শাহীন রাজা : আমার ঘরে ভাত না থাকলে, কেন আপনার জন্য চাষ করবো ? এই ক্ষোভ দিনু শেখের। দিনু শেখ এক প্রান্তিক কৃষক। যে পেশা কোন স্বীকৃত পেশা নয়। অথচ এই প্রান্তিক কৃষকেরা আমাদের আহার যোগান দিন দিনান্ত পরিশ্রম করে !
দিনু শেখ জন্মসূত্রে একখন্ড জমি পেয়েছে। এই জমি চাষ করে যে ফসল আসে তা দিয়ে সংসারের ব্যয় মেটাতে পারে না। তাই অন্যের জমিও চাষ করতে হয়। কিংবা আরেকজনের জমিতে দিনমজুর-ও দিতে হয়।
দীনু শেখ চাষ করে যে ফসল পায়, কিছুটা রেখে বাকী সবটাই বিক্রি দেয়। ঘরে ফসল রেখে সময় নিয়ে বিক্রি করার কোন সুযোগ নেই। কেননা দীনু শেখের ঘরটা এতোটাই ছোট যে বাড়তি কিছু রাখা সম্ভব নয়। তাই নিজ এবং অন্যের জমি চাষ করে পাওয়া ধান মহাজন বা মিল মালিকের কাছে কাছে বেঁচে দেয়।
মিল মালিকেরা অনেক সময় ফরিয়ার মাধ্যমে ধান কিনে। দীনু শেখ ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ধান বেচার সময় সবাই তাঁকে ঠকায়। ঠকানোর ক্ষেত্রে মহাজন, মিল মালিক বা ফরিয়া ঠকানোর ক্ষেত্রে সবাই এক ! আবহমান কাল থেকে এমনটাই হয়ে আসছে বলে অভিযোগ করেন।
সরকার যে দাম বেঁধে দেয় তা থেকে অনেক কম ধান বেঁচতে হয়। কম দামে বিক্রি করতে একরকম বাধ্যই করে ! আবার ওজনে নেয়ার সময় প্রতি পাল্লায় বেশী ধান নেয়। এই অসম বেচাকেনায় দীনু শেখকে বরাবরই মতোই নীরবে থাকতে হয় । সে জানে, প্রতিবা বা মন খারাপ করার কোন সুযোগ নেই। এ নিয়ে উচ্চবাচ্য করলে ধানই বিক্রি করা যাবে না। ধান উৎপাদনে ব্যয় এবং পরিশ্রম সবটাই পণ্ড হবে।
দীনু শেখ ক্ষোভ নিয়ে জানান, নিত্য প্রয়োজনীয় ভোগ্য পণ্য কেনার সময়ও তাঁকেই বাড়তি মাশুল গুনতে হয়। কেনার সময় খুচরা বিক্রেতা’র, খুচরা চালাকি তাঁকে মুখ বুঁজে নিতে হচ্ছে। দোকানিরা সবসময় ওজন কম দিয়ে ঠকায়। এখানে-ও দীনু শেখদের নীরব থাকতে হয় এব অসহায়। অভাবের কারণে বছরের বড় সময় বাকীতেই কেনাকাটা করতে হয়।
দীনু শেখদের অভাবকে পুজি করে দেশে অনেকেই বানিজ্য চালিয়ে যাচ্ছে। এর মধ্যে আছেন অনেক গবেষক, ডঃ দীনের আলো, রাতের তাঁরা, সাবেক খাজাঞ্চিদার, জামায় ফিতা বান্ধা গবেষক এবং রাজনীতিক। সাথে আছে দেশী ও বিদেশী অনেক সংগঠন। কৃষকের ভাগ্য উন্নয়নে সর্বক্ষণই তাঁরা ব্যস্ত। দরিদ্র কৃষকদের জন্য কাজ করতে, করতে ঘুমানোর সময় পায় না তাঁরা ।
শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত শীতল কক্ষে বসে হিসাব কষেন। সামনের মৌসুমে ধান উৎপাদন হবে কত টন ! অথচ বাংলাদেশে কত নামের ধান চাষ হয়, এই বাটপারেরা বলতেও পারবে না। কোন ঋতুতে কোন ফসল, তাও বলতে পারবে কি না সন্দেহ আছে ?
