মতামত

ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধে ড্রোন যুগের সূচনা এবং কার্যকারিতা পরীক্ষা

শাহীন রাজা

স্পেনের ছোট্ট গ্রাম গুয়ের্নিকা। জলপাই গাছের সবুজে ঘেরা একটি গ্রাম। শহরের কোলাহল নেই—নিঃশব্দ নিরবতা। এমন এক গ্রামে এপ্রিলের এক বিকেলে, আকাশ থেকে নেমে আসে একটার পর একটা বোমা—যা ছিল গুয়ের্নিকা গ্রামবাসীর কল্পনার বাইরে।

ঘটনাটি ঘটে ১৯৩৭ সালের ২৬ এপ্রিল বিকেলবেলায়। সেদিন ছিল হাটবার। তাই সেদিন গুয়ের্নিকায় ভিন গাঁ থেকে-ও অনেকে এসেছিলেন সাপ্তাহিক বাজার সদাই করতে। সপ্তাহের অন্যান্য দিনের তুলনায় লোকসংখ্যাও ছিল বেশি। কোনও পূর্বলক্ষণ, হুঁশিয়ারি বা হুমকি ছিল না। হঠাৎ বিকেল চারটার দিকে আকাশে উড়ে এল একটি প্লেন।
পনেরো মিনিটের মধ্যে পরপর তিনটি বিমান আসে। সব ক’টাই জার্মানি ও ইতালির বোমারু বিমান। হিটলার ও মুসোলিনির যৌথ অভিযানে আকাশ থেকে নেমে আসে একের পর এক বোমা। শহর জ্বলতে থাকে, তারই মধ্যে যাঁরা পালাতে চেষ্টা করেন, নাৎসি বাহিনী তাঁদের মেশিনগান দিয়ে ঝাঁঝরা করে দেয়।
উদ্দেশ্য ছিল সহজ—স্পেনে কোনও প্রতিবাদ বা গৃহযুদ্ধ চলবে না; হিটলার ও মুসোলিনির বন্ধু, শাসক ফ্রাঙ্কোকে ক্ষমতার আসনে বসাতেই হবে। ছোট্ট গ্রাম গুয়ের্নিকায় তিন ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে বোমা হামলা চলে এবং গ্রামটিকে সম্পূর্ণ ধ্বংস করে দেওয়া হয়।

খালি চোখে মনে হবে, স্পেনের গণতান্ত্রিক সরকারকে হটিয়ে স্বৈরাচার ফ্রান্সিস ফ্রাঙ্কোকে ক্ষমতায় আনার হিটলার ও মুসোলিনির চেষ্টা। কিন্তু মূলত ছিল জার্মানি এবং ইতালির উৎপাদিত অস্ত্রের কার্যক্ষমতা পরীক্ষার জন্য নিরীহ গুয়ের্নিকার গ্রামবাসীদের বেছে নেওয়া।

ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে চলমান উত্তেজনায় এবারই প্রথম ড্রোন ব্যবহার হচ্ছে। এটি ব্যবহারের মাধ্যমে পারমাণবিক শক্তিধর প্রতিবেশী দুই দেশের মধ্যে সংঘাতের তীব্রতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। ড্রোন হামলা ভারত-পাকিস্তান সংঘাতে একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেছে।
এবার ভারত-পাকিস্তান সংঘাত একটি নতুন ড্রোন যুগে প্রবেশ করেছে।

এ প্রসঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের নেভাল ওয়ার কলেজের অধ্যাপক জাহারা ম্যাটিসেক এই ড্রোন যুদ্ধ সম্পর্কে বক্তব্য রেখেছেন। ম্যাটিসেক বলেন, ভারত-পাকিস্তান সংঘাত এমন এক ড্রোন যুগে প্রবেশ করছে—যেখানে এই ‘অদৃশ্য চোখ’ ও মনুষ্যবিহীন নির্ভুলতা উত্তেজনা বাড়াতে পারে, আবার কমাতেও পারে। যে দেশ ড্রোন প্রযুক্তি ও কৌশলে এগিয়ে থাকবে, প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ আকাশে তারাই আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করবে।

