
এই প্রথম জামায়াতে ইসলাম তাদের নারী নেতাকর্মীকে সর্বসমক্ষে এনেছে। সম্প্রতি কূটনীতিক ও রাজপথে রাজনৈতিক কর্মসূচিতে তাদের উপস্থিতি চোখে পড়ছে। যদিও অতীতে দলটির নারী নেতাকর্মীর অংশগ্রহণ ছিল সাংগঠনিক ও ধর্মীয় কার্যক্রমের মধ্যে নিয়ন্ত্রিত।
বিশ্লেষকরা বলছেন, জামায়াতের অবস্থান এতদিন নারীর পক্ষে ছিল না। ভোটারের অর্ধেক যেহেতু নারী, তাই এটা তাদের নির্বাচনী কৌশল হতে পারে।
যদিও জামায়াত নেতারা বলছেন, নীতি-আদর্শে বদল আসেনি। আওয়ামী লীগের সাড়ে ১৫ বছরের শাসনামলে জামায়াতের ওপর দমনপীড়নের কারণে নারী নেতাকর্মীকে প্রকাশ্য কর্মসূচিতে দেখা যায়নি। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার স্বৈরশাসনের পতনে নিরাপদ পরিবেশে নারী নেতাকর্মীরা ইসলামের বিধিবিধান ও পর্দা মেনে রাজনৈতিক কর্মসূচিতেও প্রকাশ্য হয়েছেন। সাংগঠনিক, ধর্মীয় ও সামাজিক কার্যক্রম আগের মতোই অব্যাহত রয়েছে।
ধর্ষণ, নারী ও শিশু নিপীড়নের প্রতিবাদে পাঁচ দফা দাবিতে গত শনিবার রাজধানীর প্রেস ক্লাবের সামনে মানববন্ধন করে জামায়াতের মহিলা বিভাগ। হাজারখানেক নারী নেতাকর্মী মানববন্ধনে অংশ নিয়ে ধর্ষণের বিচার দাবিতে স্লোগান ও বক্তব্য দেন। অতীতে কখনই জামায়াতের নারী নেতাদের প্রকাশ্যে স্লোগান কিংবা বক্তব্য দিতে দেখা যায়নি।
গত বৃহস্পতিবার জামায়াতপন্থি সংগঠন নারী অধিকার আন্দোলন প্রেস ক্লাবের সামনে মানববন্ধন করে। দুটি কর্মসূচিতেই অংশগ্রহণকারী জামায়াতের নারী নেতাকর্মীরা বোরকা পরিহিত ছিলেন, মুখ ঢাকা ছিল হিজাবে। গত শুক্রবার ময়মনসিংহে নগরীর টাউন হল মিলনায়তনের মতো উন্মুক্ত স্থানে জামায়াতের মহিলা বিভাগের আয়োজনে ‘তাকওয়াভিত্তিক রাষ্ট্র গঠনে নারীর ভূমিকা’ শীর্ষক সেমিনার হয়। নারী কর্মীর ওপর হামলার প্রতিবাদে ১১ মার্চ ঝিনাইদহের মহেশপুরে সরকারি ডিগ্রি কলেজ মাঠে নারী সমাবেশ করে স্থানীয় জামায়াত। এতে হাজারো নারী নেতাকর্মী বোরকা, হিজাব পরে অংশ নেন। ৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবসের কর্মসূচিতে স্থানীয় বিএনপি নেতাকর্মীরা জামায়াতের নারী নেতাকর্মীর ওপর হামলার প্রতিবাদে ওই সমাবেশ হয়।
১১ মার্চ জামায়াত কার্যালয়ে দলটির আমিরের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন ঢাকায় নিযুক্ত যুক্তরাজ্যের হাইকমিশনার সারাহ কুক। এ সময় তাঁর সঙ্গে জামায়াতের চার নারী নেতাও কথা বলেন। নারী নেতাদের সঙ্গে হাইকমিশনারের সাক্ষাতের ছবি জামায়াতের ফেসবুক পেজে পোস্ট করা হয়। জামায়াতের নারী নেতাদের কূটনৈতিকদের সঙ্গে সাক্ষাতের নজির নেই। আগে কখনই নারীদের কার্যক্রমের তথ্য কিংবা ছবি সামাজিক মাধ্যমে প্রকাশ করা হয়নি।
জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল হামিদুর রহমান আযাদ সমকালকে বলেন, শেখ হাসিনার শাসনামলে ধরপাকড়ের কারণে পুরুষ নেতাকর্মীরা সভা-সমাবেশ দূরে থাক ঘরোয়া বৈঠকও করতে পারতেন না। নারীদের জন্য পরিবেশ ছিল আরও অনিরাপদ। সে কারণেই নারীদের এতদিন রাজনৈতিক কর্মসূচিতে দেখা যায়নি। এখন নিরাপদ পরিবেশ হওয়ায় ইসলামী বিধান অনুসরণ করে নারীরা প্রকাশ্য কার্যক্রম চালাচ্ছেন। ধর্ষণ, নিপীড়নবিরোধী কর্মসূচি যতটা না রাজনৈতিক, তার চেয়ে বেশি সামাজিক। সামাজিক কার্যক্রম মহিলা জামায়াতের নিয়মিত কাজের অংশ।
জামায়াত সূত্র জানিয়েছে, জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলোর সঙ্গে ৫ আগস্টের পর যেসব বৈঠক হয়েছে, তাতে নারী স্বাধীনতা, কর্মক্ষেত্রে নারীর অধিকারের বিষয়ে জামায়াত নেতাদের কাছে দলীয় দৃষ্টিভঙ্গি জানতে চাওয়া হয়েছিল। দলটির নায়েবে আমির ডা. সৈয়দ আবদুল্লাহ মো. তাহের সমকালকে বলেন, আওয়ামী লীগ এবং তাদের দোসররা সাড়ে ১৫ বছর বিদেশিদের কাছে জামায়াতকে ভুলভাবে চিত্রায়িত করেছে। জামায়াতকে কট্টরপন্থি, সন্ত্রাসী সংগঠনের সঙ্গে তুলনা করে তথ্য দিয়েছে। ৫ আগস্টের পর কূটনৈতিকরা কার্যক্রম দেখে আশ্বস্ত হয়েছেন, জামায়াত একটি গণতান্ত্রিক ইসলামী দল। জামায়াত নারীর স্বাধীনতা ও অধিকারের পক্ষে। ইসলাম নারীকে স্বাধীনতা, সম্মান, অধিকার দিয়েছে। জামায়াত তা অনুসরণ করে। জামায়াতের মহিলা বিভাগ নিজস্ব কর্মপদ্ধতিতে কার্যক্রম চালায়।
দলটির এক নেতা সমকালকে বলেন, জামায়াতের মহিলা বিভাগের নেতারা পেশায় চিকিসৎক, প্রকৌশলী, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, আইনজীবী; তা জেনে বিটিশ হাইকমিশনার বিস্মিত হয়েছেন। নারী নেতারা তাঁর সঙ্গে সাবলীল বৈঠক করায় নতুন ধারণা পেয়েছেন।
১৯৯১ সালে পঞ্চম সংসদে সংরক্ষিত মহিলা আসনে জামায়াতের দু’জন নারী এমপি ছিলেন। অষ্টম সংসদে দলটির নারী এমপি ছিলেন তিনজন। তারা ছিলেন সংরক্ষিত মহিলা আসনের এমপি। জামায়াত কখনই সংসদ নির্বাচনে নারী প্রার্থী দেয়নি। তবে স্থানীয় নির্বাচনে নারী প্রার্থী নিয়মিত দিয়েছে। ২০১৪ সালের উপজেলা নির্বাচনে নারী ভাইস চেয়ারম্যান পদে জামায়াত সমর্থিত ৩৬ জন জয়ী হয়েছিলেন। ২০০৯ সালে জাময়াত সমর্থিত নারী প্রার্থীরা জয়ী হয়েছিলেন ১২ উপজেলায়। ২০১৫ সালে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের সংরক্ষিত মহিলা কাউন্সিলর পদে জামায়াতের নারী নেতা জয়ী হয়েছিলেন।
আগামী সংসদ নির্বাচনে জামায়াত নারী প্রার্থী দিতে পারেন– এমন গুঞ্জন রয়েছে। গত ১১ ডিসেম্বর সাক্ষাৎকারে জামায়াত আমির সমকালকে জানিয়েছিলেন, যোগ্য হলে প্রার্থী হিসেবে নারীদের বিবেচনা করা হতে পারে।