বেঙ্গালুরুতে প্রথমে ব্যাট করে ডেভিড ওয়ার্নার-মিচেল মার্শের সেঞ্চুরিতে ৩৬৭ রান করেছিল অস্ট্রেলিয়া। সেই লক্ষ্য তাড়া করে পাকিস্তান থেমে গেছে ৩০৫ রানে, অস্ট্রেলিয়া তুলে নিয়েছে টানা দ্বিতীয় জয়।
বিশ্বকাপের সবচেয়ে বেশি রান তাড়ার রেকর্ড কদিন আগেই লিখেছিল পাকিস্তান। শ্রীলংকার বিপক্ষে গড়া সেই ইতিহাস ছাড়িয়ে অস্ট্রেলিয়ার সাথে আরও বড় কিছু করতে হতো। ৩৬৮ রানের পাহাড় তাড়া করে পাকিস্তান অনেকটা সময় পথেই ছিল। ৬২ রানের ব্যবধানটা আসলে বলছে না, অন্তত ৪০ ওভার পর্যন্তও দুর্দান্ত একটা থ্রিলারের আশা ছিল বেঙ্গালুরুতে।
ম্যাচটা আসলে পাকিস্তান কোথায় হেরে গেল, ম্যাচ শেষে সেই প্রশ্নের উত্তরে সবার আগে আসবে উসামা মীরের সুযোগ হাতছাড়া করাটা। অস্ট্রেলিয়ার ইনিংসের কেবল পঞ্চম ওভার তখন। ডেভিড ওয়ার্নারের রান তখন মাত্র ১০। শাহীন শাহ আফ্রিদির বলটা পুল করতে গিয়ে ক্যাচ তুলে দিলেন মিড অনে। যে কোনো পেশাদার ক্রিকেটারের ক্যাচটা মিস করা প্রায় অমার্জনীয় অপরাধ। শাহীনও উদযাপনের জন্য প্রস্তুত হচ্ছিলেন। কিন্তু পাকিস্তানকে হতভম্ব করে উসামা ক্যাচটা ফেলে দিলেন। ১০ রানে জীবন পাওয়া ওয়ার্নার শেষ পর্যন্ত করলেন ১৬৩। সেঞ্চুরির পরেও একবার জীবন পেয়েছিলেন অবশ্য। তবে ম্যাচের শুরুতে ওই ক্যাচ মিসটাই সম্ভবত বেঙ্গালুরুতে ব্যবধান লিখে দিয়েছে গতকাল।
অথচ এই ক্যাচ মিসের আফসোস করতে পারতো অস্ট্রেলিয়াও। পুরো টুর্নামেন্টে তাদের ক্যাচিং ছিল যাচ্ছেতাই। আজ ২৭ রানের সময় আব্দুল্লাহ শফিকের ক্যাচ ফেলে দেন শন অ্যাবট। বাউন্ডারি লাইনে ক্যাচটা তো ধরতে পারেনইনি, উলটো বানিয়ে দিয়েছেন ছয়। আরেক ওপেনার ইমাম উল হক ৪৮ রানে গ্লেন ম্যাক্সওয়েলকে পুল করতে গিয়ে ক্যাচ তুলে দিয়েছিলেন, কিন্তু কামিন্স সেটা হাতে জমাতে পারেননি। দুই ওপেনার সুযোগ কাজে লাগিয়ে অনেক বড় কিছুর আভাস দিচ্ছিলেন, পাকিস্তানের স্বপ্নের পালে লাগতে শুরু করেছিল জোর হওয়া। শফিক-ইমামের ব্যাটে ১৭ ওভারের মধ্যে চলে আসে ১০০ রান। কিন্তু দুজন ১৩৪ রান তুলে যখন কামিন্সের কপালে ভাঁজ জমিয়ে দিয়েছেন তখনই মার্কাস স্টয়নিসের জোড়া আঘাত। প্রথমে তার বলটা সামনে এসে পুল করতে গিয়ে মিড উইকেটে তুলে দেন শফিক, এবার ভুল করেননি ম্যাক্সওয়েল। শফিক ফেরেন ৬১ বলে ৬৪ রান করে। এক ওভার পর আবার স্টয়নিসের আঘাত, এবার তার বল কাট করতে গিয়ে ডিপ থার্ডম্যানে স্টার্ককে ক্যাচ তুলে দেন ইমাম, ৭১ বলে ৭০ রানে শেষ হয় তার ইনিংস।
