রাজধানীর খিলগাঁওয়ের তালতলা মার্কেটের পশ্চিম পাশে অবস্থিত স্কাই ভিউ নাজমা টাওয়ার। ১০ তলা এই ভবনের পুরোটাজুড়েই রেস্টুরেন্ট। ভবনটির দ্বিতীয় তলায় রয়েছে ডিগার নামে একটি রেস্টুরেন্ট। মাস খানেক আগে শর্ট সার্কিট থেকে এই রেস্টুরেন্টে আগুন লাগে। সেদিনের আগুন লাগার ঘটনা এখনো ভুলতে পারেননি ভবনটির অন্য একটি রেস্টুরেন্টের শেফ (বাবুর্চি)।
রোববার (৩ মার্চ) ঢাকা পোস্টের সঙ্গে সেদিনের অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরেন শেফ হাবিবুর রহমান (ছদ্মনাম)। হাবিব জানান, এখনো এক মাস পুরো হয়নি। ডিগার রেস্টুরেন্টে আগুন লাগে। আগুন লাগার কয়েক মিনিটের মাথায় নিরাপত্তাকর্মী লিফট বন্ধ করে দেন। আগুনটা লাগে নিচে। আমরা ওপর থেকে ধোঁয়া দেখছি। অথচ নিচে যে নামব সে উপায় নেই। কারণ লিফট বন্ধ। সিঁড়ি দিয়ে কজনই বা নামতে পারে। সেদিন মনে হচ্ছিল, লাফ দিয়ে নামা ছাড়া কোনো উপায় নেই। সেদিনের কথা মনে হলে এখনো গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে।
স্কাই ভিউ নাজমা টাওয়ারে রয়েছে মোট নয়টি রেস্টুরেন্ট। নিচ তলায় রয়েছে মিনিসোর শোরুম। সেখানে বাচ্চাদের বিভিন্ন পণ্য সামগ্রী বিক্রি করা হয়। এরপর দ্বিতীয় তলা থেকে শুরু রেস্টেুরেন্ট। এখানকার রেস্টুরেন্টের মধ্যে রয়েছে- ডিগার, ২৪কে, লাউঞ্জ ডি নোব, পিজ্জা টাউন, কাজ ক্যাফে রেস্টুরেন্ট, টাইম স্কয়ার ডাইন, কেপিয়া অন ৭, গ্রিন্ড হাউজ মিউজিক ক্যাপে ও স্কাই ভিউ লাউঞ্জ।
নান্দনিক এসব রেস্টুরেন্টে বাহারি রকমের দেশি-বিদেশি খাবার পাওয়া যায়। শহুরে জীবনের ছকে বাঁধা রুটিন থেকে অল্প সময়ের জন্য ছুটি নিয়ে অবসর কাটাতে অনেকে প্রিয়জন, আত্মীয়স্বজন বা বন্ধুদের নিয়ে চলে আসেন এসব রেস্টুরেন্টে। রেস্টুরেন্টে খেতে আসার পেছনে উপলক্ষ্যও থাকে অনেকের। কেউ জন্মদিন, কেউ নতুন চাকরি পাওয়া, ইনক্রিমেন্ট পাওয়া, বিবাহবার্ষিকী কিংবা বন্ধুদের বায়নায় পড়ে খাওয়াতে নিয়ে আসেন রেস্টুরেন্টে।
খিলগাঁওয়ের স্থানীয় লোকজন ও রেস্টুরেন্ট কর্মচারীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রতিদিন সকাল ১০টায় এসব রেস্টুরেন্ট খোলা হয়। দিনের বেলায় এসব রেস্টুরেন্টে খুব একটা মানুষের আনাগোনা দেখা যায় না। সন্ধ্যার পর থেকে মানুষ ভিড় করতে থাকে। সপ্তাহের শেষ কর্মদিবস এবং ছুটির দিনে প্রচুর মানুষ ভিড় জমায়।
স্কাই ভিউ নাজমা টাওয়ারের নিচতলায় কথা হয় মোহাম্মদ আসিফের সঙ্গে। তিনি বলেন, স্ত্রী বার্গার খেতে চাইল, নিয়ে আসলাম। মাঝে মাঝে আসা হয়। কিন্তু এখন এসব রেস্টুরেন্টে ঢুকতে ভয় হয়। কখন কী হয়। যে লিফট দেখলাম, তাতে মনে হলো তিনজনের বেশি নামতে পারব না। ধরুন, কোনো বিপদ হলো, তখন কী হবে?
