আরকান রাজ্য রাষ্ট্র রূপে আবির্ভূত হলে, বদলে যাবে আঞ্চলিক রাজনীতি

শাহীন রাজা: মিয়ানমারের আরাকানে নতুন রাষ্ট্রের উদ্ভব হলে আঞ্চলিক ভারসাম্যে নতুন মোড় নেবে। পুরানো সম্পর্কের ক্ষেত্রে নতুন মাত্রা সৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। আমেরিকা ও তার দীর্ঘদিনের মিত্র ইউরোপীয় ইউনিয়ন নতুন রাষ্ট্রে নিজ আধিপত্য বজায় রাখার চেষ্টা চালাবে। কিংবা এই অঞ্চলে ‘কসোভা’ মডেলে আরেকটা নতুন রাষ্ট্র সৃষ্টির পরিকল্পনা তাদের ! তবে এব্যাপারে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নতুন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প কতোটা উৎসাহ দেখাবে তা এই মূহুর্তে স্পষ্ট নয়।
চীন মিয়ানমারের জান্তা সরকারের ঘনিষ্ঠ সহযোগী। তারপরও আরকান বিদ্রোহীদের সাথে সম্পর্ক বজায় রেখেছে। ভবিষ্যতে যেন প্রতিপক্ষ শক্তি কোন রাজনৈতিক সুবিধা নিতে না পারে। চীন ইতিমধ্যেই আদর্শিক এবং পুরানো বন্ধু রাশিয়ার সাথে আবার বন্ধুত্ব নবায়ন করে নিয়েছে। আঞ্চলিক রাজনীতির স্বার্থে রাশিয়ার মধ্যস্ততায় ভারতের সাথেও সম্পর্কের উদ্যোগ নিয়েছে। সম্প্রতি এই সম্পর্কের বেশ অগ্রগতি হয়েছে। এবং উভয় দেশেই ‘ব্রিক’জোটের সদস্য !
চীন অনেকদিন ধরেই এই অঞ্চলের নেতৃত্ব নেওয়ার পথে হাটছিল। যার প্রেক্ষিতে সিল্ক রোড প্রকল্প এবং ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড কর্মসূচি গ্রহণ করে। অবশেষে বিশ্ব রাজনীতিতে আধিপত্য রূপায়নের লক্ষ্যে চীন,রাশিয়া এবং ইরানের উদ্যোগে ‘ব্রিকস’ জোট গঠন হয়। এখন এটা বাস্তবায়নে মহাসড়কে নেমেছে। রাশিয়ার উদ্যোগে পরবর্তীতে ভারত-ও এই জোটে অন্তর্ভুক্ত হয়।
সীমান্তে সেনা মোতায়েন নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে চীনের সাথে ভারতের সম্পর্ক ছিল নিম্নমুখী। বিশেষ করে লাদাখ সীমানা থেকে চীনের সেনাবাহিনী সড়িয়ে নেয়ার ব্যাপারে ভারত ছিল সরব। এই ব্যাপারে চীন কখনও কোন আগ্রহ দেখায়নি। কিন্তু পুতিনের মধ্যস্থতায় তা সফল হয়েছে।
সম্প্রতি উজবেকিস্তানের রাজধানী সমরখন্দে অনুষ্ঠিত সামিট ” সাংহাই কোঅপারেশন অরগানাইজেশান ( এসসিও )। ” চীন ও ভারতে বন্ধুত্বের চলা অনেকদুর এগিয়ে নিয়েছে।
যার প্রথম ধাপ হিসেবে ভারত চীনের সাথে ‘ ইউয়ান ‘ ব্যবহারের মাধ্যমে বানিজ্য সম্পর্ক গড়ে তুলবে। এছাড়াও ভারত তার বিচ্ছিন্নবাদী বিদ্রোহী দমনেও মিয়ানমারের সহযোগিতা প্রয়োজন। চীনের সাথে একটা সুসম্পর্ক থাকলেই তা সম্ভব।
এছাড়া রাখাইন অঞ্চলে চীন ইপিজেড অঞ্চল গড়ে তুলছে। ভারত এখান থেকেও বানিজ্যিক সুবিধা নিতে চায়। একারণেও ভারত চীনের সাথে সুসম্পর্ক চায়।
এদিকে পশ্চিমা বিশ্ব মনে করে, ভারত মহাসাগর দিয়ে ৬০ শতাংশ বানিজ্য হয়। এই রুটটি নিয়ন্ত্রণে রাখা তাদের জন্য খুবই জরুরী। এর নিয়ন্ত্রণ কোনভাবেই হাত ছাড়া করা যাবে না। চীনের আগ্রাসন প্রতিহত করতে হলে এখনই কিছু একটা করতে হবে। এই প্রতিহত করার অংশ হিসেবে রোহিঙ্গা এবং রাখাইন বিদ্রোহীদের বেছে নিয়েছে। যেমনটা তালেবান বিদ্রোহের মধ্য দিয়ে চীনের সিল্ক রোড উদ্যোগ আটকে দেয়া হয়েছিল। তবে এখানটায় ব্যতিক্রম। এখানে বলকান অঞ্চলে যেমনটা ‘কসোভো ‘ নামের একটা রাষ্ট্রের অভ্যুদয় ঘটিয়েছে। তেমনটা এখানেও। রাখাইন রাষ্ট্র সৃষ্টির মধ্য দিয়ে এখানকার নিয়ন্ত্রণ নিতে চাইছে,পশ্চিমা বিশ্ব। তবে ট্রাম্প এব্যাপারে কতোটা আগ্রহ দেখাবে তা নিয়ে পশ্চিমা বিশ্বের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
