
দক্ষিণ এশিয়ার পারমাণবিক শক্তিসম্পন্ন দুটি দেশ। ভারত এবং পাকিস্তান। ১৯৪৭ সালে স্বাধীনতা অর্জনের পর থেকে আজ পর্যন্ত ৭৮ বছরে দেশ দুটি চারবার যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছে। চারটি বড় যুদ্ধের বাইরেও অসংখ্যবার ছোট, বড় সামরিক সংঘাত হয়েছে। প্রায় প্রতিটি যুদ্ধের কেন্দ্র হচ্ছে কাশ্মির। এর বাইরে ১৯৬৫ সালে কচ্ছ যুদ্ধ এবং ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা নিয়ে যুদ্ধ।
দেশ দুটি পারমাণবিক ক্ষমতাসম্পন্ন হওয়ায়, এদের মধ্যকার সংঘাত আঞ্চলিক রাজনীতিতে বাড়তি চাপ চলমান। আন্তর্জাতিক রাজনীতিতেও সবসময় বাড়তি আশঙ্কা বিরাজমান। ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ এবং বৈরী সম্পর্কের কারণে এই অঞ্চলে কখনই পূর্ণ শান্তি প্রতিষ্ঠিত হয়নি। সবসময় যুদ্ধের কালো ধোঁয়া এই অঞ্চলকে ঢেকে রেখেছে। স্বস্তির সুবাতাস কখনোই এখানে নেই। সবটাই দূরের আকাশে !
১৯৪৭ সালের মধ্য আগস্টে দেশ দুটি ব্রিটিশদের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভ করে। স্বাধীনতা অর্জনের দুই মাসের মধ্যেই জড়িয়ে পড়ে যুদ্ধে। স্বাধীনতার শুরু থেকেই দুই দেশের মাঝামাঝি অবস্থিত জম্মু ও কাশ্মিরের আধিপত্য নিয়ে দ্বন্দ্বের সূচনা। ব্রিটিশরা যাবার সময় জম্মু-কাশ্মিরকে ভারত-পাকিস্তান যেকোনো দেশের অধীনে যাবার অধিকার দিলে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ জম্মু-কাশ্মিরের হিন্দু রাজা হারি সিং ভারতের পক্ষে অবস্থান নেন। এর বিপরীতে স্থানীয় মুসলিম গোত্রগুলো পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সহায়তা চায়। যার প্রেক্ষিতে জম্মু-কাশ্মিরের কিছু, কিছু অংশে ছোটখাটো সশস্ত্র হামলা, পাল্টা হামলা চলতে থাকে। মুসলিম গোত্রগুলোর সশস্ত্র আক্রমণের মুখে হারি সিং ভারতে পালিয়ে যান। এবং ভারতীয় সেনাবাহিনীর সহায়তা চান। পরবর্তীতে ভারত-পাকিস্তানের যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়।
সংঘাত চলাকালে ভারত জাতিসংঘের কাছে মধ্যস্থতার আবেদন জানায়। জাতিসংঘ উভয় দেশকে যুদ্ধস্থান থেকে সেনা সদস্যদের সরিয়ে নিতে বলে। জম্মু-কাশ্মিরের মাঝে নিয়ন্ত্রণ সীমারেখা টেনে দেয়। তবে জম্মু-কাশ্মিরের দুই-তৃতীয়াংশ ভারত ও এক-তৃতীয়াংশ পাকিস্তান নিজেদের দখলে রাখে। সেই থেকে আজ পর্যন্ত নিয়ন্ত্রণ সীমারেখার দু’পাশে ভারত এবং পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধ-সংঘাত বিরাজমান। আজও তা চলছে।
১৯৬৫ সালে কাশ্মীরি নেতা শেখ আবদুল্লাহকে গ্রেফতার করা হলে ভারতের কাশ্মীরে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে । আইয়ুব খান এ সুযোগ গ্রহণ করেন। প্রথমে সশস্ত্র গেরিলাদের কাশ্মিরে অনুপ্রবেশ করিয়ে গোলযোগ সৃষ্টির চেষ্টা করেন। অবশেষে ৬ই সেপ্টেম্বর পাকিস্তান বাহিনী ভারত আক্রমণ করলে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ শুরু হয়। ১৯৬৬ সালের জানুয়ারি মাসে সোভিয়েত প্রধানমন্ত্রী কোসিগিনের মধ্যস্থতায় তাসখন্দ শহরে ভারত ও পাকিস্তানের মাঝে যুদ্ধবিরতি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় । এর মধ্য দিয়ে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের অবসান হয় ।
