জাতীয়ঢাকা

লঞ্চের কেবিন ভাড়া করে খুন; ৪ বছর পর খুনের রহস্য উদঘাটন

মোহনা অনলাইন

চার বছর আগে ঢাকার সদরঘাটে মিতালি-৭ লঞ্চের কেবিনে খুন হওয়া চাঞ্চল্যকর কন্সেস লিলুফা বেগম হত্যাকান্ডের রহস্য উন্মোচনসহ ঘটনার সাথে জড়িত ব্রুনাই প্রবাসী মোঃ দেলোয়ার মিজি (৪৪) কে গ্রেফতার করেছে পিবিআই ঢাকা জেলা। গত ২২ সেপ্টেম্বর ঢাকার হযরত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে তাকে গ্রেফতার করা হয়। আসামী দেলোয়ার মিজি চাঁদপুর জেলার হাজীগঞ্জ থানার মোল্লাবাড়ি নাসিরকোর্ট গ্রামের মৃত আঃ মান্নানের ছেলে।

ভিকটিম লিলুফা বেগম (৫৭) ২০১৯ সালের ১৬ জুন রাত অনুমান ১০.০০ ঘটিকার সময় ঢাকায় আসার জন্য মিতালি-৭ লঞ্চের এস-৩০৯ নম্বর কেবিনে ওঠেন। পরের দিন সকাল ০৯.০০ ঘটিকার সময় লঞ্চের কেবিন বয় ভিকটিমের লাশ দেখতে পেয়ে পুলিশকে খবর দেয়। পিবিআই এর ক্রাইমসিন টিম ঘটনাস্থলে গিয়ে ভিকটিমের ফিঙ্গারপ্রিন্টের মাধ্যমে ভিকটিমের পরিচয় সনাক্ত করে। পুলিশ ভিকটিমের পরিবারকে বিষয়টি জানালে, ভিকটিমের ভাই মনির হোসেন এসে লাশ শনাক্ত করেন। লঞ্চের বুকিং রেজিস্টারে প্রতিবেশী জাহাঙ্গীরের নামের পাশে ভিকটিমের মোবাইল নম্বর লেখা ছিল। নিহত লিলুফা বেগমের সাথে তার প্রতিবেশী জাহাঙ্গীরের সখ্যতা থাকায় ভিকটিমের হত্যাকাণ্ডের ব্যাপারে প্রতিবেশী জাহাঙ্গীর জড়িত থাকতে পারে বলে এজাহারে উল্লেখ করে ২০১৯ সালের ১৮ জুন ভিকটিমের ভাই মনির হোসেন বাদী হয়ে দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থানায় ধারা-৩০২/২০১/৩৪ দন্ডবিধি আইনে হত্যা মামলা দায়ের করেন। পুলিশ এক মাস তদন্ত করে। মামলাটি পিবিআই এর সিডিউলভুক্ত হওয়ায় ২০১৯ সালের ১৮ জুলাই পিবিআই ঢাকা জেলা স্ব-উদ্যোগে মামলাটির তদন্তভার গ্রহণ করে।

পিবিআই প্রধান অ্যাডিশনাল আইজিপি জনাব বনজ কুমার মজুমদার, বিপিএম (বার), পিপিএম মহোদয়ের দিক-নির্দেশনায়
এবং পিবিআই ঢাকা জেলার ইউনিট ইনচার্জ পুলিশ সুপার জনাব মোঃ কুদরত-ই-খুদা এর তত্ত্ববধানে তদন্তকারী কর্মকর্তা এসআই মোঃ সালেহ ইমরান বিপিএম-সেবা মামলাটির তদন্তভার গ্রহণ করে মামলাটির রহস্য উদঘটন করেন।

তথ্য প্রযুক্তি ও গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা এসআই সালেহ ইমরান মামলার এজাহারে উল্লেখিত
ভিকটিমের প্রতিবেশী জাহাঙ্গীর এর ব্যাপারে বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করেন। সে ঘটনার সাথে জড়িত নয় মর্মে প্রতীয়মান হওয়ায় তিনি ভিকটিমের অন্যান্য বিষয়ে ব্যাপক তদন্ত করতে থাকেন। তদন্তে ভিকটিমে সাথে একই গ্রামের ব্রুনাই প্রবাসী দেলোয়ার মিজির পরকীয়া সম্পর্কের বিষয়টি জানতে পারেন। তিনি দেলোয়ার মিজির পাসপোর্ট নম্বর সংগ্রহ করেন এবং জানতে পারে যে, তিনি ২০১৯ সালের ২৬ জুন ব্রুনাই চলে গেছেন। দীর্ঘ প্রায় সাড়ে চার বছর ধরে অপেক্ষার পর গত ২২ সেপ্টেম্বর ইমিগ্রেশন পুলিশের সহায়তায় ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে তাকে গ্রেফতার করা হয় এবং ০৭ দিনের রিমান্ডের আবেদনসহ বিজ্ঞ আদালতে সোপর্দ করা হয়। বিজ্ঞ আদালত আসামীর ০৩ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।