ম্যাটিসেক আরও বলেন, ড্রোন দিয়ে শত্রুর আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা সক্রিয় করা হয়, যাতে পরবর্তীতে সেই রাডারকে নির্দিষ্ট ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে ধ্বংস করা যায়। ইউক্রেন ও রাশিয়া তাদের যুদ্ধে এ ধরনের কৌশলই ব্যবহার করছে।

এর আগে গাজায়, ইসরায়েল ড্রোন ব্যবহার করেছে। হামাস তেমন প্রতিরোধ না করতে পারায় তা ছিল ড্রোনের একপাক্ষিক ব্যবহার। কিন্তু ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধে তা হয়নি। দুই পক্ষই ছিল সমানে সমান।

এই যুদ্ধ দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। ৭২ ঘণ্টার মধ্যে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের উদ্যোগে যুদ্ধ থেমে যায়। দুই দেশের সমরবিদ এবং রাজনৈতিক নেতারা যতই হম্বিতম্বি করুন না কেন, আপাতত যুদ্ধ থেমে গেছে। হয়তো আগামীতে আবার নতুন ইস্যুতে নতুন করে।

তিন দিনের মাথায় যুদ্ধ থামানোর চেয়ে, যুদ্ধ শুরুর আগেই উদ্যোগ নিলে এই প্রাণসংহার হতো না। কিন্তু আমেরিকা বা পশ্চিমা বিশ্ব তা চায়নি। তারা চেয়েছে উদ্ভাবিত ড্রোনের কার্যকারিতা পরীক্ষা করতে। এবং তাই হয়েছে।

এর ফলে ভারত এবং পাকিস্তানের অনেক নিরীহ লোককে প্রাণ দিতে হয়েছে। এটি পশ্চিমা বিশ্বের কাছে কিছুই নয়। তারা আমাদেরকে পরীক্ষা-নিরীক্ষার গিনিপিগ ভাবে। তাই যুদ্ধে প্রাণসংহার তাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ কিছু নয়।

এদিকে, ভারত একটি গণতান্ত্রিক দেশ হলেও তাদের সমাজে বা রাজনীতিতে জাতপাত একটি বড় বিষয়। প্রতিবেশী রাষ্ট্রে বসবাসকারী ভিন্নধর্মের লোকদের, তারা নিম্নবর্ণ চণ্ডালের থেকেও নিচু জাতের মনে করে। তাই তারা প্রতিবেশী রাষ্ট্রের নাগরিকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করাকে যথাযথ মনে করে।

অপরদিকে, পাকিস্তানে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার সংস্কৃতি নেই বললেই চলে। সামরিক নেতাদের ইচ্ছা-অনিচ্ছাই প্রাধান্য পায়। তাই যুদ্ধ, যুদ্ধ খেলা তাদের কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ—সাধারণ জনগণের কথা তারা কখনোই ভাবে না।

দুই দেশই প্রতিবেশীর সাথে সুসম্পর্ক রাখার চেয়ে যুদ্ধমুখী মনোভাব পোষণ করে। একবারও ভাবে না, এই যুদ্ধ কার স্বার্থে? এই যুদ্ধে কারা লাভবান হচ্ছে? এই সুযোগটা গ্রহণ করে বৃহৎ বা পরাশক্তি দেশগুলো। তারা তাদের উৎপাদিত সমরাস্ত্র এদের কাছে বিক্রি করে বাণিজ্যিক সুবিধা নেয়। পাশাপাশি উৎপাদিত সমরাস্ত্রের কার্যকারিতাও পরীক্ষা করে।

এই অস্ত্র কিনতে গিয়ে দেশের দারিদ্র্যের সংখ্যা আরও বৃদ্ধি পায়। দরিদ্র জনগোষ্ঠীর অনেকেই হয়তো বিমানের গোলায় প্রাণ হারায় না, কিন্তু যুদ্ধের কারণে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্য বেড়ে যায়। ছোট ছোট শিশুরা ক্ষুধায় কষ্ট পায় এবং তারা সাধারণ চিকিৎসা থেকেও বঞ্চিত হয়।

Show More

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button