সংবাদ সারাদেশ

পিআইও কর্মকর্তার যোগসাজশে, ধামরাইয়ে কাবিটা প্রকল্পের কাজ না করেই টাকা আত্মসাৎ

মোহনা অনলাইন

ঢাকার ধামরাই উপজেলায় গ্রামীণ অবকাঠামো সংস্কার কাজের বিনিময়ে টাকা (কাবিটা) কর্মসূচির অধীনে বিভিন্ন প্রকল্পে অনিয়মের অভিযোগ পাওয়া গেছে। চলতি বছরের জুন মাসের মধ্যে এসব প্রকল্প শেষ হওয়ার কথা ছিল। তবে স্থানীয় লোকজনের দাবি, এসব প্রকল্পের কোথাও নামে মাত্র কাজ হয়েছে, কোথাও কাজ না করেই উপজেলার প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তার (পিআইও) যোগসাজশে টাকা তুলে নেয়ার অভিযোগ উঠেছে। আবার কিছু প্রকল্প শুধু কাগজে–কলমে আছে, বাস্তবে কাজের কোনো অস্তিত্ব নেই। বাদ পরেনি কবরস্থান ও শ্মশানের নামে বরাদ্দের টাকাও। এসব অভিযোগের সত্যতা নিশ্চিত করতে অনুসন্ধানে নামে মোহনা টেলিভিশন।

উপজেলার প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তার কার্যালয় (পিআইও) সূত্রে জানা যায়, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে গ্রামীণ অবকাঠামো সংস্কার কাজের বিনিময়ে টাকা (কাবিটা) কর্মসূচির অধীনে ধামরাই উপজেলার ১১টি ইউনিয়নের বিভিন্ন রাস্তা মেরামত, কবরস্থান- শ্মশান সংস্কার, মাদ্রাসা- স্কুলের মাঠ ভরাটসহ মোট ২২টি প্রকল্পের বিপরীতে বরাদ্দ হয় ৪৭ লাখ টাকা।

এসব প্রকল্পের বিষয়ে মোহনা টেলিভিশন কয়েক দিনের অনুসন্ধানে জানা যায়, ধামরাই উপজেলার কুশুরা ইউনিয়নের টোপের বাড়ি মিয়া বাড়ি এলাকার কবরস্থান সংস্কারের জন্য সরকারি বরাদ্দ দেখানো হয়েছে এক লাখ টাকা। প্রকল্পের বিষয়ে খোঁজ নিতে গেলে স্থানীয়রা জানান, গত কয়েক বছরে কবরস্থানের কোনো সংস্কারের কাজ হয়নি। এই কবরস্থান সংস্কারের জন্য সরকারি কোনো বাজেটের কথাও তারা শুনেনি কখনো। একই প্রকল্পে কুশুরা ইউনিয়নের বেংরোয়া সিংশ্রী এলাকায় দূর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের আওতায় তৈরি করা একটি ব্রিজের চারপাশে গাইড ওয়াল নির্মাণের জন্য বরাদ্দ দেয়া হয়েছে ২ লক্ষ টাকা।

সরজমিনে গিয়ে দেখা যায়, ব্রিজের এক পাশে গাইড ওয়াল দেয়া হয়নি। ওই পাশের গাইড ওয়ালের জন্য তৈরি করা ১৮টি সিমেন্টের (৪১ হাজার ৪শত টাকা মূল্যের) খুঁটি ওই ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য ফারুক হোসেন তার ব্যাক্তিগত কাজের জন্য বাড়িতে নিয়ে গেছে এবং এক পাশে গাইড ওয়াল না দেয়ার টাকাও বেঁচে গেছে যা ওই ইউপি সদস্য ও পিআইও কর্মকর্তা আত্মসাৎ করেছে বলে অভিযোগ উঠেছে। এছাড়াও বাকি তিন পাশে মাটির উপর থেকে মাত্র তিন ফুট উচ্চতায় ইটের গাঁথনি দিয়ে গাইড ওয়াল দেয়া হয়েছে। এতে করে বৃষ্টির পানিতে গাইড ওয়ালের নিচের মাটি ধুয়ে ফাকা হয়ে যাচ্ছে।

