দেশের মনোবিজ্ঞানীরা বলছেন, সোশ্যাল মিডিয়ার কারণে মানুষের মধ্যে অস্থিরতা বেড়ে গেছে। ফেসবুকের মতো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের কারণে অল্প বয়সী ছেলেমেয়ে থেকে শুরু করে তাদের অভিভাবকদের মধ্যেও তৈরি হচ্ছে মানসিক চাপ।
চিন্তা করুন, আপনি বুঝতে পারছেন আপনার সময় নষ্ট হচ্ছে, আপনার ঘুম নষ্ট হছে, শরীরের ওপর চাপ পড়ছে। আপনি চেষ্টা করছেন এই অভ্যাস থেকে বের হতে, কিন্তু পারছেন না। নিশ্চয়ই আপনি ভাবছেন এখানে কোনো ক্ষতিকর মাদকের প্রভাব নিয়ে কথা হচ্ছে, কিন্তু না! এখানে বলা হচ্ছে আপনার হাতে থাকা স্মার্টফোন ও এতে থাকা সোশ্যাল মিডিয়ার কথা।
বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহারকারীর একটি বড় অংশেরই বয়স ১৮-এর নিচে। এই বয়সী শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে সোশ্যাল মিডিয়া বেশ শক্তিশালী প্রভাব রাখতে সক্ষম। যুক্তরাজ্যে ১৩ থেকে ১৬ বছর বয়সীদের ওপর ২০১৯ সালে করা এক গবেষণায় দেখা গেছে, দিনে তিনবারের বেশি সোশ্যাল মিডিয়ায় থাকা শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্য এবং সুস্থতা ধীরে ধীরে কমছে। মোট ১২,০০০ জনের ওপর এই গবেষণা করা হয়। ২০১৬ এমআইটি সমীক্ষায় দেখা গেছে যে, সোশ্যাল মিডিয়ায় ঘন ঘন উপস্থিতির ফলে শিক্ষার্থীদের মধ্যে গুরুতর বিষণ্ণতা ৭% এবং উদ্বেগজনিত ব্যাধি ২০% বৃদ্ধি পেয়েছে।
সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে তরুণরা সমাজে ভালো-মন্দ দু’ধরনের ভূমিকাই রাখছে৷ তবে দুশ্চিন্তার বিষয় হলো, দিনের খুব বড় একটা সময় এই মাধ্যমে ব্যস্ত থাকায় তরুণদের অলসতা বাড়ছে৷ বাড়ছে মানসিক সমস্যাও। গবেষকরা আরও আবিষ্কার করেছেন যে, বেশি রাতে সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার বিভিন্ন একাডেমিক পরীক্ষার দুর্বল স্কোরের কারণ ছিল এবং উচ্চ স্তরের উদ্বেগ এবং বিষণ্ণতার কারণও হয়েছিল। এখন প্রশ্ন হলো, এত নেতিবাচকতার প্রমাণ পাওয়ার পরও সোশ্যাল মিডিয়ার ব্যবহার শিক্ষার্থীদের মাঝে বেড়েই চলেছে কেন? এর উত্তর রয়েছে নিউরোসায়েন্স এবং আমাদের মস্তিষ্কের কার্যকারিতার মধ্যে।
সোশ্যাল মিডিয়া অ্যালগরিদম আমাদের মস্তিষ্কের ডোপামিনার্জিক আনন্দের পথকে উদ্দীপিত করে। ডোপামিন আমাদের মস্তিষ্কে উৎপন্ন একটি রাসায়নিক যা আনন্দ, তৃপ্তি এবং অনুপ্রেরণার অনুভূতি দেয়। সোশ্যাল মিডিয়া অ্যালগরিদম বিস্ময়, পুরষ্কার এবং উত্তেজনার অনুভূতিকে উদ্দীপিত করে, যার সবগুলোই ডোপামিনকে ট্রিগার করে। এটি বিভিন্ন উপায়ে মস্তিষ্কে প্রতিক্রিয়া তৈরি করে, যেমনটা কারো মাদকদ্রব্যের প্রতি আসক্তি থাকলে ঘটে থাকে।
ব্যক্তিগত ও সামাজিকভাবে ভয়াবহ মাদকের মতোই এটি আমাদের টেনে নিয়ে যাচ্ছে ধ্বংসের দিকে এর থেকে পরিত্রানের জন্য প্রতিদিনের সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহারে যুক্তিসঙ্গত সময়সীমা নির্ধারণ করতে হবে। বন্ধুদের সঙ্গে চ্যাটিং কম, মুখোমুখি যোগাযোগ বেশি করতে হবে। অভিভাবকেরা তাদের কিশোর ছেলেমেয়ের অ্যাকাউন্ট পর্যবেক্ষণ করবেন। তারা কীভাবে সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার করছে সে সম্পর্কে কথা বলবেন বা জানার চেষ্টা বরবেন। এটি তাদের কীভাবে এবং কতটা প্রভাবিত করছে তা বোঝার চেষ্টা করতে হবে। কিশোর বয়সে পৃথিবীর অনেকটাই অচেনা থাকে। এসময় সোশ্যাল মিডিয়ার জগতকে স্বপ্নের মতো মনে হয়। তাদের বুঝিয়ে বলুন বাস্তব দুনিয়ার সঙ্গে এর ফারাক কতখানি।
কেবল মা-বাবার প্রচেষ্টাই এই সামাজিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করার জন্য যথেষ্ট নয়। দায়িত্ব রয়েছে সোশ্যাল মিডিয়া সংস্থাগুলোরও। আমরা সেই যুগে পৌঁছেছি যেখানে মানুষই শুধু প্রযুক্তিকে নিয়ন্ত্রণ করছে না, প্রযুক্তিও মানুষকে নিয়ন্ত্রণ করছে। এটি আমাদের সামাজিক সংযোগ, খরচের ধরণ এবং এমনকি মূল্যবোধকে আকার দিচ্ছে। কিশোর-কিশোরীরা এখন জ্ঞানে সমৃদ্ধ হওয়ার চেয়ে প্রযুক্তিতে অনেক বেশি দক্ষ। আমরা ইতিমধ্যে এমন পর্যায়ে পৌঁছেছি যেখানে সামাজিক মিডিয়া অ্যালগরিদম আর্টিফিসিয়াল ইনটেলিজেন্স দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে। যা আমাদের নিজস্ব নৈতিকতা এবং মূল্যবোধকে প্রতিফলিত করতে পারে। সোশ্যাল মিডিয়া সংস্থাগুলোকে আমাদের মূল্যবোধ সম্পর্কে সতর্ক হওয়া প্রয়োজন। এটি করতে ব্যর্থ হলে মানবতার সামাজিক কাঠামোর ওপর দীর্ঘস্থায়ী এবং সুদূরপ্রসারী প্রভাব পড়বে।