
মুখ ও মুখোশ, বাংলাদেশের প্রথম স্ববাক চলচ্চিত্র। চলচিত্রকার সেই সময়-ই বুঝতে পেরেছিলেন, মুখোশের আড়ালে আরেক মানুষ ! তখন হয়-তো সমাজের কিছু মানুষ এমনটা ছিল। যা চলচ্চিত্র নির্মাতার মনে দাগ কাটে। এবং এই নামে চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন। যা আমাদের চলচ্চিত্র ইতিহাসে প্রথম স্ববাক ছবি।
কালের বিবর্তনে মানুষ আরও আত্মকেন্দ্রীক এবং যন্ত্রনির্ভর হয়ে উঠেছে। আগে হয়-তো কিছু মানুষ মুখোশের আবরণে নিজেকে আড়াল করে রাখতেন। এখন বিশাল জনগোষ্ঠী, মুখোশের আড়ালে ! মানুষের সবটাই এখন মুখোশের আড়ালে চলে গেছে।
বিশ্বাস এবং অবিশ্বাসের দোলাচলে সামাজিক এবং রাজনৈতিক সম্পর্ক। কারো কথা কেউ আজকাল আর বিশ্বাস করে না। কেউ কিছু বললে ধরেই নেয়, সঠিক বলছে না। কিংবা এর পেছনে ভিন্ন কোন উদ্দেশ্য রয়েছে। যারা এ-ই দেশ এবং সমাজকে এগিয়ে নেয়ার দায়িত্ব পেয়েছিলেন তারাই বিশ্বাস ভঙ্গে অগ্রগামী। বিশ্বাসের সাথে প্রবঞ্চনা করেছে !
রাজনীতিক, শিক্ষক, প্রশাসক, আইনজীবী, চিকিৎসক, বিজ্ঞানী এবং সাংবাদিক সবাই মুখোশের আড়ালে ! বিবর্তনের ইতিবাচক দিক-ও আছে। তা হলো, মানুষ জেনে গেছে এইসব লোকেরা সঠিক কথা বলে না। বা তাঁদের উপর যে দায়িত্ব জনগণ অর্পণ করেছে, তা তাঁরা পালন করেন না। তাই তাঁদের কোন কথাতেই আর বিশ্বাস নেই।
রাজনীতিকদের কথা আজকাল সাধারণ জনগণ অনেকটাই বিশ্বাস করে না। জনসাধারণ মনে করেন, এদের ক্ষমতার বাইরে থাকাকালীন এক কথা। ক্ষমতায় আসীন হলে একদম উল্টোপথে। যার ফলে নির্বাচনে ভোটারদের উপস্থিতি দিনে,দিনে ক্রমশই হ্রাস পাচ্ছে।
প্রশাসনে আরেক চিত্র। যারা জনগণকে সেবা দানের নিশ্চয়তা দিয়ে এই পেশায় এসেছে, তারাই সবথেকে বেশি জন-বিরোধী। সাধারণ মানুষ বিপদে পড়লে এবং উত্তরণের উপায়ন্তর না থাকলে তখনই এদের কাছে যায়। প্রশাসনের লোকেরা সমস্যা পীড়িত লোকদের সাথে প্রভুসূলভ আচরণ করে থাকে। তা-ই মানুষ না পারলে তাদের দ্বারস্থ হয়।
আজকাল সাধারণ আয়ের মানুষ আর চিকিৎসকের কাছে যেতে চায় না। চিকিৎসা ব্যয় এতোটাই যে বিশেষ করে পরীক্ষা-নীরিক্ষা ব্যয়। যা সাধারণ আয়ের লোকদের পক্ষে সম্ভব নয়। সাধারণ আয়ের লোকেরা মনে করেন, চিকিৎসকগণ রোগীদের রোগী ভাবে না। মনে করে ক্লায়েন্ট। যার কাছ থেকে যেভাবে অর্থ আদায় করা যায়।
আইনজীবী এবং সাংবাদিকরাও সঠিকভাবে পেশা পালন করছে না। তাই তাদের প্রতি জনগণের আস্থা ক্রমশই নিম্নগামী। বাদী বা আসামী পক্ষ মনে করেন, আইনজীবী কাজটি সঠিকভাবে করছেন না। মামলার রায় পক্ষে আনার থেকে নিজে কতটা আর্থিক সুবিধা পাবেন সেইদিকে নজর বেশী। এদিকে সাংবাদিকদের উপরও পাঠক বা দর্শক বিরক্ত। মানুষ মনে করছে, সাংবাদিকেরা সঠিক সংবাদ পরিবেশন করছে না।
সাধারণ আয়ের মানুষে মনে করে, সবাই ম্যাজিক ওয়ালার মতোই। ম্যাজিক দেখানোর নামে ওষুধ বিক্রিই মূল লক্ষ্য। সাধারণ আয়ের মানুষ এদের সার্কাস দলের লোক মনে করে। যার কোন বাস্তব ভিত্তি নাই কিন্তু সাময়িক আনন্দ দেয়া আর কি।
সাধারণ মানুষ বিপ্লব বুঝে না। বুঝে না গণঅভ্যুত্থান। তাঁরা বর্তমান বৃত্ত থেকে মুক্তির সজীব বাতাস আর কোমল আলোয় উষ্ণ হতে চায়। তারা চায়, কোন পর্বতমালা বা সমুদ্র ঢেউয়ের চুড়ায় চড়ে আসুক কোন বীর। যার নেতৃত্বে মুখোশ খুলে মানুষেরা বেড়িয়ে আসবে।
এ প্রসঙ্গে একটা উপকথার উদহারন দিচ্ছি – ” বহু বছর আগে বাথানে ( খামার ঘর) মোষ নিয়ে যাচ্ছে রাখাল। সন্ধ্যে হয়ে গেছে। বাথানে যেতে রাত বনের গাছ চুইয়ে, চুইয়ে নেমে আসে। এমন এক অন্ধকারে মোষদের নেতা থেমে যায়। তার সাথে দলের সব মোষ থমকে দাঁড়ায়। রাখাল নেতা মোষকে জিজ্ঞেস করে, থেমে গেলে যে। নেতা জানায়, তাদের একজন পিছিয়ে আছে তাকে না নিয়ে যাবে না। কিছুক্ষণ পর পিছিয়ে থাকা মোষটা কাছে আসতেই রাখাল জিজ্ঞেস করে, কি ব্যাপার তুমি পিছিয়ে গেলে যে ? মোষ জবাব দেয়, আমি মা ! সন্তান আমার ছোট। তাকে তো ফেলে একা চলে আসতে পারি না। এরপর সবাই বাথানে প্রবেশ করে। “
বাংলাদেশের মানুষ-ও এমন দৃঢ় চিত্তের নেতা খুঁজছে। দৃঢ়তার পাশাপাশি দেশের মানুষের জন্য ভালোবাসা-ও থাকবে অসীম।