ব্রিজের কাজের জন্য তৈরি করা ১৮টি খুঁটি বাড়িতে নেওয়ার বিষয়টি স্বীকার করে কুশুরা ইউনিয়নের ৫ নং ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য ফারুক হোসেন বলেন, একেকটি খুঁটি তৈরি করতে ২৩শ টাকা করে খরচ হয়েছে। ব্রিজের পাশেই খুঁটি গুলো তৈরি করেছি। ১৮টি খুঁটি বেশি হয়েছে তাই পিআইও স্যার খুঁটি গুলা আমার বাড়িতে নিয়ে রাখতে বলছেন। অন্য কোথাও কাজ হলে তখন সেখানে ব্যবহার করতে পারবো তাই আমার বাড়িতে নিয়ে রাখছি।

সোমভাগ ইউনিয়ন সোমভাগ এলাকা থেকে নওগাঁ এলাকা পর্যন্ত রাস্তা সংস্কারের জন্য বরাদ্দের ১ লাখ টাকা উত্তোলন করা হলেও কোন কাজই করা হয়নি। গাঙ্গুটিয়া ইউনিয়নের হাতকোড়া এলাকার জামিয়া মঈনুল ইসলাম হাতকোড়া দাউরায়ে হাদিস মাদ্রাসার পুকুর ভরাটের জন্য ৫ লাখ টাকা বরাদ্দ থাকলেও নামে মাত্র কয়েক ট্রাক মাটি ফেলা হয়েছে।

যাদবপুর ইউনিয়নের বিলকুশনাই নুরানী হাফিজিয়া মাদ্রাসা ও এতিম খানার পুকুর ভরাট করার জন্য ২ লক্ষ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হলেও এক ট্রাক মাটি/বালুও ফেলা হয়নি। তবে টাকা উত্তোলন করা হয়েছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক মাদ্রাসার এক শিক্ষক জানান, মেম্বার ফারুক হোসেনের মাধ্যমে টাকা পেয়েছি। বরাদ্দের সম্পূর্ণ টাকা পেয়েছেন কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, টাকা মাদ্রাসার ব্যাংক একাউন্টে জমা আছে। তবে বরাদ্দের ২ লাখের সম্পূর্ণ টাকা পাইনি। কিছু টাকা কম আছে।

এছাড়াও যাদবপুর ইউনিয়নের যাদবপুর গ্রামের এসপি শহিদুল এর বাড়ি থেকে ডিলারের বাড়ি পর্যন্ত রাস্তায় গাইড ওয়াল, মাটি ভরাট ও ইট সলিং এর জন্য প্রকল্পের বরাদ্দ ৫ লাখ টাকা। সেখানে সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায় কাজ সম্পূর্ণ করা হয়েছে।

তবে স্থানীয়রা জানান, গাইড ওয়াল টি করা হয়েছে দুইবার। প্রথম একবার কোনরকম করা হয়েছিলো। দুই এক জাগায় ভেঙে যাওয়ার পর আবার নতুন করে করা হয়েছে। ইট সলিং তো করা হয়েছে পুরাতন ইট দিয়েই। তার পরও প্রকল্পে যে পর্যন্ত উল্লেখ আছে তার তিন ভাগের এক ভাগ রাস্তা ইট সলিং করছে, বাকি রাস্তা ইট সলিং আগেরই করা ছিলো। মাটিও তেমন লাগে নাই। এখানে বেশি হলেও ২ লাখ টাকার কাজ হবে হয়তো কিন্তু বরাদ্দ ছিলো ৫ লাখ টাকা। যাদবপুর ইউনিয়নের আটিগ্রাম এলাকার আলতাফ হোসেনের বাড়ি হতে নিজামের বাড়ি এবং বিলকুশনাই এলাকার বাবুলের বাড়ি থেকে লিটনের বাড়ি পর্যন্ত রাস্তা মেরামতের জন্য ২ লাখ করে ৪ লাখ টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে প্রকল্পে। তবে সরজমিন গিয়ে রাস্তা মেরামতের তেমন কোন চিহ্ন পাওয়া যায়নি। কিন্তু এসব টাকা উত্তোলন করা হয়েছে কাজের মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই।

