কোচিংয়ের প্রশ্নে নাটোর সরকারি বালক উচ্চ বিদ্যালয়ের নির্বাচনি পরীক্ষা নিয়ে তোলপাড়
নাটোর প্রতিনিধি
নাটোরে একটি কোচিংয়ের প্রশ্নে সরকারি বালক উচ্চ বিদ্যালয়ের নির্বাচনী পরীক্ষা হয়েছে। বিদ্যালয়টির দশম শ্রেণীর নির্বাচনী পরীক্ষায় বাংলাদেশ ও বিশ্ব পরিচয় বিষয়ের ৩০টি বহুনির্বাচনী প্রশ্নের ২৮টি হুবহু এসেছে কোচিংটির মূল্যায়ন পরীক্ষার প্রশ্ন থেকে। কোচিং সেন্টারটির নাম সুমন শিক্ষা নিবাস। এতে বিদ্যালয়টির শিক্ষক, শিক্ষার্থী, অভিভাবক ও সাধারণ মানুষের মধ্যে ব্যাপক সমালোচনা শুরু হয়েছে।
বিদ্যালয়টির সহকারী শিক্ষক জিয়াউর রহিম খান স্থানীয় সুমন শিক্ষা নিবাস নামে একটি কোচিং সেন্টারের সাথে জড়িত বলে অভিযোগ উঠেছে। ঘটনাটি জানার পরও শিক্ষক জিয়াউরের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি প্রতিষ্ঠান প্রধান। এ ঘটনায় বিদ্যালয় ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি ও জেলা প্রশাসক শামীম আহমেদ বরাবর অভিযোগ দায়ের করেছেন কয়েকজন অভিভাবক। তবে শিক্ষক জিয়াউর রহিম খানের দাবী বিষয়টি কাকতালীয়ভাবে হয়েছে। কেননা তিনি কোন কোচিং সেন্টারের সাথে জড়িত নন।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, প্রতি বছর এসএসসি পরীক্ষার আগে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষা হিসেবে পরিচিত নির্বাচনী পরীক্ষার সময় বিদ্যালয়টির কিছু শিক্ষক একটি সিন্ডিকেট তৈরি করেন৷ বছরের শুরু থেকেই এই সিন্ডিকেট ছাত্রদের টার্গেট করে তাদেরই পরোক্ষ ইশারায় পরিচালিত স্থানীয় বিভিন্ন কোচিংয়ে টিউশন নিতে বাধ্য করেন। টিউশন না নিলে নির্বাচনী পরীক্ষায় ফেল করানোর হুমকি দেয়া হয়। শিক্ষকরা সেসব কোচিংয়ের মাধ্যমে ছাত্রদের পরীক্ষার প্রশ্নপত্র সরবরাহ করে।
এই পদ্ধতিতে প্রশ্নপত্র সরবরাহ চলে তৃতীয় শ্রেণী থেকে নবম শ্রেণী পর্যন্ত। তবে এতোদিন এই পদ্ধতিতে কিছু রাখঢাক থাকলেও সম্প্রতি দশম শ্রেণীর নির্বাচনী পরীক্ষায় বাংলাদেশ ও বিশ্ব পরিচয় বিষয়ের ৩০টি বহুনির্বাচনী প্রশ্নের ২৮টি হুবহু এসেছে বিদ্যালয়ের অদুরে সুমন শিক্ষা নিবাস নামে একটি কোচিংয়ের মূল্যায়ন পরীক্ষার প্রশ্ন থেকে। গত২৭ অক্টোবর বিদ্যালয়ের নির্বাচনী পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হলেও একই প্রশ্নে কোচিংটিতে পরীক্ষা নেয়া হয় কিছুদিন আগে।
অভিভাবকদের অভিযোগ, কোচিংটিতে বাংলাদেশ ও বিশ্ব পরিচয় বিষয়ে মূল্যায়ন পরীক্ষার প্রশ্নটি সরবরাহ করেছেন বিদ্যালয়ের শিক্ষক জিয়াউর রহিম খান। তার দেয়া ৩০টি প্রশ্নের ওই প্রশ্নেপত্র থেকে মাত্র দুইটি বহুনির্বাচনি প্রশ্ন পরিবর্তন করে তা নির্বাচনী পরীক্ষা প্রশ্ন হিসেবে জমা দেন তিনি।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে অভিভাবকরা আরও অভিযোগ করে বলেন, বিদ্যালয়টির কমবেশি সকল শিক্ষক শহরের বিভিন্ন কোচিং সেন্টারের সাথে জড়িত।তারা কখনো নিজেরা সরাসরি বা পরোক্ষভাবে ছাত্রদের এসব কোচিংয়ে পড়াতে বাধ্য করান। তাদের কথামতো কোচিং না করলে পরীক্ষায় নম্বর কম দেয়া হয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে ছাত্রদের ফেল করানো হয় সামান্য নম্বরের ব্যবধানে।