১৯৬৫ সালের যুদ্ধ
এপ্রিল ও নভেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে ভারত-পাকিস্তান আবারো কাশ্মির সংঘাতে জড়িয়ে পড়ে। ভারত নিয়ন্ত্রিত জম্মু ও কাশ্মির অঞ্চলে ভারতীয় নিয়ন্ত্রণের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ সৃষ্টিতে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পরিকল্পনার জবাবে ভারত পশ্চিম পাকিস্তানে পূর্ণমাত্রায় সেনা আক্রমণ চালায়। ২য় বিশ্বযুদ্ধের পর পৃথিবীর আর কোথাও এর চেয়ে বড় বড় সশস্ত্র সংঘাতের ঘটনা ঘটেনি। ৭ দিন ব্যাপী চলা এই যুদ্ধে উভয়পক্ষের হাজার হাজার সদস্য আহত ও অসংখ্য নিহত হয়। সোভিয়েত ইউনিয়ন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় ২২ সেপ্টেম্বর দুই দেশ যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হয়।

১৯৭১ সালে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ এবং এর সমাপ্তির মধ্য দিয়ে “বাংলাদেশ” নামের এক নতুন রাষ্ট্রের উদ্ভব হয়।
আমাদের দেশের মুক্তিযুদ্ধ পূর্ণতা লাভ করে। তবে লক্ষ লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে স্বাধীনতা এবং বাংলাদেশ রাষ্টের জন্ম হয়।
আন্তর্জাতিক সমীক্ষা অনুযায়ী, ১৯৭১ সালের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ ছিল দুইদেশের মধ্যে সামরিক সংঘর্ষের ঘটনা। ১৯৭১ সালের ৩ ডিসেম্বর ১১টি ভারতীয় এয়ারবেসে পাকিস্তান আচমকা হানা দেশ। “অপারেশন চেঙ্গিস খাঁ” নামে এই যুদ্ধের সূচনা ঘটে। মাত্র তেরো দিনের এই যুদ্ধটি ইতিহাসের সর্বাপেক্ষা স্বল্প সময়ের যুদ্ধগুলোর একটি বলে পরিগণিত হয়। যুদ্ধ চলাকালীন পূর্ব ও পশ্চিম ফ্রন্টে ভারতীয় ও পাকিস্তানি বাহিনী সংঘর্ষে লিপ্ত হয়েছিল। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর পূর্ব কমান্ড আত্মসমর্পণ করলে যুদ্ধ সমাপ্ত হয়। এটিই সম্ভবত ইতিহাসের প্রথম ও একমাত্র গণ-আত্মসমর্পণের ঘটনা। এই দিনই পূর্ব পাকিস্তান স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্র রূপে আত্মপ্রকাশ করে। ৭৯,৭০০ পাকিস্তান বাহিনী ও আধা-সামরিক বাহিনীর জওয়ান ও ১২,০০০ অসামরিক নাগরিক সহ পূর্ব পাকিস্তানে মোট ৯৭,৩৬৮ জন পশ্চিম পাকিস্তানিকে ভারত যুদ্ধবন্দী করে।

এরপর ১৯৯৯ সালে কার্গিল যুদ্ধ হয়। ভারতের শ্রীনগড়ে কার্গিল জেলা পাকিস্তানি সেনাবাহিনী আক্রমণ করে এবং নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নেয়। দুই দেশের মধ্যে দুই মাসব্যাপী যুদ্ধ চলে। তবে এই যুদ্ধ কার্গিলের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। ২০১৬ সালের ১৮ মে আবারও কাশ্মির ঘিরে দুই দেশের মধ্যে যুদ্ধের উত্তেজনা দেখা দেয়।
২০২৫ সালে আবারও যুদ্ধ। আবারও এক দেশের সামরিক বাহিনীর গোলা বা মিসাইল। মরছে মানুষ। ভেঙে তছনছ হয়ে যাচ্ছে থালাবাসন, ঘরবাড়ি, সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য সবকিছু। দুই দেশের সীমান্তের সাধরণ জনগণকে আশ্রয়ে ছুটতে হচ্ছে মাইলের পর মাইল নিরাপদ আশ্রয়ে !
