Top Newsজাতীয়মতামত

বঙ্গভূমি ও এক উপাখ্যান

শাহীন রাজা: পুরাণ কাহিনি। সময়টা দ্বাপর যুগ। মথুরার রাজপ্রাসাদে শ্রী কৃষ্ণ, সিংহাসনে চিন্তিত বদনে। হাতে একটা স্বর্ণের বেজি। এ বেজি যার হাতেই যায়, তাঁর আয়ুকাল বড়জোর একবেলা থেকে একদিন ! ইতোমধ্যেই কয়েকজনকে প্রিয়জনেরা হত্যা করেছে। শ্রীকৃষ্ণ বেশ ভাবনায় পড়ে যান। তাঁর রাজ্যে এই অনাচার! এ-র বিহিত কি ? কেন এমন হচ্ছে !
শ্রীকৃষ্ণ, তাঁর বিশ্বস্ত এবং সর্বক্ষণের সঙ্গী অর্জুনকে ব্যাখ্যা করতে বলেন। মহামতি অর্জুন কেন এমনটা হচ্ছে, বলবেন কি ? অর্জুন পুরো বিষয়টা শ্রীকৃষ্ণের কাছে তুলে ধরেন।

ভগবান কৃষ্ণ, আপনার এই বিশাল সাম্রাজ্যের পূর্বে এক সামন্ত রাজা আছেন। লাগাতার খরা এবং অতি বৃষ্টির কারণে ফসল হচ্ছে না ঠিক মতো। এ জন্য এলাকাটি দুর্ভিক্ষ পিরীত। প্রজাদের ঘরে খাবার নেই। তারপরও সামন্ত রাজা, রাজ্যের ব্রাহ্মণদের ভোজে নিমন্ত্রণ্য করেন। তবে একথাও ঘোষণা করেন প্রতি এলাকা থেকে একজনের বেশী নিমন্ত্রণ্যে আসতে পারবে না।

নিমন্ত্রণের দিন এক গরীব ব্রাহ্মণ-ও উপস্থিত হন। রাজ প্রাসাদে পূজা-অর্চনা শেষে সবাইকে খাবার দেয়া হয়। তবে যৎসামান্য। গরীব ব্রাহ্মণ, কলাপাতায় দেয়া খাবার অসুস্থ স্ত্রীর জন্য রওনা দেন। বাড়িতে পৌঁছে স্ত্রীর হাতে খাবারটি দিয়ে বলেন, তুমি অসুস্থ খাবারটা তুমিই খাও। খাবারটি অসুস্থ স্ত্রীর হাতে দেয়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই ক্ষুধার্ত ব্রাহ্মণ মৃত্যু কোলে ঢলে পড়েন।

ব্রাহ্মণ্যের অসুস্থ স্ত্রী খাবারটি হাতে নিয়ে ভাবতে থাকেন, তাঁর মৃত্যু সময় নিকটে। তার উপর স্বামীও বেঁচে নেই। খাবারটি বরঞ্চ ছেলেকে দিয়ে দেই। ছেলের বউ আছে। ভবিষ্যৎ রয়েছে। তাকেই দেয়া উত্তম। যে ভাবনা, সেই কাজ। ছেলের হাতে খাবারটি দিয়ে ক্ষুধা যন্ত্রণায় ব্রাহ্মণ্যের স্ত্রী’ও মাটিতে শুয়ে পড়েন। এবং মৃত্যু হয়। ব্রাহ্মণ্যের ছেলে’র মাথায় আসে, বউ তাঁর অন্তঃসত্ত্বা। খাবারটা বউ খেলে বেঁচে যাবে। এবং আগামী প্রজন্ম, প্রজন্মের ধারাবাহিকতা টিকিয়ে রাখবে।
বউকে ডেকে খাবারটা ব্রাহ্মণ্যের ছেলের বউয়ের হাতে তুলে দেয়। এবং ছেলেও মারা যায়। ক্ষুধায় পরপর তিনজনের মৃত্যু দেখে, ছেলের বউয়ের মাথা এলোমেলো হয়ে যায়। ক্ষুধা, ক্ষোভ এবং বেদনায় কলাপাতায় পেচানো খাবার একসময় ছুড়ে ফেলে দেয়। এবং সে-ও মৃত্যু কোলে লুটিয়ে পড়ে।

ব্রাহ্মণ্যের বাড়ির পাশেই ছিল, ছোট্ট একটা জঙ্গল। সেই জঙ্গল থেকে একটা বেঁজী বেড়িয়ে এসে কলাপাতায় থাকা রাজপ্রাসাদ থেকে দেয়া খাবার খেতে শুরু করে। খাবার মুখে দেবার কিছুক্ষণের মধ্যেই গায়ে আগুন জ্বলে ওঠে। মুহূর্তেই বেঁজীটি আগুনে পুড়ে স্বর্ণে রূপান্তরিত হয়ে যায় !