পশ্চিমা বিশ্ব এই অঞ্চলের লোকদের উদ্বুদ্ধ করার জন্য দূর্নীতি মুক্ত গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের কথা সামনে নিয়ে আসবে। এর সাথে সাথে মুক্ত চিন্তা, মানবাধিকার এবং অবাধ তথ্য প্রবাহের বিষয়টি সামনে নিয়ে আসবে। একমাত্র ভারত ছাড়া রাশিয়া এবং চীন দুই দেশেই গণতন্ত্র নেই। স্থানীয় জনগণের কথা বলার অধিকার নেই বল্লেই চলে।
ভারতে ও গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা ক্রমশই ভেঙ্গে পড়ছে। বর্তমান সরকার, ধর্মীয় দর্শন প্রাধান্য দেওয়ায় ভারতের ভবিষ্যত তমাশাচ্ছন্ন। মানবিকতা ক্রমশই ক্ষুন্ন হচ্ছে।পশ্চিমা বিশ্বের পরিকল্পনা বাস্তবায়নে ২০২৩ সালে ৮ ডিসেম্বর আমেরিকার ‘আইন সভায়’ বার্মা অ্যাক্ট পাস হয়। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন সম্প্রতি তাঁর দেশের প্রতিরক্ষা বিভাগকে ৮১৭ বিলিয়ন ডলার দেওয়ার এক বিলে স্বাক্ষর করে সেটিকে আইনের মর্যাদা দিলেন। এনডিএএ নামে পরিচিত এই আইন মুখ্যত তাঁর দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়। কিন্তু এর বৈশ্বিক তাৎপর্য অনেক। বিশেষ করে দক্ষিণ এশিয়ায় এর প্রভাব হবে সরাসরি। কারণ, এবারের এই বরাদ্দপত্রে সংযুক্ত হয়েছে মিয়ানমারকেন্দ্রিক ‘বার্মা অ্যাক্ট’।
চলতি ডিসেম্বরে যুক্তরাষ্ট্রের সিনেটে ‘বার্মা অ্যাক্ট’ বিল পাস হয়। যুক্তরাষ্ট্রের চার্চগুলো এই বিল পাসের জন্য লাগাতার তদবির করে যাচ্ছিল। এই বিল এবং বাইডেন প্রশাসনের ২০২৩ সালের প্রতিরক্ষা বাজেটে তার অন্তর্ভুক্তি বাংলাদেশ, ভারতসহ এ অঞ্চলের মনোযোগ দাবি করে। বাইডেন প্রশাসনের এ রকম পদক্ষেপে দক্ষিণ এশিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের ‘মানবিক ও উন্নয়ন সহায়তা’র ধারায় অনেক পরিবর্তন আনতে পারে। যে পরিবর্তন কেবল মিয়ানমারে নয়, আশপাশের দেশগুলোয় ইউএসএইডের তৎপরতায়ও দেখা যেতে পারে।
পশ্চিমা বিশ্ব এখন দুঃসময়ে আছে। নবনির্বাচিত মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এইসব প্রকল্পে বিশ্বাসী নয়। তাঁর লক্ষ্য হচ্ছে পুঁজি আরোহন। কি করে বিশ্বের বড় শক্তির সাথে সম্পর্ক স্থাপনের মধ্য দিয়ে বানিজ্য করা যায়। তাই তিনি ইউএসএআইডি সংস্থার কার্যক্রম স্থগিত করে দিয়েছেন। তবে পাশাপাশি আমেরিকার পররাষ্ট্র নীতি নির্ধারণের ক্ষেত্রে ‘পেন্টাগন’-ও বড় ভুমিকা রাখে। তাই মার্কিন প্রেসিডেন্টের কথাই শেষ কথা নয়।
বর্তমান বাস্তবতা হচ্ছে, আরাকান আর্মি যে কোন সময় স্বাধীনতা ঘোষণা করতে পারে। এখানে একটা নতুন রাষ্ট্র গঠন হলে প্রথম প্রতিক্রিয়া দেখা দেবে বাংলাদেশে। কেমনা নব রাষ্ট্রের নিকটতম প্রতিবেশী হবে বাংলাদেশ। নব রাষ্ট্রের সরকার চীন না পশ্চিমা বিশ্বের বলয় ভুক্ত রাষ্ট্র হবে তা আগাম নির্ধারন করতে হবে বাংলাদেশের।