কিন্তু তারপরও পাকিস্তানের সুযোগ ছিল। অধিনায়ক বাবর আজমের কাছ থেকে দরকার ছিল ক্যাপ্টেনস নকের। কিন্তু বাবরকে ১৮ রানে ফিরিয়ে দিলেন অ্যাডাম জ্যাম্পা। এই জ্যাম্পার কথা এত পরে আসাটা আসলে অন্যায়ই। বাবরকে ফিরিয়ে যদি বড় ধাক্কা দেন, পরে তার জোড়া আঘাত ম্যাচ থেকেই ছিটকে দিয়েছে পাকিস্তানকে। ম্যাচসেরা হয়তো ওয়ার্নারই, তবে পার্শ্বনায়ক হিসেবে একটা পুরস্কার জ্যাম্পারও প্রাপ্য।
তৃতীয় স্পেলে যখন জ্যাম্পা আবারে এলেন, তখন তার বাকি তিন ওভার। ১২ ওভারে পাকিস্তানের জয়ের জন্য দরকার ১০৩ রান, হাতে ৬ উইকেট। পাকিস্তানের জন্য খুবই সম্ভব একটা সমীকরণ। ইফতিখার আহমেদ এর মধ্যে তিন ছয় মেরে বড় হুমকি অস্ট্রেলিয়ার সামনে। তবে জ্যাম্পার মনে ছিল অন্যকিছু। ওই ওভারেই ফেরালেন ইফতিখারকে। আম্পায়ার আউট দেননি, এলবিডাব্লিউর জন্য অস্ট্রেলিয়ার রিভিউটা দারুণই ছিল। ইফতিখারের ওই আউটেই হয়তো ম্যাচ ঘুরে যায় অনেকটা। আর জ্যাম্পার পরের ওভারে সম্ভবত সেটা ঘুরে যায় পুরোপুরি।
এবার শিকার মোহাম্মদ রিজওয়ান। শ্রীলংকার সাথে ম্যাচ জিতিয়ে মাঠ ছাড়ার স্মৃতিটা যার একদম তরতাজা। ৪৬ রান করে তিনিও তখন একই ইতিহাস পুনরাবৃত্তির আশায়। এবারও এলবিডাব্লিউতে তাকে ফেরালেন জাম্পা। ৬ উইকেট হারিয়ে ম্যাচ থেকে প্রায় ছিটকে পড়লো পাকিস্তান।
বাকিটা আসলে স্রেফ আনুষ্ঠানিকতা। মোহাম্মদ নওয়াজ, শাহীন শাহ আফ্রিদিরা শেষ দিকে এসে পরাজয়ের ব্যবধান খানিকটা কমিয়েছেন। নওয়াজ যদি একা কিছু করতেও পারেন, তাকেও স্টাম্পড করে কফিনে শেষ পেরেক ঠুকে দিয়েছেন জাম্পাই। পুরো ৫০ ওভার খেলার আগেই তাই মাঠ ছেড়েছে পাকিস্তান।
পাকিস্তানের শুরু আর অস্ট্রেলিয়ার শুরুতে মিল আছে বেশ। চার ওপেনারই দারুণ খেলেছেন আজ। তবে মিচেল মার্শ ও ওয়ার্নার যেটা করেছেন, সেটা আসলে ম্যাচের গল্পটা শুরুতেই অনেকখানি লিখে দিয়েছে। সেই গল্পের শুরু ইনিংসের নবম ওভারে হারিস রউফের ওভার থেকে। প্রথম বলে চারের পর এর পরের বলেই রউফকে চিন্নাস্বামীর ছাদের ওপর আছড়ে ফেলেছিলেন ওয়ার্নার। মার্শ এরপর স্ট্রাইক পেয়ে ওই ওভারেই শেষ তিন বলে নিয়েছিলেন তিন চার। এক ওভারেই হারিস দেন ২৪।
