শাহীন রাজা: সে অনেক আগের কথা। সময়টা গ্রীসের রাজা আলেকজান্ডার যখন ভারতবর্ষ আক্রমণ করেছিলেন। সেই সময় ভারতের মগধ রাজ্যের রাজা ছিলেন মহানন্দ। গুপ্ত রাজ্যকালের ঠিক আগের সময়ে।
মহানন্দের দুজন মন্ত্রী ছিলেন। একজনের নাম, শটধর। আরেকজনের নাম, রাক্ষস। দু’জনেই খুব জ্ঞানী ছিলেন। রাক্ষস ছিলেন বিনয়ী, নম্র স্বভাবের। এবং রাজার প্রতি অনুগত। আর শটধর ছিলেন, উদ্যত এবং সবসময় ক্রোধের আগুনে জ্বলতেন। এছাড়া দীর্ঘ সময় মন্ত্রী থাকায় রাজার উপর অধিপত্য বিস্তার করতে চাইতেন। যা মহানন্দের একদম পছন্দ ছিল না। যার কারণে কোন একসময় শটধরের উপর ক্রোধান্বিত হয়ে, মন্ত্রিত্ব কেড়ে নেন। সেই সাথে বন্দী করে মন্দিরে রেখে দেন!
এতে শশধর রাজা’র উপর ভীষণ ক্ষিপ্ত হন। এবং সময়ের অপেক্ষায় থাকেন, কি করে অপমানের বদলা নেয়া যায়। বদল হবে রাজাকে সিংহাসন চ্যুত করা। অপেক্ষা করতে,করতে দীর্ঘ সময় পার হয়ে যায়। ইতিমধ্যে এক, এক করে পরিজন সব ইহলোক ত্যাগ করে। এতে শটধর আরো ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। তবে শটধরের মনোবাসনা পূরণের সময় চলে আসে। এটা সম্ভব হয় রাজা মহানন্দের অন্দর মহলের দাসী বিচক্ষণা’র কল্যাণে।
রাজা তাঁর অলিন্দে জলবিয়োগ করা শেষে হঠাৎ হেসে ওঠেন। কিছুদূর বিচক্ষণতা-ও ছিল। রাজার হাসি দেখে সে-ও হেসে ওঠে। রাজা কিন্তু ঠিকই দেখতে পান এবং বিরক্ত হন। বিচক্ষণতার কাছে হাসির কারণ জানতে চান। দাসী বলেন, আপনার হাসি দেখে আমি হেসেছি। রাজা তাৎক্ষণিক জানতে চান, আমি কেন হেসেছি তোমাকে বলতে হবে। এবার বিচক্ষণতা সঙ্কটে পড়ে যায় এবং জবাবের জন্য সময় ভিক্ষা চায়। রাজা সময় দেন। বিচক্ষণতা জানতেন, এর জবাব একমাত্র মন্ত্রী শটধরের কাছে রয়েছে।
দাসী অবশেষে শটধরের দ্বারস্থ হয়। শটধর সবকিছু শোনার পর, রাজার হাসির কারণ ব্যাখ্যা করেন। বিচক্ষণতা -ও হুবহু রাজার কাছে বর্ণনা করেন। রাজা বুঝে যান, এটা তাঁর দাসীর কর্ম নয়। কে শিখিয়ে দিয়েছে জানতে চাইলে,শটাধরের নাম বলে দেয়। শটাধরের জ্ঞানের পরিধি দেখে আবার মন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়। এবং মন্ত্রী রাক্ষসের পরেই তাঁর অবস্থান হয়।
শটাধর মন্ত্রীত্ব ফিরে পাওয়ার পরই সে পরিকল্পনা করতে থাকে। কি করে রাজাকে সিংহাসনচ্যুত করা যায়। এদিকে পরিজন হারিয়ে শটাধর সবসময় একাকিত্ব হয়ে সময় কাটায়। এই একাকিত্ব কাটাতে প্রায়ই ঘোড়া নিয়ে বেরিয়ে পড়তেন। এই একা, একা ঘোরার সময় দীর্ঘায়িত কৃষ্ণাঙ্গ ব্রাহ্মণ চাণক্যের সাথে দেখা হয়ে যায়।
