বোলিং করার সিদ্বান্ত নেন বাংলাদেশ অধিনায়ক সাকিব আল হাসান। প্রথম ওভারেই বাংলাদেশকে উইকেট শিকারের আনন্দে ভাসান বাঁ-হাতি পেসার শরিফুল ইসলাম। তবে আনন্দের উপলক্ষ্যটা তৈরি করেন উইকেটরক্ষক মুশফিকুর রহিম। শরিফুলের অফ-স্টাম্পের বাইরের ডেলিভারিতে ব্যাট চালিয়ে উইকেটের পেছনে মুশফিকের চোখ ধাঁধানো ক্যাচে আউট হন  ৪ রান করা ওপেনার কুশল পেরেরা।

শুরুতে উইকেট হারালেও ভড়কে যাননি আরেক ওপেনার পাথুম নিশাঙ্কা ও অধিনায়ক কুশল মেন্ডিস। পাল্টা আক্রমনে বলের সাথে পাল্লা দিয়ে রান তুলতে থাকেন তারা। জুটিতে হাফ-সেঞ্চুরি তুলে উইকেটে জমে যান  নিশাঙ্কা ও মেন্ডিস। এ অবস্থায় ১১তম ওভারে প্রথমবারের আক্রমনে এসেই উইকেট তুলে নেন তানজিম সাকিব। ছক্কা মারতে গিয়ে লং অনে শরিফুলের দারুন ক্যাচে আউট হন ১টি করে চার-ছক্কায় ১৯ রান করা মেন্ডিস। দ্বিতীয় উইকেটে মেন্ডিস ৬৩ বলে ৬১ রান যোগ করেন।

মেন্ডিস ফেরার পরের ওভারে প্যাভিলিয়নের পথ ধরেন নিশাঙ্কাও। ৮টি চারে ৪১ রান করা নিশাঙ্কাকে বোল্ড করেন মুস্তাফিজুর রহমানের পরিবর্তে এবারের বিশ^কাপে প্রথম খেলতে নেমে পেসার তানজিম সাকিব।

৭২ রানে ৩ উইকেট পতনের পর দলের হাল ধরেন সাদিরা সামারাবিক্রমা ও চারিথ আসালঙ্কা। বাংলাদেশের বোলারদের দেখেশুনে খেলে শ্রীলংকার রানের চাকা ঘুড়িয়েছেন তারা। ইনিংসে দ্বিতীয়বারের মত হাফ-সেঞ্চুরির জুটিতে উইকেটে সেট হয়ে যান সামারাবিক্রমা ও আসালঙ্কা। এই জুটি ভাঙ্গতে ঘুড়িয়ে ফিরিয়ে বোলারদের ব্যবহার করেও  বাংলাদেশ যখন সাফল্য পাচ্ছিলো না তখনই  আবারও তানজিম সাকিবের হাত ধরে ব্রেক-থ্রু পায় টাইগাররা।

সাকিবের করা ২৫তম ওভারের দ্বিতীয় ডেলিভারিতে ছক্কা মারতে গিয়ে ডিপ মিড উইকেটে মাহমুদুল্লাহকে ক্যাচ দিয়ে থামেন ৪২ বলে ৪টি চারে ৪১ রান করা সামারাবিক্রমা। আসালঙ্কার সাথে ৬৯ বলে ৬৩ রান যোগ করেছিলেন তিনি।
সামারাবিক্রমার বিদায়ে উইকেটে আসেন অ্যাঞ্জেলো ম্যাথুজ। কিন্তু কোন বল না খেলেই বিশ্বের প্রথম ব্যাটার হিসেবে টাইম আউট হন তিনি। ক্রিজে গিয়ে হেলমেট ঠিক করতে গিয়ে, সেটির ফিতা ছিড়ে যায়। এরপর নতুন হেলমেটের জন্য অপেক্ষা করতে থাকেন ম্যাথুজ। এর মধ্যে নতুন হেলমেট আনলেও, সেটিও ফিরিয়ে দেন তিনি। এরমধ্যে ৩ মিনিটের বেশি সময় অতিবাহিত হলে ম্যাথুজের বিপক্ষে টাইম আউটের আবেদন করে বাংলাদেশ। তাতে সাড়া দেন অন-ফিল্ড আম্পায়ার দক্ষিণ আফ্রিকার মারাইস এরাসমাস। বিশ্বকাপের প্লেয়িং কন্ডিশনে, কোন ব্যাটার আউটের পর নতুন বাটারের ২ মিনিটের মধ্যে বল মোকাবেলা করতে হবে।  সেটা করতে ব্যর্থ হওয়ায়  ফিরে যেতে হয় ম্যাথুজকে।

