১৬ বছর কলেজে অনুপস্থিত থাকলেও ফের নিয়োগ পাচ্ছেন বরখাস্তকৃত তিন শিক্ষক!
মোহনা ডেস্ক : এক বা দুই বছর নয় দীর্ঘ ১৬ বছর কলেজে অনুপস্থিত থাকার তথ্য গোপন করে ফের নিয়োগ পাওয়া জন্য দেন দরবার চালিয়ে যাওয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে তিন শিক্ষকের বিরুদ্ধে। তাদের সহযোগিতা করছেন কলেজের বৈষ্যম্য বিরোধী ছাত্র-জনতা আন্দোলনের ঘটনায় দায়ের করা মামলার আসামি হওয়া এক শিক্ষকের বিরুদ্ধে। ঘটনাটি ঘটেছে গাজীপুরের কালিয়াকৈর উপজেলার চন্দ্রা ত্রিমোড় এলাকার জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু সরকারি কলেজে। তিন শিক্ষক নিয়োগের চেষ্টার বিষয়টি দুর্নীতি দমন কমিশনের মাধ্যমে তদন্ত করে জড়িতদের বিরোদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার দাবি সাধারণ শিক্ষকদের।
কলেজের বিভিন্ন অনিয়ম ও দুর্নীতির খবর পেয়ে মঙ্গলবার কলেজে আকস্মিক পরিদর্শনে যান কালিয়াকৈর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ কাউছার আহাম্মেদ। এসময়ে তার সঙ্গে এনএসআই ও ডিএসবির কর্মকর্তারাও উপস্থিত ছিলেন। বরখাস্তকৃত ওই তিন শিক্ষক হলেন, ভূগোল বিভাগের প্রভাষক মো. জাহাঙ্গীর আলম, ফিন্যান্স এন্ড ব্যাংকিং বিষয়ে প্রভাষক কিশোর কুমার সরকার ও ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিষয়ে ফাতেমা পারভীন।
কলেজ কর্তৃপক্ষ সূত্রে জানা গেছে, কালিয়াকৈর উপজেলার চন্দ্রা ত্রিমোড় এলাকায় ১৯৯৭ সালে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু সরকারি কলেজটি প্রতিষ্ঠিত হয়। ২০১৬ সালে সরকারিকরণ করা হয়। বর্তমানের এই কলেজের উচ্চ মাধ্যমিক, ডিগ্রী, অনার্স এবং উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের শাখা রয়েছে। কলেজে একজন অধ্যক্ষসহ ৫৭ জন শিক্ষক ও ২৩ কর্মকর্তা ও কর্মচারী রয়েছে। এখানে শিক্ষার্থী সংখ্যা প্রায় সাড়ে ৪ হাজার। কলেজটি প্রতিষ্ঠার পর ১৯৯৭ সালের ১১ সেপ্টেম্বর মো. জাহাঙ্গীর আলম ভূগোল বিভাগের প্রভাষক হিসাবে যোগদেন। এরপর ২০০১ সালের অক্টোবর মাসে এমপিওভুক্ত হয়ে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালনকালে ২০০৪ সালের ১৮ জুন নিয়োগ পরীক্ষার মাধ্যমে তিনি উপাধ্যক্ষ পদে যোগদান করেন। একই বছরে ২৩ জুন গভর্ণিং বডির সভাপতি বরাবর আবেদনের মাধ্যমে প্রভাষক পদ থেকে পদত্যাগ করেন। অফিস তথ্যমতে, তিনি ২০০৮ সালের ১৯ এপ্রিল পর্যন্ত উপাধ্যক্ষ হিসেবে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করে পরবর্তীতে কলেজে উপস্থিত থেকে আর কোন কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করেননি। বিভিন্ন অনিয়মের অভিযোগে কলেজ গভর্নিং বডি ২০০৯ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি তাকে উপধ্যক্ষ পদ থেকে সাময়িক বরখাস্ত করে এবং জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের বিধি মোতাবেক গঠিত তদন্ত কমিটি তার বিরুদ্ধে প্রতিবেদন দাখিল করে। ২০১১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে প্রভাষক পদের এমপিওভুক্তিও বাতিল করা হয়। এছাড়া কলেজটি জাতীয়করণের জন্য ২০১৩ সালের ২৯ জুন পরিদর্শনকালেও তিনি উপস্থিত ছিলেন না। এরপর থেকে তিনি আর কলেজে যায়নি বলে জানা গেছে।
এছাড়া কিশোর কুমার সরকার ২০০৪ সালে ফিন্যান্স এন্ড ব্যাংকিং বিষয়ে প্রভাষক হিসাবে যোগদান করেন। নিয়োগের পর তিনি প্রায় দুই মাস অনিয়মিতভাবে কলেজে উপস্থিত থাকেন। শিক্ষক কর্মচারীদের এমপিওভুক্ত করনের সময়ও তিনি (১ জুলাই ২০০৮ হতে ১৮ জুলাই ২০১০পর্যন্ত ) কলেজে নিয়মিত না আসা এবং তিনি অন্যত্র চাকরি করার কারণে তার এমপিও হয়নি। তাকে কারন দর্শানোসহ পরবর্তী ব্যবস্থা নেয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার হয়। নোটিসের জবাব না দেয়ায় পরিচালনা পর্ষদের সিদ্ধান্তে ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় বিধি মোতাবেক তদন্ত কমিটি গঠিত হয়। তদন্ত কমিটি যথাযথ তদন্ত কার্যক্রম সম্পন্ন করে এবং তদন্ত কমিটির সিদ্ধান্তে কিশোর কুমার সরকারকে প্রভাষক পদ থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়।