কুল্লা ইউনিয়নের আশরাফ চৌধুরীর বাড়ি হতে নিজাম উদ্দিনের বাড়ি পর্যন্ত মাটির রাস্তা মেরামতের জন্য ২ লক্ষ টাকা বরাদ্দ পেলেও কিছুই করেন নি ইউপি সদস্য বোরহান উদ্দিন। অথচ পিআইও অফিস থেকে কয়েক মাস পূর্বেই টাকা উত্তোলন করেছেন তিনি। এ নিয়ে এলাকাবাসী তার বাড়িতে একাধিক বার গিয়েছেন কেন তিনি রাস্তা মেরামত করেন না। নান্নার ইউনিয়নের জলসীন সার্বজনীন শ্বশানে মাটি ভরাটের জন্য ১ লক্ষ টাকা বরাদ্দ রয়েছে এই প্রকল্পে। কিন্তু ওই শ্বশানে এক ট্রাক মাটিও ফেলা হয় নি। তবে বরাদ্দের টাকা উত্তোলন করেছেন বলে জানান নান্নার ইউনিয়নের ইউপি সদস্য মোহাম্মদ মাসুদুর রহমান । টাকা উত্তোলন করেও মাটি ভরাট না করার কারণ জানতে চাইলে কোন সদুত্তর দিতে পারেননি ওই ইউপি সদস্য।

সূতিপাড়া ইউনিয়নের ভাটার খোলা এলাকার পাকা রাস্তা থেকে রুপ সুন্দরী সেবা আশ্রম পর্যন্ত কাচা রাস্তা মেরামতের জন্য ১ লক্ষ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হলেও মেরামত করা হয়নি। এই রাস্তা মেরামতের জন্য বরাদ্দের কথা জানেনই না ওই ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য বাবুল হোসেন।

তিনি বলেন, আগে একটি প্রকল্প আমি পেয়েছিলাম তার কাজ করেছি। কিন্তু এই বরাদ্দের ১ লক্ষ টাকার বিষয়ে আমি কিছুই জানি না। উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা (পিআইও) এসব প্রকল্পের কাজ তদারকি করে টাকা দেয়ার কথা থাকলেও এসবের কোন নিয়মনীতিই মানেনি ধামরাই উপজেলার সাবেক পিআইও কর্মকর্তা একে এম মুমিনুল হক।

বিষয়টি সম্পর্কে ধামরাই উপজেলার সাবেক প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা (পিআইও) এ. কে. এম. মুমিনুল হক এর কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এই বিষয়ে পিআইও অফিসের মাহবুব সাহেব কথা বলবেন। আপনি একটু মাহবুব সাহেবের সাথে দেখা কইরেন।

উপজেলা সহকারী প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা মাহবুবুর রহমান কে ফোন দিলে তিনি বলেন, আমি আজ ঢাকা যাচ্ছি আপনি আগামীকাল সকালে আসেন কথা বলবোনে আপনার সাথে। সদ্য যোগাদানকৃত ধামরাই উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা মো মোহিতুল ইসলাম বলেন, আমি কিছু দিন হলো এখানে যোগদান করেছি। এবিষয়ে কিছুই জানি না। তবে প্রতিটি বরাদ্দই যাচাই বাছাই করে বরাদ্দের টাকা দেয়া হয়।

ধামরাই উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মামনুন আহমেদ অনীক বলেন, আমি ধামরাই উপজেলায় যোগদান করেছি মাত্র দুই সাপ্তাহ হবে। এবিষয়ে আমি অবগত নই। তবে বিষয়টি অবশ্যই দেখবো।

Show More

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button