দলীয় ১৩৫ রানে পঞ্চম ব্যাটার হিসেবে ম্যাথুজ ফেরার পর ক্রিজে আসালঙ্কার সঙ্গী হন ধনাঞ্জয়া ডি সিলভা। দলকে লড়াইয়ে ফেরাতে দেখেশুনে খেলতে থাকেন তারা। এই জুটিতে ওয়ানডেতে ১১তম হাফ-সেঞ্চুরি করেন আসালঙ্কা। ৩৭তম ওভারে শ্রীলংকার রান ২শ স্পর্শ করে। পরের ওভারে মিরাজের বলে স্টাম্পড আউট হন ৪টি চার ও ১টি ছক্কায় ৩৬ বলে ৩৪ রান করা ডি সিলভা। ষষ্ঠ উইকেটে ৮২ বলে ৭৮ রান যোগ করে দলের রান ২১৩তে নেন ডি সিলভা- ধনাঞ্জয়া।

এরপর মহেশ থিকশানার সাথে ৪৮ বলে ৪৫ রান তুলে দলের রান আড়াইশ পার করেন আসালঙ্কা। থিকশানা ২২ রানে থামলেও ৪৮তম ওভারে ওয়ানডেতে দ্বিতীয় সেঞ্চুরি পূর্ণ করেন ১০১ বল খেলা আসালঙ্কা।

সেঞ্চুরির পূর্ন করার পর  ৪৯তম ওভারে তানজিমের বলে লিটন দাসকে ক্যাচ দিয়ে আউট হওয়ার আগে  ৬টি চার ও ৫টি ছক্কায় ১০৫ বলে ১০৮ রান করেন আসালঙ্কা।

অষ্টম ব্যাটার হিসেবে আসালঙ্কা ফেরার পর ৩ বল বাকী থাকতে ২৭৯ রানে অলআউট হয় শ্রীলংকা। বাংলাদেশের তানজিম সাকিব  ১০ ওভারে ৮০ রানে ৩ উইকেট নেন। ২টি করে উইকেট নেন শরিফুল ও সাকিব এবং ১ উইকেট নেন মিরাজ।
নিজেদের ইনংসে শ্রীলংকান ব্যাটারা  ৭টি ছক্কা হাকান। এতে বিশ্বকাপ ইতিহাসে এক আসরে সর্বোচ্চ ছক্কার রেকর্ড হয়। ২০১৫ আসরের  সর্বোচ্চ ৪৬৩ ছক্কাকে টপকে গেছে এবারের বিশ্বকাপ।

২৮০ রানের জবাবে ভালো শুরুর ইঙ্গিত দিয়ে তৃতীয় ওভারেই বিচ্ছিন্ন হয় বাংলাদেশের উদ্বোধনী জুটি। পেসার দিলশান মাদুশঙ্কার বলে উড়িয়ে মারতে গিয়ে কভারে নিশাঙ্কাকে ক্যাচ দেন ২টি চারে ৫ বলে ৯ রান করা তানজিদ হাসান।
তানজিদের ফেরার ওভারেই ফাইন লেগে পেরেরাকে ক্যাচ দিয়ে বেঁচে যান ওপেনার লিটন দাস। জীবন পেয়েও সেটি কাজে লাগাতে পারেননি তিনি। সপ্তম ওভারে মাদুশঙ্কার দারুন এক ডেলিভারিতে লেগ বিফোর আউট হন লিটন। রিভিউ না নিলে ২২ বলে ২টি করে চার-ছক্কায় ২৩ রানে আউট হন লিটন।

৪১ রানে ২ উইকেট পতনে চাপে পড়ে বাংলাদেশ। এ অবস্থায় দলের হাল ধরেন নাজমুল হোসেন শান্ত ও সাকিব। উইকেটে দ্রুত সেট হয়ে রানের চাকা সচল করেন তারা। ১৮তম ওভারে ১শ পায় বাংলাদেশ। ৫৮ বল খেলে ওয়ানডেতে সপ্তম হাফ-সেঞ্চুরি পূর্ন  শান্ত। ২৩তম ওভারে এবারের আসরে  বাংলাদেশের পক্ষে শতরানের জুটি গড়েন শান্ত ও সাকিব। ৪৭ বলে ওয়ানডে ক্যারিয়ারে  ৫৬তম হাফ-সেঞ্চুরির দেখা পান সাকিব। বিশ^কাপে এই নিয়ে ত্রয়োদশবার  ৫০ রানের বেশি ইনিংস খেলে তালিকার তৃতীয়স্থানে উঠে এলেন সাকিব।

৩০তম ওভারে দলের রান ২শ পার করে বিচ্ছিন্ন হন শান্ত ও সাকিব। ৩২তম ওভারে ম্যাথুজের বলে আসালঙ্কাকে ক্যাচ দিয়ে ফিরেন ১২টি চার ও ২টি ছক্কায় ৮২ রান করা সাকিব। শান্তর সাথে তৃতীয় উইকেটে ১৪৯ বলে ১৬৯ রান যোগ করেন দলের জয়ের পথ তৈরি করেন টাইগার অধিনায়ক। এ নিয়ে বিশ^কাপে দ্বিতীয়বারের মত অন্তত দেড়শ রানের জুটি গড়লো টাইগাররা।

দলীয় ২১০ রানে সাকিব ফেরার পর কিছুক্ষণ পর ম্যাথুজের দ্বিতীয় শিকার হন শান্ত। ১২টি চারে ১০১ বলে ৯০ রান করেন শান্ত।

