জাতীয়

ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ, পঁচাত্তরের এদিন কুখ্যাত আইনটি জারি করে মোশতাক সরকার

নাসির উদ্দিন/দেলোয়ার হোসেন লিটু

ইতিহাসের এক কালো আইন ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ। ১৯৭৫ সালের এ দিনে মানবতাবিরোধী কুখ্যাত অধ্যাদেশটি জারি করেন বঙ্গবন্ধু হত্যায় জড়িত তৎকালীন দখলদার রাষ্ট্রপতি খন্দকার মোশতাক। মূলত এর মাধ্যমে সপরিবারে জাতির পিতাকে হত্যার বিচারের পথ রুদ্ধ করে দেয়া হয়। এই নীলনকশাকে স্থায়ী রূপ দিতে অধ্যাদেশটিকে ১৯৭৯ সালে আইনে পরিণত করেন তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়। যেহেতু বাংলাদেশ সংসদ অধিবেশনে ছিল না, সেক্ষেত্রে শেখ মুজিবের একজন ঘনিষ্ঠ রাজনৈতিক সহযোগী রাষ্ট্রপতি খন্দকার মোশতাক আহমেদ কর্তৃক একটি অধ্যাদেশের আকারে ২৬ সেপ্টেম্বর, ১৯৭৫ সালে এ আইনটি প্রণীত হয় এবং শেখ মুজিবের হত্যাকান্ডের পর তিনিই দেশটির রাষ্ট্রপতি হন। এটি ১৯৭৫ সালের অধ্যাদেশ নং ৫০ নামে অভিহিত ছিল। পরে ১৯৭৯ সালে সংসদ কর্তৃক এটি অনুমোদন করা হয়। যার ফলে এটি একটি আনুষ্ঠানিক আইন হিসেবে অনুমোদন পায়। ১৯৭৯ সালের ৯ জুলাই বাংলাদেশ সংবিধানের ৫ম সংশোধনীর পর সংশোধিত আইনে এ আইনটি বাংলাদেশ সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করা হয়।

শেখ মুজিবের কন্যা শেখ হাসিনা ওয়াজেদ, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হিসাবে আওয়ামী লীগ সরকার প্রতিষ্ঠার পর ১৯৯৬ সালের ১২ নভেম্বর সপ্তম  জাতীয় সংসদে ইনডেমনিটি আইন বাতিল করেন। এটি শেখ মুজিবের হত্যাকারীদের বিচারের পথ প্রশস্ত করেছিল। ২০১০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে সংবিধানের ৫ম সংশোধনীকে অবৈধ ঘোষণা করে বাংলাদেশ হাইকোর্ট।

দীর্ঘ ২১ বছর পরে আওয়ামীলীগ ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় এসে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের বিচারকার্য শুরু করে। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের বিচারের কাজ শুরু হয় ১৯৯৬ সালের ২ অক্টোবর ধানমণ্ডি থানায় মামলা দায়ের এর মাধ্যমে। ১৯৯৮ সালের ৮ নভেম্বর তারিখে মামলার যাবতীয় কার্যক্রম শেষে পনেরো (১৫) জন আসামিকে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করা হয়। আসামি পক্ষের পনেরো জন উচ্চ আদালতে আপিল করার সুযোগ পান। উক্ত আপিলে ১২ জনের মৃত্যুদণ্ড বহাল এবং ৩ জনকে খালাস প্রদান করা হয়।

তবে ২০০১ সালে বিএনপি-জামাত চারদলীয় জোট সরকার ক্ষমতায় এলে এ মামলার কার্যক্রম স্থবির হয়ে পরে। ২০০৮ সালের নির্বাচনে নিরঙ্কুশ জয় লাভের পর আওয়ামীলীগ সরকার আবার এ বিচারকার্য চালিয়ে যাওয়ার উদ্যোগ গ্রহণ করে। ২০০৯ সালে লিভ-টু-আপিল-এর মাধ্যমে এ বিচার প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়। আপিল শেষে বারো জনের মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখেন মহামান্য আদালত। ২০১০ সালের ২৭ জানুয়ারি তারিখে এদের মধ্যে পাঁচ জনের ফাঁসির মাধ্যমে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। দীর্ঘদিন পর পলাতক এক আসামি গ্রেফতার হলে ১২ই এপ্রিল,২০২০ তারিখে তার ফাঁসির মাধ্যমে মৃত্যুদন্ড কার্যকর করা হয়। বাকি পাঁচ জন এখনও বিভিন্ন দেশের আশ্রয়ে পলাতক।

ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ যেদিন স্বাক্ষরিত হয় সেদিন ছিলো শুক্রবার। ‘দি বাংলাদেশ গেজেট, পাবলিশড বাই অথরিটি’ লেখা অধ্যাদেশটিতে খন্দকার মোশতাক স্বাক্ষরিত। মোশতাকের স্বাক্ষরের পর অধ্যাদেশে তৎকালীন আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব এম এইচ রহমানের স্বাক্ষর আছে। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ও সংসদ নেতা শাহ আজিজুর রহমান পঞ্চম সংশোধনী বিলটি পেশ করেন। এই ব্যক্তি রাজাকারদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন। অধ্যাদেশটিতে দুটি অংশ আছে। প্রথম অংশে বলা হয়েছে, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ভোরে বলবৎ আইনের পরিপন্থি যা কিছুই ঘটুক না কেন, এ ব্যাপারে সুপ্রিমকোর্টসহ কোনো আদালতে মামলা, অভিযোগ দায়ের বা কোনো আইনি প্রক্রিয়ায় যাওয়া যাবে না। দ্বিতীয় অংশে বলা আছে, রাষ্ট্রপতি উল্লিখিত ঘটনার সঙ্গে সম্পৃক্ত বলে যাদের প্রত্যয়ন করবে তাদের দায়মুক্তি দেওয়া হলো অর্থাৎ তাদের বিরুদ্ধে কোনো আদালতে মামলা, অভিযোগ দায়ের বা কোনো আইনি প্রক্রিয়ায় যাওয়া যাবে না। সংবিধানের গণতন্ত্র বিষয়টি খর্ব হবে বলে অনেকে বিরোধিতা করলেও রাষ্ট্রপতি একক ক্ষমতা বলে সংশোধনী বিল পাশ করায়।

বাংলাদেশে মোট তিনবার ইনডেমনিটি আইন পাস করা হয়। ২০১০ সালে এসব অধ্যাদেশকে অবৈধ ঘোষণা করা হয়েছে। এ ইনডেমনিটি ছিল এমন একটি আইন যা ইতিহাসে লজ্জাজনক। বঙ্গবন্ধু ছাড়াও আব্রাহাম লিংকন, মহাত্মা গান্ধী, রাজিব গান্ধী, ইন্দিরা গান্ধী, বেনজির ভুট্টো, বন্দর নায়েককে গুলি করে হত্যা করা হলেও সেসব দেশে ইনডেমনিটি আইন জারি করা হয়নি কিন্তু বাংলাদেশে এমনটি করা হয়েছিল। পৃথিবীর কোনো সংবিধানে লেখা নেই যে, খুনিদের বিচার করা যাবে না। অথচ তা বাংলাদেশেই প্রথম ঘটেছিলো; এমনকি বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর ২০ বছর পার হলেও কোন রাষ্ট্রপতি বা সরকার প্রধান সেটি বাতিল না করে উল্টো নিজেদের সুবিধা নেওয়ার জন্য ইনডেমনিটি বহাল রাখেন।

Show More

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button