শটাধর দেখতে পান, চাণক্য কুশমূল ( কাশফুল গাছের মতোই) উৎপাটন করছেন। শটাধর একটু অবাকই হন। কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করেন, ওহে ব্রাহ্মণ কুশমূল তুলছেন কেন ! চাণক্য জবাব দেয়, আমি ব্রম্মাচার্য্য জ্ঞান অর্জন শেষ করে লোকাচার্য্যে ফিরে আসছি। তাই বিয়ে করতে যাচ্ছিলাম। এই কুশমূলে হোঁচট খেয়ে আঘাতপ্রাপ্ত হই। সম্পূর্ণ সুস্থ না হয়ে বিয়ে এবং শত্রুর বিরুদ্ধে সিদ্ধান্ত ঠিক নয়। তা-ই কুশমূল উৎপাটন করছি।
শটাধর মন স্থির করে ফেললেন, কদাগার এই জেদি ব্রাহ্মণকে দিয়েই তাঁর দীর্ঘদিনের স্বপ্ন সফল হবে। শটাধর, চাণক্য-কে প্রস্তাব দেন শহরে চতুষ্পাঠী-তে ( বেদ অধ্যায়নের পাঠশালা বা টোল)। চাণক্য রাজি হয়ে যান।
কিছুদিনের মধ্যেই শটাধর সুযোগ পেয়ে গেলেন। মহানন্দের পিতার শ্রাদ্ধের দিন ধার্য্য হয়। শটাধর মনস্থির করলেন, শ্রাদ্ধের দিন চাণক্যকে পাত্রীয় আসনে বসিয়ে দেবেন। কদাকার ব্রাহ্মণকে দেখে রাজা মহানন্দ ক্ষিপ্ত হয়ে উঠবে এবং অপমান করে চাণক্যকে বের করে দেবে। যা ভাবা তাই তিনি করে রাজপ্রাসাদ ত্যাগ করেন। রাজা চাণক্যকে দেখামাত্র ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন। এবং অপমান করে দেন। চাণক্যের অন্তরে অপমানের আগুন জ্বলে ওঠে। এবং এই অপমানের প্রতিশোধ নিতে মনস্থির করে ফেলেন। অপমানিত হৃদয়ে চাণক্য রাজপ্রাসাদ থেকে বের হয়ে আসেন।
অপমানিত চাণক্য খুঁজে বেড়াচ্ছিলেন এমন কাউকে যে হয়ে উঠবে মগধের পরের সম্রাট। এরপরই জঙ্গলের মধ্যে বন্ধুদের সঙ্গে ‘রাজা রাজা’ খেলতে থাকা এক বালককে চোখে পড়ে তাঁর। ছোট্ট ছেলেটির বিচার বিবেচনা ও আত্মবিশ্বাস চাণক্যকে মুগ্ধ করে। তাকে দেখে চাণক্য বুঝতে পারে, এই ছেলেই পারবে তাঁর আগামীর স্বপ্নকে সার্থক করতে পারবে।
এই সময়ে চাণক্যের সঙ্গে ছিল আরেক জন। সে ছিল, মহানন্দের ছেলে পর্বত। তারও লক্ষ্য ছিল রাজসিংহাসন। বাবার লুকনো ধনসম্পদের হদিশ দিয়ে সে চাণক্যের বিশ্বাসভাজন হয়ে ওঠার চেষ্টা করে। কিন্তু চাণক্য তাঁকে পরবর্তী রাজা হিসেবে গড়ে তুলতে খুব একটা ইচ্ছুক ছিলেন না। তবু ফেলতে না পেরে সঙ্গে রেখেছিলেন। চন্দ্রগুপ্তকে পেয়ে চাণক্য অবশ্য নিঃসংশয় হন, পর্বত বা অন্য কেউ নয়, মগধের পরবর্তী রাজাধিরাজকে তিনি পেয়ে গেছেন।শেষ পর্যন্ত তক্ষশীলায় নানা বিষয়ে শিক্ষিত হয়ে বহু চেষ্টা ও কৌশলে মহানন্দকে পরাজিত করে মগধরাজ হন চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য।