এই বিশেষজ্ঞরা কৃষি আর কৃষকের কান্না বেঁচে, অর্থ-বিত্ত সবটাই পকেটে তুলে নিয়েছে। কৃষক এবং কৃষিকে পুঁজি করে, বিদেশ থেকে আসা কড়কড়ে ডলারে নাক ডুবিয়ে সুখের ঘ্রাণে সুরভিত তারা। এবং এ-ই সমাজে সৌরভে সুবাসিত।
প্রকৃতির সাথে যুদ্ধ করে কিভাবে ফসল ঘরে তুলতে হবে এটা তাঁকেই ভাবতে হয়। বর্ষায় প্রয়োজনের তুলনায় বেশী জল ঢুকে গেলে, ফসলকে কিভাবে আগলাতে হবে। আর শুকনো মৌসুমে, বৃষ্টির জলের জন্য যখন দীনু শেখ উন্মুখ। অথচ আকাশ জল ভরা মেঘ নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। কেন বৃষ্টি হয়ে তাঁর জমিতে নেমে আসে না ! আকাশ এবং প্রকৃতির প্রতি অভিমানে দীনু শেখের হৃদয়ে কালো মেঘ এসে ভীড় জমায় ! কপালে উৎকণ্ঠার চীকন উষ্ণ প্রসবন। চুইয়ে, চুইয়ে ধানের শীষে। ফোঁটায়, ফোঁটায় বেদনার জল।
অতি বর্ষণে-ও বেদনায় আহত। অতিরিক্ত জল, মাঠের সকল ফসলের সাথে সুখ স্বাচ্ছন্দ্য-ও ভাসিয়ে নিয়ে যায়। আবারও আরেকটি বছর গোটা পরিবার খাবারের কষ্টে কাটাবে সময় !
প্রকৃতির বৈরীতার সাথে যুদ্ধ করতে, করতে দীনু শেখ একজন অভিজ্ঞ কৃষি বিজ্ঞানী হয়ে উঠেছেন। অনা বৃষ্টি বা অতিরিক্ত বর্ষণ এখন আর তেমন পাত্তা দেয় না। সে বুঝে গেছে প্রকৃতি এমনটাই। ব্যবস্থাপনা বা পরিকল্পনা করে চলতে হবে।
কৃষি ব্যবস্থাপনার সবটাই এখন, দীনু শেখের হাতের মুঠোয়।
দীনু শেখের ব্যাংক, এনজিও এমনকি সরকারের কাছেও তেমন চাওয়া নাই। তাঁর একটাই চাওয়া, কষ্টের উৎপাদিত ফসলের সঠিক মূল্য যেন পায়? সরকার পরিচালিত নির্দিষ্ট স্থানে ফসল বিক্রির সুবিধা চায়। এবং নির্দিষ্ট ওজন ও দামে। নির্দিষ্ট স্থানে বড় করে মূল্য তালিকা ঝোলানো থাকবে। এবং ওজন মাপার যন্ত্রে নির্দিষ্ট ওজনের ফসল ওঠার পর, কম্পিউটারের মধ্য দিয়ে মূল্য রশীদের কাগজ বের হয়ে আসবে।
সবশেষে দীনু শেখ বলেন, কৃষকের পেটে খাবার না থাকলে আপনার পেটে-ও ভাত যাবে না। আমি খেতে পারলে না পারলে, আপনার জন্য আমি কেন চাষ করবো !
পুনঃ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কয়েক বছর সেই সময়কার যুগোস্লাভিয়া’র প্রেসিডেন্ট মার্শাল টিটো আলবেনিয়ায় সফরে গেছেন। মার্শাল টিটো আলবেনিয়ার প্রেসিডেন্ট আনয়ার হোজা’কে একটা প্রস্তাব রাখেন। প্রস্তাবটা হচ্ছে, আলবেনিয়া ফুল ও ফল উৎপাদনের খুবই উপযোগী। আলবেনিয়া যেন এগুলো উৎপাদন করে। আনোয়ার হোজা জানতে চান, উৎপাদিত ফুল ও ফলকে কিনবে। মার্শাল টিটো সঙ্গে সঙ্গে বলেন, কেনো আমরা। এরপর আনোয়ার হোজা চুপ করে থাকেন। এবং পরবর্তীতে সিদ্ধান্ত নেন, খাদ্যশস্য উৎপাদনের বাইরে আর কিছুই চাষ করা হবে না। তিনি উল্লেখ করেছেন, ফুলফল উৎপাদন করে পরবর্তীতে তিনগুন মূল্যে যুগোস্লাভিয়া থেকে খাদ্যশস্য আমদানি করার জন্যই এই প্রস্তাব।
তাই দীনু শেখদের জন্য আমাদের বাস্তবমুখী পরিকল্পনা নিতে হবে। তা না হলে প্রান্তিক কৃষকেরা পেটের তাগিদে ভিন্ন পেশা বেছে নিতে পারে। তাহলে ১৮ কোটি মানুষের দেশে খাদ্য নিরাপত্তা কেমনে নিশ্চিত হবে ?
লেখক: শাহীন রাজা, হেড অব এডিটোরিয়াল, মোহনা টেলিভিশন।