আরসার আস্তানায় অভিযান, অস্ত্র, গ্রেনেড ও রকেট সেল উদ্ধার
আরসার আস্তানায় বিপুল পরিমাণ অস্ত্র, গ্রেনেড ও রকেট সেল উদ্ধার করার ঘটনা কিভাবে পরিচালনা করেছে র্যাপিড এ্যাকশন ব্যাটালিয়ন, সেটা গণমাধ্যমকে আনুষ্ঠানিকভাবে জানানো হয়েছে। নিচে বিস্তারিত তুলে ধরা হলো :
র্যাপিড এ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব) প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে সব সময় বিভিন্ন ধরণের অপরাধীদের গ্রেফতারের ক্ষেত্রে অত্যন্ত অগ্রণী ভূমিকা পালন করে আসছে। সৃষ্টিকাল থেকে এই বাহিনী জঙ্গি, মাদক ব্যবসায়ী, জালনোট ব্যবসায়ী, অপহরণকারী, ছিনতাইকারী, মানবপাচারকারী, প্রতারক, চাঁদাবাজ, বিভিন্ন মামলার আসামি, শীর্ষ সন্ত্রাসী এবং অবৈধ অস্ত্রধারী সন্ত্রাসী গ্রেফতার করে সাধারণ জনগণের মনে আস্থা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে।
বর্তমানে রোহিঙ্গা ক্যাম্পের মূর্তিমান আতঙ্কের নাম আরসা’র সন্ত্রাসী গোষ্ঠী। আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে হত্যা, অপহরণ, ডাকাতি, চাঁদাবাজি, অগ্নিসংযোগ ও মাদকসহ বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের সাথে জড়িত রয়েছে আরসা’র সন্ত্রাসী গোষ্ঠী। এই আরসা সন্ত্রাসীরা রোহিঙ্গা ক্যাম্পে সাধারণ রোহিঙ্গাদের উপর প্রভাব খাটায়। কেউ আরসার অনৈতিক কর্মকান্ডের বিরোধিতা করলে কিংবা তাদের কথা না শুনলে তারা বেশিরভাগই অপহরণ ও হত্যা শিকার হয়। রোহিঙ্গা নাগরিক ফেরত পাঠানোর পক্ষে কাজ করায় ২০২১ সালে রোহিঙ্গা নেতা মাস্টার মহিবুল্লাহ আরসার সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর হাতে নির্মমভাবে খুন হয়েছিল। এছাড়াও ২০২২ সালে গোয়েন্দা সংস্থা ও র্যাবের মাদকবিরোধী যৌথ অভিযানের সময় আরসা সন্ত্রাসীদের হামলায় গোয়েন্দা সংস্থার একজন উর্ধ্বতন কর্মকর্তা নিহত হন। সন্ত্রাসী হামলায় একজন র্যাব সদস্য গুরুতর আহত হন।
রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আধিপত্য বিস্তারসহ বিভিন্ন কারণে সন্ত্রাসী গোষ্ঠী ২০২৩ সালে ৬৪ জন এবং ২০২৪ সালে অদ্যাবধি পর্যন্ত ১৬ জন নির্মমভাবে হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছে। এ সকল সন্ত্রাসী কার্যক্রম নির্মূলে র্যাব-১৫, কক্সবাজার শুরু থেকেই বিশেষ গোয়েন্দা তৎপরতা ও নজরদারি চালু রেখেছে। র্যাব বিভিন্ন সময়ে সন্ত্রাস বিরোধী অভিযান পরিচালনা এবং অপরাধ নিয়ন্ত্রণের জন্য সার্বক্ষণিক পর্যবেক্ষণ করে আসছে। সন্ত্রাস বিরোধী বিভিন্ন অভিযানের মাধ্যমে আরসার