আগামীতে কে হবে বাংলাদেশের প্রধান মিত্র
শাহীন রাজা : যুক্তরাষ্ট্রের রিয়ার এডমিরাল এইলেন লুবাচার বলেছিলেন, “বাংলাদেশকে আমরা আমাদের চোখ দিয়ে দেখি। কারো চোখ দিয়ে দেখার প্রশ্নই আসে না। তিনি উল্লেখ করেন, জনসংখ্যার দিক দিয়ে বাংলাদেশ বিশ্বের অষ্টম দেশ। এবং এশীয় ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে দ্রুত অর্থনৈতিক অগ্রগামী ভূখন্ড। বাংলাদেশ এবং বাংলাদেশের জনগণ নিজ যোগ্যতায় আমাদের বন্ধু।” ইংরেজি দৈনিক নিউ এজ-এর সাথে কথপোকথনে এইলেন লুবাচার একথা বলেন।
কয়েকবছর আগেই মার্কিনীদের দৃষ্টিভঙ্গি ছিল ভিন্ন। ২০০৫ সালে মার্কিন সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী কন্ডোলিশা রাইস ভারত সফরের সময় বলেন, আমরা এই অঞ্চল ভারতের চোখ দিয়ে দেখতে চাই ! কন্ডোলিসা বলেন, দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের পর যুক্তরাজ্যের চোখ দিয়ে যেভাবে ইউরোপ দেখেছিলাম। এই অঞ্চলেও তেমনই আমাদের পরিকল্পনা !
কন্ডোলিসা থেকে এইলেন লুবাচার। খুব দীর্ঘ না হলেও বেশ ক’বছর পার হয়ে গেছে। এরমাঝে মরণঘাতী ভাইরাস ” কোভিড- ১৯ ” পৃথিবীর জনপদ তছনছ করে দিয়েছে। এই দুর্যোগ শেষ হতে না হতেই শুরু হয়। রাশিয়া উইক্রেন যুদ্ধ। এই যুদ্ধ বিশ্ব রাজনীতি বিভাজিত হয়ে পড়ে। এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র নীতির ক্ষেত্রেও আসে বড় ধরনের পরিবর্তন। যুক্তরাষ্ট্রের নতুন নীতি হচ্ছে, বাংলাদেশকে তারা তাদের মতো করেই দেখছে। ভিন্ন কোন দেশের পরামর্শে নয়।
যার সত্যতা হচ্ছে, এইলান লুবাচারের পর মার্কিন আঞ্চলিক সহকারী পররাষ্ট্র মন্ত্রী ডোনাল্ড লু একথা স্পষ্ট করেছেন। মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রী ব্লিংক-ও ভারতকে তাদের মনোভাব জানিয়েছেন। সবশেষ সম্প্রতি মার্কিন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জ্যাক সুলিভান ভারত সফরকালে এই কথাই বলেছেন। ভারতীয় কূটনীতিক এবং সাংবাদিকদের বলেন, আমরা বাংলাদেশকে একটা স্থিতিশীল গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে দেখতে চাই।
এই অঞ্চলে আরেক বাস্তবতা হচ্ছে, অর্থনৈতিক শক্তিশালী চীন! চীন বিশ্বে অর্থনৈতিক দানব হয়ে উঠেছে। পশ্চিমা বিশ্ব চীনকে তাই মনে করছে। অর্থনীতিতে নতুন দানবকে রুখতে মার্কিন এবং তার মিত্র শক্তিরা মরিয়া উঠেছে। চীনের অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রা রুখে দিতে, ভারত মহাসাগরের নিয়ন্ত্রণে সবধরনের কূটনীতিক পরিকল্পনা নিয়েছে । বর্তমানে বিশ্ব বানিজ্যের বিশাল অংশ হয় ভারত মহাসাগর দিয়ে। তাই এর নিয়ন্ত্রণে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে, পশ্চিম ইউরোপ সব ধরনের প্রস্তুতি নিয়েছে। তেমনি চীন, রাশিয়াও পশ্চিমা বিশ্বকে মোকাবেলায় প্রস্তুত।
এদিকে ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে পরাশক্তিদের খেলায় বাংলাদেশ সম্পৃক্ত হয়ে পড়েছে। কেননা বঙ্গোপসাগর যার নিয়ন্ত্রণে থাকবে, সেই ভারত মহাসাগর করবে। একারণে পরাশক্তি দেশগুলোর বাংলাদেশের উপর নজর।
এর বাইরে আছে মিয়ানমার। পশ্চিমা বিশ্বের পরিকল্পনা নিয়েছে, মিয়ানমারের রাজনৈতিক পরিবর্তন। মিয়ানমারের নিয়ন্ত্রণ নেয়া গেলে, সার্কভুক্ত দেশের দিকে চীনের আগ্রাসন থমকে দেয়া যায়। এটাকে লক্ষ্য রেখেই পশ্চিমা বিশ্বের রোহিঙ্গা সমস্যা সৃষ্টি। যার দায়ভার বাংলাদেশ বয়ে বেড়াচ্ছে।
এদিকে সার্কভুক্ত দেশগুলো লক্ষ্য রেখে চীন, মিয়ানমারের রাখাইন বিশাল বানিজ্যিক অঞ্চল গড়ে তোলার পরিকল্পনা নিয়েছে। এই ইস্যুতে ভারত এবং চীন এক! এই অঞ্চল থেকে ভারতে নিয়মিত সরবরাহ করা হশ। এব্যাপারে রাশিয়ার ভাবনা হচ্ছে, রাখাইন অঞ্চল চীন, ভারতের নিয়ন্ত্রণ থাকার অর্থই হচ্ছে আঞ্চলিক রাজনীতিতে তাদের অবস্থান নিশ্চিত ।
এ কারণেই এখান থেকে রোহিঙ্গা উচ্ছেদ। বিভিন্ন বিদ্রোহী জাতিগোষ্ঠী দমন। তাই এই তিনটি দেশ ঘনিষ্ঠ বন্ধু হওয়া সত্ত্বেও জাতিসংঘের সভায় বাংলাদেশের পক্ষে ভোট দেয় না। ভারত ভোট দানে বিরত থাকে। চীন এবং রাশিয়া মিয়ানমারের পক্ষে ভোট দিয়ে আসছে।
আজকের পৃথিবীতে আবেগের কোন স্থান নেই। আমেরিকার সাথে ভিয়েতনাম ২৫ বছর যুদ্ধ করলো। চীন এই যুদ্ধে ভিয়েতনামকে সবধরনের সহযোগিতা করে। কিন্তু আজ ভিয়েতনামের সব থেকে বড় উন্নয়ন সাথী, আমেরিকা। চীনের সাথে শীতল সম্পর্ক।
সার্বিক বিবেচনায়, যার বন্ধুত্ব আমাদের স্থায়ী উন্নয়ন দেবে। দেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব নিশ্চিত হবে। গণতন্ত্র ও মানবিক স্বাধীনতা অবাধ এবং প্রবাহমান হতে সহযোগিতা করবে। তাদের সাথেই আমাদের বন্ধুত্ব হবে। আমরা একটা আধুনিক, অসাম্প্রদায়িক, উন্নত জাতি হিসেবে পরিচিত হতে চাই।
লেখক: শাহীন রাজা, হেড অব এডিটোরিয়াল, মোহনা টেলিভিশন।