Top Newsঅর্থনীতিজাতীয়

ভূমধ্যসাগরে বরফের সাথে ভাসে বাংলাদেশী যুবক

শাহীন রাজা : ভূমধ্যসাগরে শীতল জলে ভাসছে যুবক। বরফ জলে ভাসছে স্বদেশ। কালো জলের শীতল ঢেউয়ে, উন্নয়নে নিষ্প্রদীপ আলো ভেসে যাচ্ছে অচেনা রথে !

ভূমধ্যসাগরে শীতল জলে ভাসা যুবকটি বাংলাদেশের কোন এক গ্রামের যুবক। সকলের মতো তার-ও অনেক স্বপ্ন, অনেক আশা-আকাঙ্ক্ষা ছিল। আর্থিক অনাটনে জর্জরিত পরিবারকে এক মুঠো নিরাপদ জীবনের আলো দেবে। কর্মহীন যুবক, নিজ কর্মসংস্থানের জন্য ঘুরে ঘুরে পরিশ্রান্ত। কোথাও কোন কর্মের সুযোগ না মেলায় অবশেষে সমুদ্র পারি দেয়ার মনস্থির করে ফেলে। বৈধ বা অবৈধ যেভাবেই হোক। সমুদ্রের ওপারে যেতে হবে। কারণ ওপারে সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের সবটাই আছে !

বিদেশে বৈধভাবে কর্মসংস্থানের সুযোগ সীমিত। তাই অবৈধভাবে যাওয়া মূখ্য হয়ে উঠেছে। বেকার যুবকদের এই আকাঙ্খাকে আরও ত্বরান্বিত করার জন্য রয়েছে দালাল। এই দালালেরা স্বপ্ন দেখায়, সমুদ্র পার হতে পারলেই সুখ আর স্বাচ্ছন্দ্য। প্রবাসে যাওয়ার কারণে জীবন আজ উন্নত। এমন দু একটা উদহারণ উপস্থাপন করে। যুবকের চঞ্চল মন আর-ও অস্থির হয়ে ওঠে। কখন স্বপ্নের রথে উঠবে।

তারপর একদিন অনেকেই পরিবারের শেষ সম্বলটুকু বিক্রি করে ফেলে। প্রাপ্ত অর্থের পুরোটাই দালালের হাতে তুলে দেয়। কর্মহীন যুবকের আলো না আলেয়ার পেছনে যাচ্ছে তা যাচাই করার সময় থাকে না। আকাঙ্খা একটাই কখন টাকা কামানোর দেশে যাবে। তাকে যেতে হবে।

আইওএম’র প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, ভূমধ্যসাগরে নিহতদের ১২ শতাংশই বাংলাদেশি। প্রতি বছর অবৈধভাবে ইউরোপ প্রবেশ করতে গিয়ে সারাবিশ্বের অনেক অভিবাসনপ্রত্যাশীর সলিল সমাধি ঘটে ভূমধ্যসাগরে। বিশ্বের বিভিন্ন গণমাধ্যমের মাধ্যমে আমরা খবরগুলো জানতে পারি।

অবৈধভাবে ইউরোপে অভিবাসী হতে গিয়ে অনেকেই ভূমধ্যসাগরকে বেছে নিয়েছে। এই গমনেচ্ছু সবাই ইউরোপে ঢুকতে পারে না। যারা ঢুকতে পারে না, তাদের একটা ভূমধ্যসাগরে গভীর জলে আশ্রয় মেলে। অভাবের দুঃস্বপ্ন নিয়ে শীতল জলে বসবাস।

ইন্টারন্যাশনাল অর্গানাইজেশন ফর মাইগ্রেশন (আইওএম) জানিয়েছে, ২০১৪ থেকে ২০২৩ পর্যন্ত ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিতে অর্ধলক্ষাধিক মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন। জানুয়ারিতে প্রকাশিত আইওএম প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, উন্নত জীবনের সন্ধানে এই পথে ইউরোপে প্রবেশ করতে গিয়ে গত এক দশকে ৫২ হাজার ১৩৮ জন প্রাণ হারিয়েছেন। সংস্থার নিখোঁজ অভিবাসী প্রকল্পের তথ্য জানাচ্ছে, বেশির ভাগ মানুষ সমুদ্র পাড়ি দিয়ে ইউরোপে যাওয়ার চেষ্টা করার সময় নিহত হয়েছেন। এর মধ্যে লিবিয়া থেকে ইউরোপে প্রবেশের চেষ্টা করার সময় ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলে ২৫ হাজার ৩৮৫ জন নিহত হয়েছেন। আইওএম’র মহাপরিচালক জানিয়েছেন, এ পর্যন্ত যতলোক মারা গেছেন তার মধ্যে ১২ শতাংশই বাংলাদেশি। জাতিসংঘের সর্বশেষ তথ্যমতে, অভিবাসনপ্রত্যাশী শীর্ষ ১০টি দেশের মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার চারটি দেশ। অন্য তিন দেশ পাকিস্তান, ভারত ও আফগানিস্তান।

এই-যে উন্নত জীবনের আশায় জীবন বাজি রেখে ছোট্ট খেয়ায় সমুদ্র পাড়ি দিচ্ছে। যুবকেরা এই ঝুকি নেয়ার পেছনে প্রধান এবং একটাই কারণ দরিদ্র, ক্ষুধা, কষ্ট থেকে মুক্তির প্রত্যাশায়। উন্নত, স্বাচ্ছন্দ্যে ভরা জীবনের হাতছানি থেকে তারা মুখ ফেরাতে পারে না। কোন আলো আর কোনটা আলেয়া এটা বিশ্লেষণ করার বোধ বা সময় তাদের নাই। জীবনটা তাদের লটারির মতো যদি ভাগ্য সুপ্রসন্ন হয় !

গত পনেরো বছর আমরা উন্নতির অনেক জয়গান গেয়েছি। কিন্তু কর্মক্ষম যুবকদের কর্ম সংস্থানের সুযোগ তৈরি করতে পারেনি। পারেনি এই সকল যুবকের নিরাপদ হল জীবনের আলো দেখাতে। বাধ্য হয়েই ঝুঁকি নিয়েছে। একটা ছোট্ট খেয়াতে সমুদ্র পারি দেয়ার ঝুঁকি নিয়েছে, যুবকেরা।

বর্তমানে রাতারাতি পরিবর্তন প্রত্যাশা করা হবে বোকামি। তবে সরকার আন্তরিক হলে দালাল চক্রের ছোবল থেকে যুবকদের রক্ষা করা অসম্ভব নয়। সংশ্লিষ্ট সকল সংস্থাকে আর-ও সচল এবং কার্যকর করা যায়। ভূমধ্য সাগর বা কোন সাগরেই বাংলাদেশের যুবকের লাশ আর হয়তে ভাসবে না।

লেখক: শাহীন রাজা, হেড অব এডিটোরিয়াল, মোহনা টেলিভিশন।

Show More

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button