পরদিন সকালে এক কাঠুরে ঐ পথ দিয়ে জঙ্গলে যাচ্ছিল,কাঠ কাটতে। পথে দেখতে পায় স্বর্ণের বেঁজী। দেখামাত্র তাঁর ঝোলায় বেঁজীটা তুলে নেয়। এর কিছুক্ষণ পর কাঠুরের সাথে আরেক কাঠুরে বন্ধুর দেখা হয়। দিনভর দুজনে একসাথে জঙ্গলে কাঠ কাটে। একবারের জন্য-ও স্বর্ণের বেঁজী পাওয়া কাঠুরে বন্ধুকে কিছুই জানায় না। অবশেষে এই প্রাপ্তির কথা পেটে ধরে রাখতে না পেরে, বন্ধুকে বলে দেয়।

এরপর বেলা শেষে বন্ধুকে হত্যা করে স্বর্ণের বেঁজী নিয়ে নেয়। এরপর শুরু একের পর এক হত্যা কান্ড। যার হাতেই বেঁজীটি থাকে, তাঁকে হত্যা করে আপনজন বেঁজীটা হস্তগত করে। এইভাবে হত্যাকাণ্ডের সংখ্যা ক্রমান্বয়ে বাড়তে থাকে !
শ্রীকৃষ্ণ সম্পূর্ণ ঘটনাটি শোনার পর সভার সকলকে বলেন, এ-ই বেঁজী’র মধ্যে রয়েছে ক্ষুধা,ক্ষোভ এবং বেদনার আগুন। এই আগুন যদি আমার রাজ্যে থাকে তাহলে এই রাজ্যের গোটা জনপদ জনশূন্য হয়ে পড়বে। তাই এখানে এক মূহুর্ত-ও রাখা যাবে না।

শ্রীকৃষ্ণ, অর্জুনকে তীর-ধনুক আনতে বলেন। নির্দেশ দেন, বেঁজীটি তীরের আগায় বেঁধে ধনুক দিয়ে ছুঁড়ে দেয়া হোক। অর্জুন ছিল সবথেকে বলশালী। তাই তাঁকে বলরাম-ও বলা হয়। অর্জুন, বেঁজীকে তীরের মাথায় ধনুকের ছিলা টেনে ছুঁড়ে দেয়।

তীরে বাঁধা বেঁজী ভারতের সর্বশেষ পূর্বে বঙ্গোপসাগরে প্রান্তে এসে পড়ে ! বেঁজীটা পরা মাত্র বেঁজীর চারপাশে বালি জমতে থাকে। বালি জমতে, জমতে একসময় বদ্বীপের সৃষ্টি। যা বঙ্গদেশ বা বর্তমান বাংলাদেশ।

ইতিহাস পর্যবেক্ষণ করে দেখা যায়, শশাঙ্ক আমল পার হয়ে পাল, সেন, সুলতানি, মুঘল এবং ব্রিটিশ সময়কাল পর্যন্ত অসন্তোষ এবং বিদ্রোহ পূর্ণ এক ভূখণ্ড। যার ধারাবাহিকতা এখন-ও চলছে! এ-ই ভূখণ্ডের মানুষের শান্ত স্বভাবের কিন্তু নিয়ন্ত্রিত নয়। এদের নিয়ন্ত্রণ করা সহজ নয়। তবে সমঝোতা করে চলতে হয়। একবার যদি মনে করে শাসকগোষ্ঠী তাঁদের সবদিক থেকে বঞ্চিত করছে। তৎক্ষণাৎ তারা বিদ্রোহ করে বসে। এবং তারা পরাধীন থাকা একদম পছন্দ করে না। এবং করে নাই।

এর বিপরীত-ও আছে। এই জনপদের, জনগোষ্ঠী যদি মনে শাসক তাদের পক্ষের শক্তি। তাহলে বুক চেতিয়ে এই শক্তিকে রক্ষার চেষ্টা চালায়। বিপদ অতিক্রম না করা পর্যন্ত পাশেই থাকে। তারপরও নিয়ন্ত্রণ করতে গেলেই সমস্যা সৃষ্টি হয়।

Show More

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button