১ রানের ব্যবধানে সাকিব-শান্তর বিদায়ের পর বাংলাদেশকে দ্রুত জয়ের বন্দরে নেয়ার পথে হাঁটতে থাকেন মাহমুদুল্লাহ ও মুশফিকুর। ২৬ বলে ৩৮ রান তুলে আড়াইশ কাছে নেন তারা। কিন্তু ৬ রানের ব্যবধানে প্যাভিলিয়নে ফিরেন দু’জনেই। মুশফফিককে ১০ রানে মাদুশঙ্কা ও মাহমুদুল্লাহকে ২২ রানে বোল্ড করেন থিকশানা। এ সময় জয় থেকে ২৫ রান দূরে  বাংলাদেশ।

সপ্তম উইকেটে তাওহিদ হৃদয়ের সাথে ১০ বলে ১৪ রান তুলে আউট হন মিরাজ(৩)। এরপর অবিচ্ছিন্ন ১৩ রান তুলে বাংলাদেশের জয় নিশ্চিত করেন হৃদয় ও তানজিম। ২টি ছক্কায় হৃদয় ৭ বলে অপরাজিত ১৫ ও ২টি চারে তানজিম ৯ রাানে অপরাজিত থাকেন। শ্রীলংকার মাদুশঙ্কা ৬৯ রানে ৩ উইকেট নেন।

আগামী ১১ নভেম্বর পুনেতে বিশ^কাপে নিজেদের নবম ও শেষ ম্যাচে অস্ট্রেলিয়ার মুখোমুখি হবে বাংলাদেশ।

স্কোর কার্ড : (টস-বাংলাদেশ)
শ্রীলংকা ইনিংস :
নিশাঙ্কা ব তানজিম ৪১
পেরেরা ক মুশফিক ব শরিফুল ৪
মেন্ডিস ক শরিফুর ব সাকিব ১৯
সামারাবিক্রমা ক মাহমুদুল্লাহ ব সাকিব ৪১
আসালঙ্কা ক লিটন ব তানজিম ১০৮
ম্যাথুজ টাইমড আউট ০
ধনাঞ্জয়া স্টাম্প মুশফিকুর ব মিরাজ ৩৪
থিকশানা ক নাসুম ব শরিফুল ২১
চামিরা রান আউট (মুশফিকুর) ৪
রাজিথা ক লিটন ব তানজিম ০
মাদুশঙ্কা অপরাজিত ০
অতিরিক্ত (লে বা-৩, ও-৪) ৭
মোট (অলআউট, ৪৯.৩ ওভার) ২৭৯
উইকেট পতন : ১/৫ (পেরেরা), ২/৬৬ (মেন্ডিস), ৩/৭২ (নিশাঙ্কা), ৪/১৩৫ (সামারাবিক্রমা), ৫/১৩৫ (ম্যাথুজ), ৬/২১৩ (ধনাঞ্জয়া), ৭/২৫৮ (থিকশানা), ৮/২৭৮ (আসালঙ্কা), ৯/২৭৮ (রাজিথা), ১০/২৭৯ (চামিরা)।

বাংলাদেশ বোলিং :
শরিফুল : ৯.৩-০-৫১-২ (ও-১),
তাসকিন : ১০-১-৩৯-০ (ও-১),
তানজিম : ১০-০-৮০-৩ (ও-২),
সাকিব : ১০-০-৫৭-২,
মিরাজ : ১০-০-৪৯-১।

বাংলাদেশ ইনিংস :
তানজিদ ক নিশাঙ্কা ব মাদুশঙ্কা ৯
লিটন এলবিডব্লু ব মাদুশঙ্কা ২৩
নাজমুল বোল্ড ব ম্যাথুজ ৯০
সাকিব ক আসালঙ্কা ব ম্যাথুজ ৮২
মাহমুদুল্লাহ ব থিকশানা ২২
মুশফিক ব মাদুশঙ্কা ১০
হৃদয় অপরাজিত ১৫
মিরাজ ক আসালঙ্কা ব থিকশানা ৩
তানজিম অপরাজিত ২
অতিরিক্ত (লে বা-৯, ও-১০) ১৯
মোট (৭ উইকেট, ৪১.১ ওভার) ২৮২
উইকেট পতন : ১/১৭ (তানজিদ), ২/৪১ (লিটন), ৩/২১০ (সাকিব), ৪/২১১ (শান্ত), ৫/২৪৯ (মুশফিক), ৬/২৫৫ (মাহমুদুল্লাহ), ৭/২৬৯ (মিরাজ)।

শ্রীলংকা বোলিং :
মাদুশঙ্কা : ১০-১-৬৯-৩ (ও-৪),
থিকশানা : ৯-০-৪৪-২ (ও-৩),
রাজিথা : ৪-০-৪৭-০,
চামিরা : ৮-০-৫৪-০ (ও-২),
ম্যাথুজ : ৭.১-১-৩৫-২ (ও-১),
ধনাঞ্জয়া : ৩-০-২০-০,

ফল : বাংলাদেশ ৩ উইকেটে জয়ী।
ম্যাচ সেরা: সাকিব আল হাসান (বাংলাদেশ)।

author avatar
Delowar Hossain Litu
Show More

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button