শাহীন রাজা : বয়সীকে শ্রদ্ধা এবং সম্মান জানানোই হচ্ছে আমাদের সামাজিক বোধ। পারিবারিক কিংবা সামাজিক অনুষ্ঠানে বয়সীদের বিশেষ সম্মান দেয়া হয়। আজ-ও এই ধারাবাহিকতা বিদ্যমান। এমনকি চলাফেরায়। বাসে কিংবা লঞ্চে বয়সী লোক দেখলে এখনও বসার জায়গা ছেড়ে দেয়া হয়। এটা হচ্ছে একজন প্রবীণ নাগরিকের প্রতি সামাজিক সম্মান। এবং মানবিকতা।
দীর্ঘ সময়ে আমাদের সামাজিক ব্যবস্থাপনা এমনভাবে প্রোথিত। এখানে বয়সী লোকদের সাথে অসদাচরণ সমাজ মেনে নিতে পারে না। এই অঞ্চলের লোকজনের কাছে বিষয়টি হচ্ছে, সামাজিক অন্যায়। অমানবিক।
গত স্বৈরশাসকের আমলে দেখেছি, বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টাকে পায়ে হেটে আদালতের ছয়তলায় এজলাসে উপস্থিত হতে হয়েছে। সারাদেশে বিস্মিত এবং ব্যথিত হয়েছে। এ ক্ষেত্রে মানুষের কাছে তাঁর নোবেল পুরষ্কারপ্রাপ্ত থেকে বয়সটাই প্রাধান্য পেয়েছে। ড. ইউনূসকে কেন এবং কোন অপরাধে আদালতে হাজির করা হয়েছে এটা বিবেচ্য বিষয় ছিল না। আলোচনায় ছিল, এইরকম একজন বয়সী সম্মানী লোকের সাথে এ কিধরনের আচরণ। মানুষ ব্যথিত হয়েছে। ব্যথিত হয়েছে, তাঁকে কেন এজলাসে লোহার খাঁচার ভেতর দাড়িয়ে থাকতে হবে। তাঁকে কি বসার জন্য একটা চেয়ার দেয়া যেত না ! সংবাদমাধ্যমে ঐ দিনকার ছবি দেখার পর সবাই ব্যথিত হয়ে ওঠে। অবাক হয়েছে গোটা বাংলাদেশ। সরকারের বিবেচনা এবং সৌজন্যবোধ নিয়ে গোটা দেশে সমালোচনার ঝড় বয়ে যায়।
তেমনি বিএনপি নেতা, সাবেক মন্ত্রী এবং আমলা এম কে আনোয়ারকে আদলতে নেয়া যথাযথ ছিল না। এমনকি নিউনেশন সম্পাদক ব্যারিস্টার মঈনুল হোসেন এবং কলাম লেখক শফিক রেহমানের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। অপরাধী হলে তার সাজা বা শাস্তি হবে এর বিরোধী মানুষ নয়। তাদের চোখে তখনই দৃষ্টিকটূ লাগে, যখন একজন বয়সী লোক নাগরিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়ে থাকে।
গত ৪ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর নিম্ন আদালতে একটা আবেগঘন দৃশ্য দেখে তাই মনে হয়েছে। সাবেক প্রতিমন্ত্রী আলহাজ্ব কামাল আহমেদ মজুমদার আবেগতাড়িত হয়ে কেঁদে ওঠেন। নানা রোগে আক্রান্ত একজন বয়সী মানুষ। এটাই হচ্ছে এখন তাঁর প্রধান পরিচয়। অতীতের সকল অপকর্ম বা সৎকর্ম পরের বিষয়।
বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে কামাল আহমেদ মজুমদার একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা এবং কমান্ডার ছিলেন। পাকিস্তান বিরোধী আন্দোলনেও একজন প্রথম সারিতে ছিলেন। এই বিবেচনায় আদালত হয়-তো তাঁর প্রতি সৌজন্য দেখাবেন। তার থেকেও বড় বিবেচনা হচ্ছে ভদ্রলোক চলত শক্তিহীন আশিউর্ধ্ব এক বয়সী নাগরিক।
মহামান্য আদালত আপনার কাছে আমার বিনীত অনুরোধ। বিভিন্ন অপরাধে আদালতে হাজির হওয়া সকল বয়সীদের প্রতি সহানুভূতিশীল হতে অনুরোধ। পূর্বের ধারাবাহিকতা অনুসরণ আর নয়। অতীতের স্বৈরশাসক যা করেছে, তা অনুসরণ করা ঠিক হবে না। হে আদালত আপনারা এমন কিছু দৃষ্টান্ত স্থাপন করবেন, বয়সীরা অপরাধী হলে অপরাধের জন্য শাস্তি পাবেন। কিন্তু বয়সী নাগরিক যেন তাঁর অধিকার থেকে বঞ্চিত না হয়।
লেখক: শাহীন রাজা, হেড অব এডিটোরিয়াল, মোহনা টেলিভিশন।