Top Newsমতামত

গণতন্ত্র এবং মিথ সিসিফাস

মোহনা অনলাইন

গ্রিক পুরাণে এক চরিত্র, সিসিফাস। সিসিফাস ছিলেন, অত্যাচারী এবং দূর্বৃত্ত শাসক। তিনি খুবই ধুরন্ধর শাসক ছিলেন। সিসিফাস প্রজাদের সাথে সবসময় ছলনা করতেন। এমনকি দেবতাদের সাথেও ছলনা করাটাও ছিল নৈমিত্তিক ! এবং তার কাজই ছিল দেবতাদের বিরুদ্ধাচারণ করা।

সিসিফাসের কর্মকান্ডে দেবতাগণ একসময় তাঁর উপর ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেন। ক্ষিপ্ত হয়ে দেবগণ, সিসিফাসকে অভিশাপ দেয়। অভিশাপের ফলে, সিসিফাস পাতালে বসবাস করবে। সেইসাথে শাস্তি হিসেবে, একটা ভারি পাথরখন্ড পাতাল থেকে খাড়া পাহাড়ের চূড়ায় টেনে তুলতে হবে।

ভারী পাথরখন্ড পাহাড়ের চুড়ায় উঠানো মাত্রই সিসিফাসের চোখ ফাঁকি দিয়ে আবার পাতালে পড়ে যায় ! আবারও সিসিফাসকে পাথরখন্ড টানতে হয়। এভাবেই অনন্তকাল ধরে অভিশপ্ত সিসিফাস পাথর টেনে চলছেন ! দেবগণের অনেক পরের কথা। খ্রিষ্টপূর্ব প্রথম শতকের দার্শনিক লুকরেটিয়াস, পৌরাণিক কাহিনী সিসিফাস সম্পর্কে বক্তব্য রেখেছেন। তিনি ব্যখ্যা করেন সিসিফাস হচ্ছে সেই রাজনীতিক, যে ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য চিরকাল চেষ্টা করে। কিন্তু কোনো দিনও ক্ষমতায় যেতে পারে না !

পরবর্তী দার্শনিক সলোমন রিনাকের ব্যাখ্যা হলো, মানুষ সিদ্ধি অর্জনের জন্য সাধনা করে। কিন্তু চেষ্টা আর প্রাপ্তির মধ্যে পার্থক্য সবসময় থেকেই যায়। পার্থক্য লাঘবের ব্যর্থ প্রয়াসই হলো সিসিফাসের নিয়তি।

আমাদের গণতন্ত্র-ও বোধহয় এমনটাই। বাংলাদেশ সৃষ্টির পর থেকেই আমাদের আকাঙ্খা হচ্ছে, একটা গণতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা । আমাদের এই চাওয়াটা, বসন্ত বাতাসের মতোই । এই সুবাতাস ক্ষনিকের জন্য। তারপর আবার চৈত্রের তাপদহন। এবং কাল বৈশাখী ঝড়। এই গণতন্ত্রে সাধারণ মানুষ কতটুকুই লাভবান হয়। সবটাই উচ্চ এবং উচ্চ মধ্যবিত্ত সুবিধাবাদীদের স্বার্থ বহন করে। এই সুবিধা প্রাপ্তিই একসময় স্বৈর মানসিকতা সৃষ্টি হয়। এ-থেকে আবারও ভোটাধিকার হারিয়ে যায়, অনেকদিনের জন্য ।

দেশটার পঞ্চাশ বছর পার হয়ে গেছে। এখনও গণতন্ত্রের এই ইদুর বেড়াল খেলা চলছে। কিংবা সিসিফাসের গণতন্ত্রের পাথর পাহাড়ের চূড়ায় তোলার ব্যর্থ চেষ্টা !

গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার প্রথম ধাপ হচ্ছে- একটা অবাধ, সুষ্ঠ এবং নিরপেক্ষ নির্বাচন। ভোটা তাঁর পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দেয়ার নিশ্চয়তা। এবং সংসদের মেয়াদ শেষ হওয়ার সাথে, সাথেই আগামী সংসদের জন্য নির্বাচন। এবং সুষ্ঠ, অবাধ এবং নিরপেক্ষ নির্বাচন হতে হবে। এটা হচ্ছে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিষ্ঠায় প্রধান সংস্কার।

জনগণের ভোট প্রদানের অধিকার অব্যাহত থাকতে হবে। এই ব্যবস্থা চালু থাকলে, পাঁচ বছর অন্তর প্রার্থীকে ভোটারের মুখোমুখি হতে হবে।প্রার্থীর মাথায় থাকবে অনিয়ম করলে ভোটাররা মুখ ফিরিয়ে নেবে। হয়-তো একদিন বা এক মেয়াদে সব অনিয়ম ধুয়েমুছে যাবে না। নিরপেক্ষ ভোটের সংস্কৃতি চালু থাকলে একসময় দেশের জনগণ এবং শাসক উভয়ই গণতান্ত্রিক সংস্কৃতিতে অভ্যস্ত হয়ে উঠবে এবং দেশের সকল অনিয়ম একটা, একটা করে নির্মূল হয়ে যাবে।

গণতন্ত্র নামে বানিজ্য বন্ধ করতে হবে। যেই ক্ষমতায় আসে তাঁর মনে ভাবের উদয় হয়, তাঁকে ছাড়া দেশের কল্যাণ সম্ভব নয়। এই ভাবের সৃষ্টি হওয়ার মধ্য দিয়েই স্বৈরতন্ত্রের দরজা উন্মোচিত হয়। তাই দেশের জন্য কোন ব্যক্তি বা দল অপরিহার্য নয়। জনগণ সিদ্ধান্ত নেবে দেশ এবং দেশের কল্যাণে ব্যক্তি বা কোন রাজনৈতিক দল কতোটা অপরিহার্য।

সিসিফাসের গণতন্ত্র নামের পাথরটি পাহাড়ে ওঠা আর নামার খেলায় বাংলাদেশ ক্লান্ত। বাংলাদেশ,এই ভার বহন করতে আর পারছে না! লক্ষ কোটি প্রাণের বিনিময়ে প্রাপ্ত বাংলাদেশকে আমাদের সুস্থ রাখতে হবে।

আমরা যদি ব্যর্থ হওয়া যাবে না। যুগের পর যুগ যদি একই জায়গা ঘুরপাক খেতে থাকি। তাহলে একদিন হয়-তো আমাদের প্রাণপ্রিয় জন্মভূমি, বঙ্গোপসাগরের অথৈ জলে তলিয়ে যাবে !

Show More

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button