প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে তার সাথে থাকা মোবাইলের তথ্য-উপাত্ত সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করলে এক পর্যায়ে আসামী দেলোয়ার মিজি লিলুফা হত্যাকাণ্ডের দায় স্বীকার করে। সে জানায়, দেশে আসার কিছু দিন আগে সে তার এক আত্মীয়কে পাঠানো ভয়েস রেকর্ডেড মেসেজ এর মাধ্যমে ভিকটিম লিলুফা হত্যা মামলার খোঁজ খবর নিতে বলে এবং মামলা শেষ করতে যদি টাকা পয়সাও লাগে সেটার ব্যাপারে খোঁজ খবর নিতে বলে। দেশে আসলে সমস্যা হবে না এমন আশ্বাসে সে ব্রুনাই থেকে বাংলাদেশে আসে।

জিজ্ঞাসাবাদে আসামী দেলোয়ার মিজি আরো জানায়, ভিকটিম লিলুফা বেগমের স্বামী ২০১৫ সালে মারা যান। বাড়িতে তিনি
একাই থাকতেন। ২০১২ সালের দিকে ভিকটিমের বাড়িতে কাঠ মিস্ত্রীর কাজের সুবাদে তার সাথে ভিকটিমের পরিচয় হয়। ধীরে ধীরে তাদের মধ্যে সখ্যতা গড়ে উঠে। ২০১৭ সালে সে ব্রুনাই চলে গেলে ভিডিও কলের মাধ্যমে তাদের মধ্যে কথা বার্তা চলতে থাকে।

আসামী দেলোয়ার মিজি ২০১৯ সালের ২৮ এপ্রিল ২ মাসের ছুটিতে দেশে আসে। দেশে আসার পর সে ভিকটিম লিলুফার
সাথে একাধিকবার শারীরিক সম্পর্ক করে। ভিকটিম লিলুফা তাকে বিয়ের জন্য চাপ দিতে থাকে। সে ভিকটিম লিলুফাকে বিয়ে করবে বলে সময়ক্ষেপন করতে থাকলে ভিকটিম লিলুফা তার বাড়িতে গিয়ে উঠবে বলে হুমকি দিতে থাকে। দেলোয়ার মিজির বড় মেয়ের বিয়ের আয়োজন করা হলে ভিকটিম লিলুফা বেগম সেখানে গিয়ে সম্পর্কের বিষয়টি সবাইকে জানিয়ে দিবে বলে হুমকি দেয়।

দেলোয়ার মিজি ভিকটিমকে কিছুদিন অপেক্ষা করতে বলে এবং বিদেশ যাওয়ার আগেই তাকে বিয়ে করে যাবে বলে প্রতিশ্রুতি দিয়ে শান্ত করে। ভিকটিম লিলুফা আসামীর থেকে ১৩ বছরের বড় হওয়ায় দেলোয়ার মিজি এই বিয়েতে রাজী ছিলনা। আসামী মান সম্মানের কথা চিন্তা করে ভিকটিমকে হত্যার পরিকল্পনা করে। পরিকল্পনা মতো ২০১৯ সালের ১৬ জুন আসামী ভিকটিমকে বিয়ের কথা বলে ঢাকায় নিয়ে আসার জন্য ভিকটিমের প্রতিবেশী মুদির দোকানদার জাহাঙ্গীর এর নাম এবং ভিকটিমের মোবাইল নম্বর ব্যবহার করে মিতালি-৭ লঞ্চের ৩য় তলার এস-৩০৯ নম্বরের একটি সিংগেল কেবিন বুকিং করে। সে ভিকটিম লিলুফাকে হত্যা করে হত্যার দায়ভার জাহাঙ্গীর এর উপর সুকৌশলে চাপিয়ে দেওয়ার জন্যই জাহাঙ্গীরের নাম ব্যবহার করে। কারণ সে জাহাঙ্গীরের সাথে ভিকটিমের সখ্যতার বিষয়টি জানতো। পুলিশের সন্দেহ এড়ানোর জন্য সে তার নিজের মোবাইলটিও বাড়ীতে রেখে আসে।

Show More

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button