টিকেট না পেয়ে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে কান্নায় ভেঙে পড়েছেন হাজার হাজার মালয়েশিয়াগামী যাত্রী। ভিসা ও ছাড়পত্র থাকলেও উড়োজাহাজের টিকিট সংকটের কারণে স্বপ্নভঙ্গ হলো প্রায় ৩০ হাজার বাংলাদেশি কর্মীর।
তিন দিন ধরে বিমানবন্দরে অপেক্ষা করা এক যাত্রী জানান, ধারকর্জ করে গ্রিন লাইন এজেন্সি নামের একটি রিক্রুটিং কোম্পানির হাতে তিনি ৬ লাখ ৪০ হাজার টাকা তুলে দিয়েছেন। সব ঠিকঠাকই ছিল। শর্ত অনুসারে ওই কোম্পানি তাকে মালয়েশিয়া যাওয়ার বিমানের টিকিট দেবে। কিন্তু তিন দিন ধরে অপেক্ষায়ও মেলেনি টিকিট। এখন অনিশ্চিত তার মালয়েশিয়ায় যাওয়া। কারণ মালয়েশিয়া সরকারের ঘোষণা, গতকাল শুক্রবার থেকেই বন্ধ হয়েছে দেশটির শ্রমবাজার।
বিমানবন্দরে তার মতো হাজার হাজার এমন শ্রমিকের দেখা মেলে। যারা এখন অনিশ্চিত ভবিষ্যতের মধ্যে পড়েছেন। রিক্রুটিং এজেন্সির কাছে তারা ৬ লাখ থেকে ৮ লাখ টাকা পর্যন্ত জমা দিয়েছিলেন। সেই এজেন্সিগুলোই এখন লাপাত্তা। মূলত সিন্ডিকেটের কারণে এখন পর্যন্ত ৩০ হাজার বৈধ শ্রমিক মালয়েশিয়ায় যেতে পারেননি।
বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের ব্যবস্থাপক (জনসংযোগ) মো. আল মাসুদ খান বলেন, প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে শুক্রবার সন্ধ্যা ৭টা ১৫ মিনিটে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের ঢাকা-কুয়ালালামপুর রুটের বিশেষ অতিরিক্ত ফ্লাইটে ২৭১ জন যাত্রী পরিবহন করা হয়। ভিসা হওয়ার পর কর্মী ভিসায় মালয়েশিয়া যেতে বাংলাদেশ জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো (বিএমইটি) থেকে ছাড়পত্র নিতে হয়। সিদ্ধান্ত ছিল ২১ মের পর বিএমইটি আর কোনো ছাড়পত্র দেবে না। তবে গত বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা পর্যন্ত ছাড়পত্র দেয় বিএমইটি। ২১ মে থেকে ৩০ মে পর্যন্ত ১ হাজার ১১২ জনকে ছাড়পত্র দেওয়া হয়েছে।
বাংলাদেশ জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) তথ্য বলছে, গত ২১ মে পর্যন্ত প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয় ৫ লাখ ২৩ হাজার ৮৩৪ জন কর্মীকে মালয়েশিয়া যাওয়ার অনুমোদন দেয়। ২১ মের পর আর অনুমোদন দেওয়ার কথা না থাকলেও বিএমইটি বলছে, মন্ত্রণালয় আরও ১ হাজার ১১২ জন কর্মীকে দেশটিতে যাওয়ার অনুমোদন দিয়েছে। অর্থাৎ, বৃহস্পতিবার পর্যন্ত ৫ লাখ ২৪ হাজার ৯৪৬ জন কর্মীকে মালয়েশিয়া যাওয়ার অনুমোদন দেওয়া হয়। এর মধ্যে বৃহস্পতিবার পর্যন্ত দেশটিতে গেছেন ৪ লাখ ৯১ হাজার ৭৪৫ জন কর্মী। সর্বশেষ গতকাল আরও ১ হাজার ৫০০ জন কর্মী মালয়েশিয়ায় গেছেন।
সব মিলিয়ে ভিসা ও অনুমোদন পাওয়ার পরও ৩০ হাজারের বেশি কর্মী যেতে পারছেন না। এর মধ্যে গতকাল সন্ধ্যায় একটি বিশেষ ফ্লাইট পরিচালনা করেছে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স। সন্ধ্যা ৭টা ১৫ মিনিটে বিমানের ঢাকা-কুয়ালালামপুর রুটে একটি বিশেষ অতিরিক্ত ফ্লাইটে মোট ২৭১ জন যাত্রী পরিবহন করা হয়।
তারপরও এখন পর্যন্ত বিরাট সংখ্যার শ্রমিকের মালয়েশিয়া যাত্রা অনিশ্চিত। অথচ এদের বৈধ ভিসা, ওয়ার্ক পারমিট রয়েছে। এসব শ্রমিক কয়েকদিন ধরেই ভিড় জমাচ্ছেন বিভিন্ন এজেন্সির সামনে। নানাভাবে চেষ্টা করেও টিকিট মিলছে না।
এদিকে, নয়াপল্টনে বিভিন্ন এজেন্সির সামনে শত শত লোক রাত থেকে অপেক্ষা করছেন মালয়েশিয়া যাওয়ার টিকিটের জন্য। আর আই ব্রাদার্স, আদিব এয়ার ট্রাভেলস, এজেড ইন্টারন্যাশনাল, মম অ্যান্ড মম ট্যুর অ্যান্ড ট্রাভেলসসহ বেশ কয়েকটি এজেন্সিতে গিয়ে তাদের অফিস বন্ধ পাওয়া গেছে। এসব এজেন্সি যাত্রীদের কাছ থেকে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে অফিস বন্ধ করে বসে আছে। একটি সূত্রে জানা যায়, বিভিন্ন এজেন্সির মালিকরা সিন্ডিকেট করে ভুয়া কাগজপত্র দেখিয়ে ৫ থেকে ৬ লাখ করে টাকা নিয়েছে। অথচ এখন টিকিট দিতে পারছে না।