ভারত এবং পাকিস্তানের যুদ্ধ পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায়, জাতিগত দ্বন্দ্ব বা দেশের নিরাপত্তার চেয়ে রাজনৈতিক ইচ্ছার প্রাধান্যই বেশি। ১৯৪৮ থেকে আজ পর্যন্ত। এর মধ্যে ব্যতিক্রম ১৯৭১। এই যুদ্ধ ছিল এই অঞ্চলে বঞ্চিত এক জনগোষ্ঠীর মুক্তির আকাঙ্ক্ষা। তৎকালীন পাকিস্তানের শাসক গোষ্ঠী থেকে মুক্তি পেতে বাঙালি জনগণ পাকিস্তানের বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধের শুরু করে। যা ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের মধ্য দিয়ে সমাপ্তি ঘটে। হতে পারে ভারতীয় শাসক গোষ্ঠীর সুদূরপ্রসারি রাজনৈতিক অভিলাষ ছিল। কিন্তু এই যুদ্ধে আমরা স্বাধীন হয়েছি।

১৯৪৮ সালের যুদ্ধ ছিল রাজা হরি সিং-এর ইচ্ছার ফসল। ধর্মের ভিত্তিতে ১৯৪৭ সালে এই উপমহাদেশ বিভক্ত হয়। জম্মু ও কাশ্মীর জনগোষ্ঠীর বিশাল অংশ ছিল মুসলিম। তাই কাশ্মীরের জনগণ স্বতন্ত্র রাষ্ট্র হিসেবে বসবাস করতে আকাঙ্খা প্রকাশ করে। বৃটিশ রাজ তা মেনেও নেয়। মানতে পারেনি ভারতের সেই সময়কার শাসকেরা, মানতে পারেনি রাজা হরি সিং। এই সুযোগটাই নিতে চেয়েছিল পাকিস্তানের তখনকার শাসকেরা। যার পরিনতি যুদ্ধ এবং যুদ্ধ। আজও যুদ্ধ চলমান।
১৯৬৫ সালে পাকিস্তানের সেনাশাসক মোহাম্মদ আয়ুব খান নিজের শাসন পোক্ত করতে যুদ্ধ-যুদ্ধ রাজনৈতিক খেলা শুরু করেন। কিন্তু এই খেলা খেলতে যেয়ে আইয়ুব খান কিছুদিনের মধ্যেই রাজনীতি বা ক্ষমতা থেকে নির্বাসিত হন।
তেমনটাই খেলা খেলতে চেয়েছে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। তিনি এই যুদ্ধের মধ্য দিয়ে শাসনক্ষমতা পোক্ত করতে চেয়েছেন। হয়তো সফল হবেন। হয়তো-বা নয়।
কিন্তু হেরে যাবে ভারত এবং পাকিস্তানের দরিদ্র জনগণ। ভারতের ৪২ শতাংশ জনগণ আজ-ও দরিদ্রসীমার নীচে বসবাস করে। পাকিস্তানের অর্থনৈতিক অবস্থা ভেঙে গেছে একেবারে। এমন অবস্থায় যুদ্ধ সামগ্রী কিনতে যেয়ে দেশ দুটি আরও দরিদ্রসীমার নীচে চলে যাবে। ভেঙে যাবে সমাজ ব্যবস্থা।
শুধু লাভবান হবে যুদ্ধবিমান রাফায়েল, এফ সিক্সটিন বা মিগ ২৯ বানায়। যুদ্ধে যারা আকাশ নিয়ন্ত্রণ করছে, তারাই। এই যুদ্ধে ধনী দেশগুলো আরো ধনী হবে। এই হচ্ছে এই অঞ্চলে আগামীর ভবিষ্যৎ !