শিক্ষক জিয়াউর রহিম খান তার বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ সম্পর্কে বলেন, তিনি কখনই কোন কোচিং সেন্টারের সাথে জড়িত হননি। পরীক্ষায় কাকতালীয়ভাবে তার দেয়া প্রশ্নের সাথে একটি কোচিং সেন্টারের মূল্যায়ন পরীক্ষার প্রশ্ন হুবহু মিলে যাওয়াটা কাকতালীয়। এঘটনায় তিনি বিব্রত ও লজ্জিত । করোনা মহমারির পর এই পরীক্ষায় প্রশ্ন সহজ করতে গিয়ে যে মডেল বেছে নিয়ে করেছেন সেই মডেল হয়ত ওই কোচিং সেন্টারও বেছে নিয়েছিল। তবে ৩০ টির মধ্যে ৫ টি প্রশ্নের মিল ছিলনা। তাকে আরও সতর্ক হওয়া উচিত ছিল। তিনি জড়িত না হয়েও এই ঘটনার জন্য তার ২২ বছরের শিক্ষকতার জীবনে স্বচ্ছতার মান ক্ষুন্ন করেছে।
এবিষয়ে জানতে সুমন শিক্ষা নিবাসের পরিচালক সুমন আলীর সাথে তার মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি শিক্ষক জিয়াউর রহিম খান নামে কোন শিক্ষককে চেনেন না এবং ওই নামে কোন শিক্ষক তার সুমন শিক্ষা নিবাসের সাথে জড়িত নন বলে জানান। মূল্যায়ন পরীক্ষার যে প্রশ্নের সাথে স্কুলের পরীক্ষার প্রশ্নের সাথে হুবহু মিল হওয়ার বিষয়টিকে তিনিও কাকতালীয় বলে মনে করেন। ওই প্রশ্নগুলি গতবছর তার শিক্ষা নিবাসের মুল্যায়ন পরীক্ষার জন্য। তারা যে গাইড বই অনুসরন করেছেন,ওই শিক্ষক হয়ত একই গাইড বই থেকে প্রশ্নগুলি নিয়ে থাকতে পারেন। তার প্রতিষ্ঠানের সাথে শিক্ষক জিয়াউর রহিম খানের কোন সম্পৃক্তা নেই বলেও দাবি করেন তিনি।
স্কুলের প্রধান শিক্ষক হারুন অর রশীদ ৩০টি প্রশ্নের মধ্যে ২৫টি প্রশ্ন হুবহু মিলে যাওয়ার সত্যতা নিশ্চিত করে বলেন, এবিষয়ে জেলা প্রশাসন ও জেলা শিক্ষা অফিস তদন্ত করছে। তবে তার জানামতে শিক্ষক জিয়াউর রহিম খান কোন কোচিং সেন্টারের সাথে জড়িত নন।
জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার আকতার হোসেন জানান,ঘটনাটি তদন্ত করে দেখা হচ্ছে। সত্যতা পাওয়া গেলে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে।
বিদ্যালয় ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি ও জেলা প্রশাসক শামীম আহমেদ বলেন, ঘটনাটি তদন্ত করে প্রতিবেদন দাখিলের জন্য অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (শিক্ষা ও আইসিসি) নুরে আলম মাসুমের ওপর দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। ইতিমধ্যে বেশ কজনার স্বাক্ষ্য গ্রহণ করেছেন তিনি। প্রতিবেদন দাখিলের পর সত্যতা পাওয়া গেলে ওই শিক্ষকের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে।