গ্রাহকদের টাকা নিয়ে পালানো জনতা ব্যাংকের পিয়ন রঞ্জু আটক
জুবায়েল হোসেন, সিরাজগঞ্জ প্রতিনিধি
প্রতারণার মাধ্যমে গ্রাহকদের বিপুল টাকা নিয়ে পালিয়ে যাওয়া জনতা ব্যাংকের সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুর শাখার পিয়ন আওলাদ হোসেন রঞ্জুকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।
আজ মঙ্গলবার (১১ জুলাই) দুপুরে শাহজাদপুর থানায় এক প্রেস কনফারেন্সে এসব তথ্য জানান অতিরিক্ত পুলিশ সুপার শাহজাদপুর সার্কেল মো. কামরুজ্জামান।
এর আগে গতকাল সোমবার (১০ জুলাই) ভোর ৬ টার দিকে গোপালগঞ্জ সদরের পূর্ব মিয়াপাড়া এলাকা থেকে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়।
গ্রেপ্তারের পরে পুলিশের প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে গ্রাহকদের কাছ থেকে প্রতারণার মাধ্যমে টাকা আত্মসাৎ এর বিষয়টি স্বীকার করেছেন রঞ্জু। আওলাদ হোসেন রঞ্জু শাহজাদপুর পৌরসভার পাড়কোলা গ্রামের মৃত নুরুল আকন্দের ছেলে।
অতিরিক্ত পুলিশ সুপার জানান, গত ৬ তারিখে জনতা ব্যাংক শাহজাদপুর শাখার আবু হানিফ নামে একজন গ্রাহক উক্ত ব্যাংকে তার অ্যাকাউন্ট থেকে টাকা উত্তোলনের জন্য আসেন এবং চেক জমা দেয়ার পরে তিনি জানতে পারেন যে, তার অ্যাকাউন্টে কোন টাকা নেই। গত মে মাসের ২ তারিখ তিনি অত্র ব্যাংকে কর্মরত পরিচ্ছন্নতাকর্মী আওলাদ হোসেন রঞ্জুর মাধ্যমে ৫ লক্ষ টাকা জমা প্রদান করেছেন। এরপরে তিনি উক্ত ব্যাংকের ম্যানেজারকে বিষয়টি অবহিত করেন। পরে ম্যানেজার জানতে পারেন যে, আওলাদ হোসেন রঞ্জু ঈদের ছুটির পর থেকে ব্যাংকে অনুপস্থিত আছে এবং উক্ত তারিখে হানিফের কোন জমা ভাউচার নেই।
এরপর রঞ্জুর অনুপস্থিতির বিষয়টি জানাজানি হলে গ্রাহকরা ব্যাংকে আসতে শুরু করেন। উক্ত ঘটনায় ম্যানেজার জেহাদুল ইসলাম শাহজাদপুর থানায় ৬ জুলাই একটি সাধারণ ডায়েরি করেন (ডায়েরি নং ৩২৭)।
পরবর্তীতে ম্যানেজার জানতে পারেন যে, আওলাদ হোসেন রঞ্জু দৈনন্দিন ব্যাংকিং কার্যাবলীর অগোচরে ব্যাংকের সিল ও স্বাক্ষর জাল করে ভুয়া ভাউচার তৈরি করে গ্রাহকদের সাথে ব্যক্তিগত সুসম্পর্ককে কাজে লাগিয়ে ২৫ জন গ্রাহকের প্রায় ৪৫ লক্ষ টাকা আত্মসাৎ করেছে। উক্ত ঘটনার বিষয়ে ম্যানেজার মো. জেহাদুল ইসলাম বাদী হয়ে গতকাল ১০ জুলাই শাহজাদপুর থানায় একটি প্রতারণার মামলা দায়ের করেন (মামলা নং- ২৩)।
এরপর শাহজাদপুর সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. কামরুজ্জামান ও শাহজাদপুর থানার ওসির তত্ত্বাবধানে শাহজাদপুর থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) গোপাল চন্দ্র মন্ডল এর নেতৃত্ত্বে শাহজাদপুর থানা পুলিশের একটি টিম গোপালগঞ্জ থেকে উক্ত ঘটনার মূল হোতা আওলাদ হোসেন রঞ্জু (৪০) কে গ্রেপ্তার করেন। এ সময় তার কাছ থেকে নগদ ২৪ হাজার ২০ টাকা ও একটি মোবাইল ফোন জব্দ করা হয়।