সামরিক কমান্ডার হাফেজ নূর মোহাম্মদ/ অর্থ সম্পাদক মাওলানা মোহাম্মদ ইউনুস/ গান কমান্ডার রহিমুল্লাহ @ মুছা/ অর্থ সমন্বয়ক মোহাম্মদ এরশাদ @ নোমান চৌধুরী ও আবু তৈয়ব/ কিলার গ্রুপের প্রধান নূর কামাল @ সমিউদ্দিন/ ইন্টেলিজেন্স সেল এর কমান্ডার ওসমান গনি র্যাবের হাতে গ্রেফতার হয়। এছাড়াও লজিস্টিক শাখার প্রধান, গান গ্রুপের প্রধান, অর্থ শাখার প্রধান এবং আরসা প্রধান নেতা আতাউল্লাহর দেহরক্ষী আকিজ’সহ সর্বমোট ১১০ জন আরসা সন্ত্রাসীকে গ্রেফতার করতে সক্ষম হয়। তাদের নিকট থেকে ৫১.৭১ কেজি বিস্ফোরক, ১২টি বিদেশী আগ্নেয়াস্ত্র, ৫৩টি দেশীয় আগ্নেয়াস্ত্র, ১৫৩ রাউন্ড গুলি/কার্তুজ, ৬৭ রাউন্ড খালি খোসা, ০৪টি আইডি ও ৩৫টি ককটেল উদ্ধার করা হয়।
সম্প্রতি ঘটে যাওয়া হত্যাকাণ্ড এবং বিভিন্ন সন্ত্রাসী ঘটনার প্রেক্ষিতে র্যাব-১৫ আবারো গোয়েন্দা তৎপরতা ও নজরদারি শুরু করে। পার্শ্ববর্তী দেশে সৃষ্ট সংঘর্ষকে কাজে লাগিয়ে আরসাসহ সশস্ত্র সন্ত্রাসী গ্রুপগুলো পার্শ্ববর্তী দেশ থেকে কিছু আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে আসার একটি তথ্য র্যাবের নিকট আসে। এছাড়াও আরসা নেতৃত্ব শুন্য হয়ে পড়ায় আবারো পুনঃসংগঠিত হওয়ার লক্ষ্যে পার্শ্ববর্তী দেশ হতে কিছু নেতৃত্বাধীন আরসা সদস্যকে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে পাঠিয়েছে বলে তথ্য পায় র্যাব।
প্রাপ্ত তথ্যের প্রেক্ষিতে র্যাব-১৫ কার্যক্রম শুরু করে এবং জানতে পারে, মাস্টার সেলিম বর্তমানে বাংলাদেশের আরসার প্রধান হিসেবে নেতৃত্ব দিচ্ছে। তার নেতৃত্বে পুনরায় হত্যাসহ বিভিন্ন অপরাধ কর্মকান্ড পরিচালনা এবং পার্শ্ববর্তী দেশ হতে অস্ত্র-গোলাবারুদ সংগ্রহ করে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ত্রাশ সৃষ্টি করছে।
এরই ধারাবাহিকতায়, র্যাব-১৫ এর একটি চৌকস আভিযানিক দল গোপন সংবাদের ভিত্তিতে অবগত হয়ে অদ্য ভোররাতে কক্সবাজারের উখিয়ার রোহিঙ্গা ক্যাম্প সংলগ্ন লাল পাহাড়ে আরসার আস্তানায় অভিযান পরিচালনা করে বর্তমানে বাংলাদেশে আরসার অন্যতম প্রধান সমন্বয়ক ও কমান্ডার মোঃ শাহনুর প্রকাশ মাস্টার সলিম’সহ দুইজন আরসা সন্ত্রাসী গ্রেফতার করতে সক্ষম হয়। এ সময় তাদের কাছ থেকে ০৫টি গ্রেনেড, ০৩টি রাইফেল গ্রেনেড, ১০টি দেশীয় তৈরী হ্যান্ড গ্রেনেড, ১৩টি ককটেল, ০১টি বিদেশী রিভলবার, ০৯ রাউন্ড 9MM পিস্তলের অ্যামুনিশন, ০১টি এলজি এবং ৩টি ১২ বোর কার্তুজ উদ্ধার করা হয়।