এরপর ওয়ার্নার-মার্শ কচুকাটা করেছেন কমবেশি সবাইকেই। হারিসের ওপর দিয়েই ঝড়টা বেশি গেছে, তার প্রথম ৩ ওভার থেকে এসেছিল ৪৭ রান।
মার্শ ও ওয়ার্নারের স্টিমরোলার এরপর শুধু চলেছেই। শেষ পর্যন্ত মার্শের আউটে ভেঙেছে দুজনের ২৫৯ রানের জুটি। কাকতালীয়ই বটে, যে মীর আগে সহজ ক্যাচ ধরতে পারেননি , সেই মীরই পরে বেশ ভালো ক্যাচ নেন মার্শের। তার আগে অবশ্য মার্শ ও ওয়ার্নার দুজনেরই পর পর দুই বলে সেঞ্চুরি হয়ে গেছে। দুজনেই বুনো উদযাপনে বুঝিয়ে দিয়েছেন, কতটা দরকার ছিল তাদের। বিশ্বকাপের ইতিহাসে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ওপেনিং জুটিও হয়ে গেছে এর মধ্যে। ওদিকে ওয়ার্নার পাকিস্তানের বিপক্ষে ওয়ানডেতে টানা চতুর্থ সেঞ্চুরি তুলে নেওয়ার পর পেরিয়ে গেছেন ১৫০। শেষ পর্যন্ত আউট হয়েছেন ১২৪ বলে ১৬৩ রান করে সেই হারিসের বলেই, তার আগে হয়ে গেছে এই বিশ্বকাপের সর্বোচ্চ ব্যক্তিগত ইনিংস।
ওয়ার্নার যতক্ষণ ছিলেন, ৪০০ মনে হচ্ছিল খুবই সম্ভব। কিন্তু তার আউটের পরেই পথ হারিয়ে ফেলেছিল অস্ট্রেলিয়া, পাকিস্তান বোলাররা দেরিতে হলেও ফিরেছিলেন ম্যাচে। ইংলিস, স্টয়নিস, লাবুশেন কেউই পরিস্থিতির দাবি মেটানো ক্যামিও খেলতে পারেননি। পুরো ৫০ ওভার খেলেও অস্ট্রেলিয়া তাই ৩৬৭ রানের বেশি করতে পারেনি। ওয়ার্নার আউট হওয়ার পর ৪৬ বল খেলে অস্ট্রেলিয়া করেছিল মাত্র ৪২ রান, হারিয়েছিল আরও ৫ উইকেট। শুরুর দুঃস্বপ্নের পর হারিস নিয়েছেন তিন উইকেট। তবে শেষ ওভারে দুই উইকেট নিয়ে পাকিস্তানের বোলিংয়ের নায়ক ছিলেন শাহীন আফ্রিদি। পাঁচ উইকেট নিয়ে তার বোলিং ফিগার ছিল শেষ পর্যন্ত ১০-১-৫৪-৫, উসামা শুরুর ক্যাচটা নিলে সেটা হতে পারত আরও উজ্জ্বল।
শেষ পর্যন্ত অবশ্য এসব আফসোসই হয়ে থেকেছে পাকিস্তানের কাছে। ভারতের পর এবার তারা হারলো অজিদের কাছেও। অন্যদিকে টানা দুই হারের পর ধুঁকতে থাকা অস্ট্রেলিয়া শ্রীলংকা ও পাকিস্তানকে হারিয়ে জানান দিয়েছে, বিশ্বকাপে হলুদ উৎসব দেখা যেতে পারে এবারও।
সংক্ষিপ্ত স্কোর :
অস্ট্রেলিয়া ৫০ ওভারে ৩৬৭/৯ (ওয়ার্নার ১৬৩, মার্শ ১২১; শাহীন ৫/৫৪, হারিস ৩/৮৩)
পাকিস্তান ৪৫.৩ ওভারে ৩০৫ (ইমাম ৭০, শফিক ৬৪; জ্যাম্পা ৪/৫৩, স্টয়নিস ২/৪০)
ফল: অস্ট্রেলিয়া ৬২ রানে জয়ী