এছাড়া কলেজের ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিষয়ে প্রভাষক ফাতেমা পারভীনকে অতিরিক্ত শিক্ষক হিসাবে ২০০৪ সালের ২৩ জুন নিয়োগ দেয়া হয়। নিয়োগের পর থেকেই তিনি কলেজ নিয়মিতভাবে উপস্থিত থাকতেন না। পরে কলেজ পরিচালনা পর্ষদের তাকে সাময়িক বরখাস্ত করে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেয়। নোটিশের জাবাব না পেয়ে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের বিধি মোতাবেক ২০১১ সালে ১৩ আগস্ট প্রভাষকের পদ থেকে তাকে অব্যাহতি দেয়া হয়।
কলেজের শিক্ষক ও কর্মচারীরা জানান,ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের সময় ক্ষমতার অপব্যবহার করে ওই তিন শিক্ষক কলেজে নাম অন্তভূক্তি করেছে এবং নানাভাবে ক্ষমতার অপব্যবহার করেছে। কলেজে কোনো ক্লাস ও পরীক্ষার কাযক্রমে অংশগ্রহণ করেননি। দীর্ঘ ১৬ বছর কলেজে উপস্থিত না হয়েও গোপনে কলেজের জাতীয় করনে তালিকায় ওই তিনজনের নাম অন্তভূক্তি করেন। এসব কাজে তাদের সহযোগিতা করেছেন কলেজের অর্থনীতি বিভাগের প্রভাষক আব্দুর রাজ্জাক। আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে অবৈধ পন্থায় নিয়োগ নেয়া সাবেক ভাইস প্রিন্সিপালকে ভুগোল বিষয়ে প্রভাষকের পদ সৃষ্টি করে। কলেজ সরকারি হওয়ার পর সরকারি চাকরির আশায় সম্প্রতি আদালতে মামলাও করেছেন বরখাস্তকৃত তিন শিক্ষক। মামলার বিষয় গোপন রেখে তারা শিক্ষা মন্ত্রনালয়ে চাকরি ফিরে পাওয়ার জন্য নানা অপকৌশল চালিয়ে যাচ্ছেন। তাদের আবেদনের প্রেক্ষিতে গত ১ জানুয়ারি মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক (কলেজ-১) মুহাম্মদ সফিউল বশর স্বাক্ষরিত একটি পত্রে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু কলেজের তিন জন শিক্ষকের এডহক নিয়োগ সংক্রান্ত সকাল কাগজপত্রসহ অধক্ষকে তলব করেছেন।
বরখাস্তকৃত তিন শিক্ষক কলেজ সরকারি হওয়ার পর চাকরি ফিরে পাওয়ার আশায় সম্প্রতি আদালতে মামলা করেছেন। তিনটি মামলা এখনো চলমান। সরকারের পট পরিবর্তনের সুযোগে তথ্য গোপন করে মন্ত্রনালয়ের মাধ্যমে এডহক নিয়োগ নেয়ার চেষ্টা করছেন। দুর্নীতি দমন কমিশনের মাধ্যমে তদন্ত করে প্রকৃত তথ্য উদঘাটনের মাধ্যমে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়ার দাবি জানিয়েছে কর্মরত শিক্ষক-কর্মচারী ও সংশ্লিষ্টরা। দীর্ঘদিন চাকরি করছেন এমন কয়েকজন এখনো সরকারি এডহক নিয়োগ হয়নি আইনি জটিলতায় অথচ এভাবে বছরের পর বছর চাকরি না করেও অবৈধ পন্থায় শৈরাচারের দোসররাই এখন বৈষম্যের শিকার দাবি করে চাকুরী পাওয়ার দৌঁড়ে এগিয়ে থাকায় চাঞ্চল্য ও উত্তেজনা দেখা দিয়েছে।
সাবেক অধক্ষ মোবারক হোসেন জানান, ওই তিন জন যেহেতু বরখাস্ত তাই তাদের নাম বা পদ সৃজনের জন্য শিক্ষা অধিদপ্তরে পাঠানো হয়নি। তারপরও তারা বিগত ফ্যাসিস্ট সরকারের সময় ক্ষমতার অপব্যবহার করে স্বাক্ষর জাল জালিয়াতির মাধ্যমে এবং ২০১৩ সালের কলেজ পরিদর্শন প্রতিবেদন জালিয়াতির মাধ্যমে পদ সৃজন করেন। পরবর্তীতে তাদের এডহক নিয়োগা না দেওয়ার জন্য সুপারিশ করেন কলেজ কর্তৃপক্ষ।
কলেজের অধ্যক্ষ প্রফেসর সুফিয়া বেগম বলেন, ‘মাউশি থেকে কলেজের রেজুলেশনসহ আমাকে তলব করেছে। আমি কলেজে যেসকল কাগজপত্রগুলি পাবো সেগুলিই উপস্থাপন করতে পারবো। এই চাকরি সংক্রান্ত বিষয়ে মামলা চলমান আছে। মামলার প্রেক্ষিতে কলেজ কর্তৃপক্ষ এতোদিন যে জবাব দিয়েছে আমি তার বাহিরে যেতে পারবো না। আমি ওই তিন শিক্ষককে ব্যক্তিগতভাবে চিনি না।’