অন্যদিকে পাসপোর্ট, মালয়েশিয়ার ভিসা, ওয়ার্ক পারমিটসহ ঢাকার নয়াপল্টনে অনেকেই ঘুরতে দেখা গেছে। তারা টিকিট পাচ্ছেন না। অথচ রিক্রুটিং এজেন্সিকে কেউ কেউ টাকা দিয়েছিলেন ৬ লাখ ৭০ হাজার বা তার কমবেশি। শর্ত ছিল বিমানের টিকিটের ব্যবস্থা করবে ওই কোম্পানি। কিন্তু দুদিন ধরে কোম্পানি সংশ্লিষ্ট সবার মোবাইল নম্বরই বন্ধ।
তাদের মধ্যে এক ভুক্তভোগী বলেন, গতকাল রাত থেকে অপেক্ষা করছি মালয়েশিয়ায় যাওয়ার জন্য। মিথ্যা কথা বলে আমার মতো দুইশ জন লোককে বসিয়ে রেখেছে। এখন পর্যন্ত কোনো খবর পাওয়া যাচ্ছে না। সহায়-সম্পত্তি বিক্রি করে টাকা দিয়ে অসহায়ের মতো পথে বসে আছি। এখন কী হবে বলতে পারছি না।’
সিলেটে থেকে আসা বুলবুল আহমদ বলেন, ‘আমরা পাঁচজন যাত্রী ৫ লাখ টাকা করে দিয়েছি। এখন বিদেশে যাওয়া অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। আত্মহত্যা করা ছাড়া কিছু করার থাকবে না।’
এদিকে, বায়রা মহাসচিব আলি হায়দার জানান, শেষ সময়ে ২৫ হাজারের মতো যাত্রী রয়েছে, তাদের বিশেষ বিমানের মাধ্যমে মালয়েশিয়া যাওয়ার ব্যবস্থা করা হচ্ছে। তিনি বলেন, কালো তালিকাভুক্ত কোম্পানি ক্যাটাগরিতে ২০ হাজার শ্রমিক রয়েছেন। তাদের বাদ দিয়ে যে শ্রমিক রয়েছেন তাদের সবার মালয়েশিয়ায় যাওয়ার টিকিটের ব্যাপারে চেষ্টা চলছে।
বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটনমন্ত্রী মুহাম্মদ ফারুক খান মালয়েশিয়ার যাত্রীদের জন্য বিমান ভাড়া নিয়ে গণমাধ্যমে বলেন, ‘বিমান ভাড়ার বিষয়টা সরবরাহ ও চাহিদার ব্যাপার। যারা মালয়েশিয়ায় শ্রমিক পাঠানোর সঙ্গে জড়িত, তারা এক মাস আগেই জানত যে, ৩১ মে শ্রমিক পাঠানোর শেষ তারিখ। কিন্তু এটা নিয়ে রিক্রুটিং এজেন্সি বা অন্য সাপ্লায়াররা ব্যবস্থা নেয়নি। এখন বাংলাদেশ বিমান প্রতিদিন মালয়েশিয়ায় তিন থেকে চারটি করে ফ্লাইট পরিচালনা করছে।’
বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটনমন্ত্রী ফারুক খান গতকাল বলেন, বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনস মালয়েশিয়ায় কর্মী প্রবেশের বাধ্যবাধকতার বিষয়টি আরও আগে জানলে আগেভাগেই ব্যবস্থা নিতে পারত। বর্তমানে বিমানের হজ ফ্লাইট চলছে। তারপরও প্রবাসীদের কুয়ালালামপুর নেওয়ার ব্যবস্থা করার চেষ্টা করা হয়েছে।
বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম শ্রমবাজার মালয়েশিয়া। দেশটিতে বর্তমানে প্রায় ১৫ লাখ বাংলাদেশি কর্মী আছেন। গত বছর সেখানে গেছেন ৩ লাখ ৫১ হাজার ৬৮৩ জন কর্মী। এ বছরের এপ্রিল পর্যন্ত গেছেন ৪৪ হাজার ৭২৭ জন। চার বছর পর ২০২২ সালে দেশটির শ্রমবাজার খুলেছিল। মালয়েশিয়া সরকার গত মার্চেই ঘোষণা করে, ৩১ মের (গতকাল) পর আর কোনো নতুন বিদেশি শ্রমিক দেশটিতে ঢুকতে পারবেন না। সে হিসাবে আজ থেকে আবার অনির্দিষ্ট সময়ের জন্য বন্ধ হলো এই শ্রমবাজার।
হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর সূত্রে জানা গেছে, গতকাল ঢাকা থেকে সরাসরি কুয়ালালামপুর নিয়মিত ৯টি ফ্লাইট যায়। পাশাপাশি সন্ধ্যা ৭টা ১৫ মিনিটে ঢাকা-কুয়ালালামপুর পথে বিশেষ ফ্লাইট পরিচালনা করে বিমান বাংলাদেশ। সব ফ্লাইট মিলিয়ে গতকাল দেড় হাজার কর্মী মালয়েশিয়ায় যেতে পেরেছেন।
গতকাল শেষ দিনে সকাল থেকে রিক্রুটিং এজেন্সির আশ্বাসে উড়োজাহাজের টিকিট ছাড়াই বিমানবন্দরে ছিলেন হাজারো মালয়েশিয়াগামী। তাদের কেউ কেউ দুই-তিন দিন ধরে বিমানবন্দরে অবস্থান করছিলেন।