পৃথিবীতে আসার সময় প্রতিটি মানুষই একটি করে আলাদিনের প্রদীপ নিয়ে আসে…কিন্তু খুব কম মানুষই সেই প্রদীপ থেকে ঘুমন্ত দৈত্যকে জাগাতে পারে আর সে দৈত্যটিকে জাগাতে পেরেছিলেন নন্দিত কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ।
একাধারে কথাসাহিত্যিক, নাট্যকার, চলচ্চিত্র পরিচালক, কবি, গীতিকার হিসেবে সৃজনশীলতা ও মনোরঞ্জনের অতুলনীয় মেলবন্ধন ঘটিয়ে কোটি মানুষের হৃদয় জয় করে কিংবদন্তিতে পরিণত হয়েছিলেন হুমায়ূন আহমেদ। তুমুল জনপ্রিয়তায় তিনি এ দেশের মধ্যবিত্ত জীবনের বিচিত্র কথকতাকে সহজ-সরল গদ্যে তুলে ধরে পাঠককে মন্ত্রমুগ্ধ করে রেখেছিলেন প্রায় পাঁচ দশক ধরে। কথার জাদুকর স্বাধীনতা-উত্তর বাংলা সাহিত্যের জনপ্রিয়তম কথাশিল্পী হুমায়ূন আহমেদের ৭৬তম জন্মদিন আজ।
নন্দিত নরকে উপন্যাসের আশ্রয়ে সাহিত্যের আকাশে জ্বলে উঠেছিলেন হুমায়ূন আহমেদ। ১৯৭২ সালে সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে প্রকাশিত হয়েছিল উপন্যাসটি। সহজ-সরল ভাষার সঙ্গে সংলাপধর্মী উপন্যাসটি সহজেই আকৃষ্ট করেছিল সাহিত্যানুরাগীর মনন। পরের গল্পটি শুধুই এগিয়ে যাওয়ার। টানা চারটি দশক আপন সৃষ্টিশীলতায় মোহাচ্ছন করে রেখেছিলেন পাঠককে। সেই সূত্রে ধারণ করেছেন দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় ও জননন্দিত কথাসাহিত্যিকের পরিচয়টি।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং কাজী নজরুল ইসলামের পরে প্রায়শই বাংলা সাহিত্যের অন্যতম সেরা লেখক হিসাবে বিবেচিত তিনি। বাংলা সাহিত্যকে পুনরুজ্জীবিত করার জন্য কৃতিত্ব দেওয়া হয় হুমায়ূন আহমেদকে। তিনি “হিমু”, “মিসির আলী”, “বাকের ভাই” এবং অন্যান্য আইকনিক কাল্পনিক চরিত্রায়নের পাশাপাশি জাদুকরি গল্পের জন্য সবচেয়ে বেশি পরিচিত।
টেলিভিশনে একজন সফল কন্টেন্ট নির্মাতা হিসেবে তিনি বাংলাদেশ টেলিভিশনে (বিটিভি) প্রথম প্রহর (১৯৮৩) নাটকের মধ্য দিয়ে চলচ্চিত্রে অভিষেক করেন। টেলিভিশনে তার সফল যাত্রা অব্যাহত ছিল জনপ্রিয় ধারাবাহিক নাটক “এই সব দিনরাত্রি”, “বহুব্রীহি”, “অসময়”, “নক্ষত্রের রাত”, “আজ রবিবার” এবং “বাকের ভাই” চরিত্রে অভিনেতা আসাদুজ্জামান নূর অভিনীত “কোথাও কেউ নেই” নাটকটি সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য।
হুমায়ূন আহমেদ ১৯৯০-এর দশকের গোড়ার দিকে চলচ্চিত্র নির্মাতা হিসাবে সাফল্য লাভ করেছিলেন এবং তার চলচ্চিত্র নির্মাণের ক্যারিয়ারে আটটি চলচ্চিত্র তৈরি করেছিলেন। প্রতিটি তার নিজের উপন্যাস অবলম্বনে। তার দুটি চলচ্চিত্র, “শ্যামল ছায়া” (২০০৪) এবং “ঘেটুপুত্র কমলা” (২০১২) তাদের নিজ নিজ মুক্তির বছরে সেরা বিদেশি ভাষার চলচ্চিত্রের জন্য একাডেমি পুরস্কারের জন্য অফিসিয়ালি বাংলাদেশি জমা দিয়েছিল। শঙ্খনীল কারাগার (চিত্রনাট্যকার হিসেবে), “আগুনের পরশমণি”, “দারুচিনি দ্বীপ” ও “ঘেটুপুত্র কমলা” চলচ্চিত্রের জন্য তিনি বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে সাতবার বাংলাদেশ জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করেন।
১৯৪৮ সালের ১৩ নভেম্বর নেত্রকোনার কেন্দুয়ায় তার জন্ম। ডাকনাম কাজল। বাবা ফয়জুর রহমান আহমেদ ও মা আয়েশা ফয়েজ। বাবা ফয়জুর রহমান আহমেদ ছিলেন পুলিশ কর্মকর্তা, আর মা গৃহিণী। তিন ভাই দুই বোনের মধ্যে তিনি সবার বড়।
লেখকের ৭৬তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে তার স্ত্রী ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব মেহের আফরোজ শাওন তাদের ছেলে নিষাদ হুমায়ূন ও নিনিথ হুমায়ূনকে নিয়ে এই দিনে প্রতি বছর রাত ১২টায় রাজধানীর দক্ষিণ হাওয়া বাসভবনে কেক কাটার মধ্য দিয়ে দিবসটি উদযাপন করেন। জন্মদিন উপলক্ষে আজ বিকাল ৪টায় একাডেমির কবি শামসুর রাহমান সেমিনার কক্ষে বিশেষ সেমিনারের আয়োজন করা হয়েছে।
২০১২ সালের ১৯ জুলাই তিনি মরণব্যাধি ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে যুক্তরাষ্ট্রে চিকিৎসাধীন অবস্থায় আমাদের ছেড়ে না ফেরার দেশে চলে যান।