কিন্তু পর্বত ! এ কাহিনী ছিল এক নিষ্ঠুর উপাখ্যান । সেই সময় চন্দ্রগুপ্ত ও পর্বতকে নিয়ে লুকিয়ে বেড়াচ্ছেন চাণক্য। এসে উঠেছেন কাশীতে। সেই সময় এক ধনী ব্যক্তির থেকে দুটো সোনার হার উপহার পান ছদ্মবেশী পর্বত ও চন্দ্রগুপ্ত। ‘গুরু’ চাণক্য দিলেন কঠিন এক পরীক্ষা। পর্বতকে বললেন, ঘুমন্ত চন্দ্রগুপ্তকে না জাগিয়ে তাঁর গলা থেকে সরিয়ে আনতে হবে সোনার হার। কিন্তু পর্বত পরীক্ষায় হেরে যায়। একই পরীক্ষা চন্দ্রগুপ্তকে দেয়া হশ। চন্দ্রগুপ্ত নিঃশব্দে ঘুমন্ত পর্বতের গলা কেটে হার সরিয়ে নিয়ে আসে। কিশোর চন্দ্রগুপ্ত! রাজনীতিতে ক্ষমতা দখলের পিছনে যে রক্তের দাগের আলপনা, তা যে যুগ যুগ ধরে সভ্যতার সঙ্গী, সেকথাই আজও আবহমান কাল ধরে চলে আসছে।
একবিংশ শতাব্দীতে এসে তৃতীয় বিশ্বের নেতারা জানে না ! জানে না, তারা কার ক্রিয়ণক হয়ে কাজ করছে।
হয়-তো দুর থেকে কারো ইশারা। কিংবা তৃতীয় কোন পক্ষের নির্দেশনা। যা পালন করলে রাষ্ট্র ক্ষমতায় যাওয়ার পথ সুগম হবে।
তৃতীয় পক্ষ তার ইচ্ছা পূরণে কখনও আদর্শের ফেস্টুন হাতে ধরিয়ে দেয়। আবার ধর্মের পোশাক গায়ে চাপিয়ে দিয়ে হৃদয়ে ধুপের আগুন জ্বালিয়ে দেয়। সংস্কৃতি বা জাতীয়তাবাদের শ্লোগান এবং লাঠি-গুলি, টিয়ার গ্যাস-ও আছে। আধুনিক চাণক্যদের স্ক্রিপ্ট বানানোই থাকে। তারা ঠিক করে দেয় সবকিছু। কখন কোন দেশে, কাকে দিয়ে, কোন পথনাটক কিভাবে রাজপথে নামাতে হবে !
যারা নির্দেশ পালন করেন, তারা নিজেরাও জানেনা। কার স্বার্থে, কি করতে যাচ্ছে ! নিজের না রাষ্ট্র বা জাতির পক্ষ হয়ে কাজ করছেন ! জানে শুধু নির্দেশ পালন। কতোটা নিখুতভাবে সম্পন্ন করতে হবে!
আজকের চাণক্য হচ্ছে, কর্পোরেট বাণিজ্য গোষ্ঠী।
রাজনৈতিক দলের নেতা বা বুদ্ধি দীপ্ত বুদ্ধিমান গোষ্ঠী জানেন কি না সন্দেহ আছে। কর্পোরেট গোষ্ঠী নিজেদের স্বার্থে কখন-ও কাকে কাছে টানছে। আবার মুহূর্তেই ছুড়ে ফেলছে !
এই যে, উপমহাদেশের দুই পারমাণবিক শক্তিধর দেশের মধ্যে তিনদিনের যুদ্ধ হয়ে গেলো। এ-ই রাষ্ট্র নায়কেরা পরাজিত হয়নি। পরাজিত হয়েছে দুই দেশের জনগণ। কেননা এই যুদ্ধের ভার তাদেরকে বইতে হবে দীর্ঘ সময়।
বিজয়ী হয়েছে তারা, এই দুই দেশের মধ্যে যুদ্ধ বাঁধিয়ে সহস্র কোটি টাকার সমরাস্ত্র বিক্রি করেছে। আর দেশীয় কিছু উচ্ছিষ্ট দালাল। বা বিশেষজ্ঞ ব্যবসায়ী তার হয়তো কিছু লাভবান হয়ে থাকে।
যে দেশ থেকে সমরাস্ত্র এসেছে সেই দেশের জনগণও হয়-তো এই যুদ্ধ চায়নি। কিন্তু কর্পোরেট বানিজ্য গোষ্ঠীর স্বার্থ সংরক্ষণ করতে পরাশক্তিধর দেশগুলোর নির্বাচিত প্রতিনিধিরাও নিঃশব্দে মেনে চলছেন। এই সকল কর্পোরেট বাণিজ্য গোষ্ঠীর কাছে আমাদের সকল সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য আটকে গেছে।
তাই তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর রাষ্ট্রপ্রধান বা সরকার প্রধানরা বিষয়গুলো কিছুটা হলেও জানেন। এ কারণেই সবসময় আশঙ্কায় থাকেন। তাই তারা রাতে বিছানায় যাওয়ার সময়-ও নিশ্চিত নয়,পরদিন ক্ষমতায় থাকবে, কি না !