প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়, গ্রেফতারকৃতরা জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত পার্শ্ববর্তী দেশের নাগরিক। গ্রেফতারকৃত মোঃ শাহনুর প্রকাশ মাস্টার সলিম ২০১৭ সালের পার্শ্ববর্তী দেশ হতে অবৈধভাবে বাংলাদেশে প্রবেশ এবং ক্যাম্প-১৫ এ বসবাস শুরু করে। সে পার্শ্ববর্তী দেশে থাকাকালীন সেখানকার জোন কমান্ডারের দায়িত্বে নিয়োজিত ছিল। এছাড়াও আরসা প্রধান আতাউল্লাহ আবু আম্মার জুনুনির দেহরক্ষী হিসেবে দুই মাস দায়িত্ব পালন করে। বাংলাদেশে রোহিঙ্গা শরণার্থী হিসেবে ২০১৭ সালে আসার পর মৌলভী আকিজের মাধ্যমে আরসায় পুনরায় যোগদান করে।
আরসার হয়ে আধিপত্য বিস্তার কোন্দলসহ খুন, অপহরণ, চাঁদাবাজিসহ বিভিন্ন অপরাধের সাথে সম্পৃক্ত হয়ে পড়ে। অস্ত্র চালনাসহ বিভিন্ন বিস্ফোরকের উপর পারদর্শী। প্রাথমিকভাবে ক্যাম্প-১৫ এর কমান্ডার হিসেবে তাকে নিয়োগ দেয়া হয়। সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশে আরসা নেতৃত্ব শূণ্য হয়ে পড়ায় সে বাংলাদেশে আরসার প্রধান সমন্বয়ক হিসেবে দায়িত্ব নেয়। পার্শ্ববর্তী দেশে সৃষ্ট সংঘর্ষের ফলে লুটকৃত অস্ত্র-গোলাবারুদ বিভিন্ন মাধ্যম হতে সংগ্রহ করে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ত্রাশ সৃষ্টি করে। যার ফলশ্রুতিতে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে পুনরায় আধিপত্য বিস্তার কেন্দ্রীক মারামারি, সংঘর্ষ ও হত্যার ঘটনা ঘটছে। তার বিরুদ্ধে ৩টি হত্যা মামলাসহ অন্যান্য বিভিন্ন অপরাধে একাধিক মামলা রয়েছে।
গ্রেফতারকৃত মোঃ রিয়াজ ২০১৭ সালে বাস্তুচ্যুত হয়ে পার্শ্ববর্তী দেশ হতে অবৈধভাবে বাংলাদেশে প্রবেশ করে এবং বসবাস শুরু করে। সে ২০১৮ সালে মৌলভী মোঃ ইব্রাহিমের মাধ্যমে আরসায় যোগদান এবং প্রাথমিকভাবে আরসার হয়ে পাহারাদারের দায়িত্ব পালন করে। এ সময় সে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীসহ আরসা বিরোধী সংগঠনের সদস্যদের গতিবিধি লক্ষ্য করতো। পরবর্তীতে ২০১৯ সালের মাঝামাঝি সময়ে পুনরায় পার্শ্ববর্তী দেশে ফিরে যায় এবং সেখানে ০৬ মাসের সামরিক বিভিন্ন বিষয়াদিসহ মাইন, বোমা, হাত বোমা ও বিস্ফোরক তৈরীতে প্রশিক্ষণ লাভ করে। পরবর্তীতে পুনরায় বাংলাদেশে প্রবেশ করে গ্রেফতারকৃত মাস্টার সলিমের অন্যতম সহযোগী হয়ে বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করতো বলে জানা যায়। তার বিরুদ্ধে ০১টি হত্যা মামলা মামলা সংক্রান্তে তথ্য পাওয়া যায়।
গ্রেফতারকৃতদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা প্রক্রিয়াধীন বলে জানিয়েছে র্যাপিড এ্যাকশন ব্যাটালিয়ন।