অতিরিক্ত পুলিশ সুপার কামরুজ্জামান বলেন, প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায় যে, রঞ্জু ২০০৩ সালে জনতা ব্যাংক শাহজাদপুর শাখাতে পিওন কাম পরিচ্ছন্নতা কর্মী পদে ( No Work, No Pay) যোগদান করে। ২০০৭ সালে সে তার কাজের পাশাপাশি ডেচপাশের কাজ শুরু করে এবং ব্যাংকের প্রবেশ দ্বারে একটি ডেস্ক স্থাপন করে। সে তার কাজের পাশাপাশি যখন কেউ অ্যাকাউন্ট খুলতে আসত তখন তার ফরম পূরণ করে দিত।
এমতাবস্থায় ২০১৬ সালের দিকে সে ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়ে। সে স্থানীয় লোকজনের কাছে চড়া সুদে আনুমানিক ১৫ লক্ষ টাকা ঋণ নেয়। এরপর উক্ত ঋণের টাকা পরিশোধ করার জন্য সে টিএমএসএস, ব্রাক, আশা, দিশা সহ বিভিন্ন এনজিও থেকে প্রায় ২০ লক্ষ টাকা ঋণ নেয়। তাকে প্রতি সপ্তাহে প্রায় ৩০ হাজার টাকা কিস্তি দিতে হত। এরপর সে ২০২২ সালের শুরুর দিকে গ্রাহকদের কাছ থেকে জালিয়াতি করে টাকা নেয়ার পরিকল্পনা করে।
পরিকল্পনা অনুযায়ী সে তার পরিচিত লোকদের টার্গেট করে এবং তাদের অ্যাকাউন্ট খুলে দেয়। তার গ্রাহকরা তাকে বিশ্বাস করতেন এবং তার পরিচিত টার্গেট অ্যাকাউন্টের কেউ টাকা জমা ও উত্তোলন করতে আসলে তার মাধ্যমেই করত। কোন গ্রাহক টাকা তুলতে আসলে তারা যে টাকার পরিমাণ লিখত তার বাম পাশে গোপনে সে একটি ডিজিট বসিয়ে বেশি টাকা তুলত। আবার মাঝে মাঝে সে চেক নিজের কাছে রেখে তার কাছে থাকা টাকা দিয়ে দিত। পরে সুবিধামতো সময়ে চেক দিয়ে বেশি টাকা উত্তোলন করত। আবার তার পরিচিত কেউ যখন টাকা জমা দিতে আসত তখন তার কাছে টাকা দিয়ে চলে যেত। কিন্তু সে উক্ত টাকা ব্যাংকে জমা না দিয়ে নিজের কাছে রাখত এবং পরের দিন গ্রাহককে ভুয়া জমা রসিদ প্রদান করত।
তিনি বলেন, আমরা অল্প সময় তাকে জিজ্ঞাসাবাদের সুযোগ পেয়েছি। এরপরেও আমরা তদন্ত করে দেখছি তার সঙ্গে অন্য কেউ জড়িত আছে কিনা। এছাড়াও ব্যাংক কর্তৃপক্ষ বিষয়টি তদন্ত করছে। তারাও জানার চেষ্টা করছে এ ঘটনায় আরকেও জড়িত আছে কি না।
প্রসঙ্গত, জনতা ব্যাংকের সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুর শাখার পরিচ্ছন্নতাকর্মী আওলাদ হোসেন রঞ্জু গ্রাহকদের প্রায় ৫ কোটি টাকা নিয়ে পালিয়েছেন বলে অভিযোগ ওঠে। তবে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ দাবি করেন প্রাথমিকভাবে ২২ লাখ টাকার মত সে আত্মসাৎ করেছে বলে তারা জানতে পেরেছিলেন। বিষয়টি জানাজানি হওয়ার পর থেকে ব্যাংকে ভিড় জমিয়েছেন ভুক্তভোগী গ্রাহকরা। রঞ্জু টাকা জমা ও উত্তোলন করে দেওয়ার কথা বলে গ্রাহকদের এই টাকা আত্মসাৎ করেছেন।