সরেজমিনে দেখা গেছে, এ ভবনে অবস্থিত রেস্টুরেন্ট ওঠা ও নামার ক্ষেত্রে দুটি লিফট এবং একটি সিঁড়ি ব্যবহার করা হয়। একটি লিফটে তিনজন এবং অন্য লিফটে পাঁচ থেকে সাতজনের বেশি ওঠা-নামার ব্যবস্থা নেই। আর সিঁড়ি দিয়ে তিনজনের বেশি একসঙ্গে নিচে নামা সম্ভব নয়। আশার কথা হচ্ছে, এ ভবনের প্রায় প্রতিটি তলায় ফায়ার এক্সিট এবং ফায়ার হোজের ব্যবস্থা রয়েছে। তবে, ফায়ার হোজ চালু আছে নাকি অকেজো সে বিষয়ে কিছু বলতে পারেননি ভবনের নিরাপত্তাকর্মী কিংবা রেস্টুরেন্টের কোনো কর্মকর্তা। এ ভবনের সবচেয়ে ভয়ের দিক হচ্ছে, প্রায় প্রতিটি তলায় বিদ্যুতের তার অরক্ষিত অবস্থায় রয়েছে। যেটা থেকে যেকোনো সময় ঘটে যেতে পারে বড় ধরনের দুর্ঘটনা।
এছাড়া, এখানকার প্রতিটি তলায় সব রেস্টুরেন্ট আলাদা আলাদা সিলিন্ডার ব্যবহার করে। এদের মধ্যে কয়েকটি রেস্টুরেন্ট কাজ শেষে রাতে নিচ তলার গোডাউনে সিলিন্ডার রেখে যায় বলে জানা যায়। অবশ্য সেটি সাম্প্রতিক সময়ের আগুন লাগার ঘটনাকে কেন্দ্র করেই।
নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ করে ভবনের এক নিরাপত্তাকর্মী বলেন, সব নিরাপত্তা আছে। কিন্তু ভয়টা হচ্ছে, যদি কোনো ঘটনা ঘটে। রেস্টুরেন্টে যদি মানুষ বেশি থাকে, তাহলে সবার নামাটা কঠিন হয়ে যাবে। শুনেছি, আমাদের মালিক নাকি আরও লিফট ও সিঁড়ির ব্যবস্থা করবে বলেছেন। কিন্তু সেই জায়গাটা কোথায়, সেটিই তো দেখছি না।
স্কাই ভিউ লাউঞ্জের কর্মচারী হানিফ বলেন, আমাদের সিলিন্ডার রান্না ঘরে থাকে। বিভিন্ন জায়গায় আগুন লাগছে, ভয় হয় কখন কী হয়। আমরা প্রতিদিন বের হওয়ার সময় চুলা বন্ধ করে সিলিন্ডার নিরাপদ দূরত্বে রেখে যাই। তারপরও বিপদ যে কবে আসে… এ বিষয়ে আরও সচেতনতা বাড়ানো দরকার।
ডিগার রেস্টুরেন্টের কর্মচারী আব্দুল কাহার বলেন, কিছুদিন আগে আমাদের এখানে যে আগুন লেগেছে, সেটি শর্ট সার্কিট থেকে, সিলিন্ডার থেকে নয়। আমাদের সিলিন্ডার নিরাপদ দূরত্বে আছে।
রেস্টুরেন্টের কয়েকজন কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এ ভবনের নয়টি রেস্টুরেন্টে একশ’র বেশি লোক কাজ করেন। তাদের মধ্যে প্রায় ৩০ বা তার চেয়ে বেশি কর্মী রাতে রেস্টুরেন্টেই থাকেন।
স্কাই ভিউ নাজমা টাওয়ারের পাশেই ন্যাশনাল আইডিয়াল স্কুল। তার পাশে ফুটপাতের এক ভ্রাম্যমাণ ব্যবসায়ী শাকিল হোসেন বলেন, এখন গরম চলে আসছে। যে পরিমাণ রেস্টুরেন্ট হইছে, কহন যে কী হয় আল্লাহ বলতে পারেন। সারাদিন তো চুলা জ্বলে। ভয়টা হলো… সিলিন্ডার কখন ব্লাস্ট হয়।
স্কাই ভিউ নাজমা টাওয়ারের দায়িত্বে থাকা স্কাই ভিউ ফাউন্ডেশনের ডিরেক্টর আল আমিন ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমাদের এটা বাণিজ্যিক ভবন। আমাদের এখানে সবকিছুর ব্যবস্থা আছে। ফায়ার এক্সিট আছে, ফায়ার হোজ আছে। ফ্লোরে ফ্লোরে পানির ব্যবস্থা আছে। আমাদের গ্যাস ব্যাংক নিচে। সব সিলিন্ডার নিচে আনার ব্যবস্থা আমরা করে ফেলব। আমরা আরও দুটি সিঁড়ি করে ফেলব। এ সপ্তাহের মধ্যে হয়ে যাবে।
অরক্ষিত বিদ্যুতের তারের বিষয়ে জানতে চাইলে আল আমিন বলেন, এটা আমি নিজে ভিজিট করে দেখেছি। আজকেই এটাকে নিরাপদ করে ফেলব। কালকে আসলে আর দেখতে পাবেন না। বেইলি রোডে যে ঘটনা ঘটেছে, এটা দেখে সবার মধ্যে ভয় কাজ করছে। আমাদের যেসব সমস্যা আছে, দ্রুত সমাধান করে ফেলব।
গত বৃহস্পতিবার রাজধানীর বেইলি রোডের গ্রিন কোজি ভবনে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে এ পর্যন্ত ৪৬ জনের মৃত্যু হয়েছে। গুরুতর আহত হয়ে বেশ কয়েকজন এখনো হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছেন।