Top Newsজাতীয়মতামত

আমাদের প্রমিথিউস: শহীদ জিয়া

শাহীন রাজা :প্রমিথিউস স্বর্গ থেকে আগুন চুরি করে এনেছিল, শুধু মানুষের জন্য। সেই আগুনের আলোতেই জ্ঞান, প্রযুক্তি আর সভ্যতার সূচনা ঘটে। কিন্তু দেবরাজ জিউসের তা ভালো লাগে না। তিনি আশঙ্কা করেন, মানুষ দেবতাদের চেয়েও এগিয়ে যাবে। তাই ষড়যন্ত্র করে প্রমিথিউসকে বন্দী করে, তাঁর শাস্তি নিশ্চিত করেন। আর শুরু হয় দেবতাদের পুনরায় কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা।

জিয়াউর রহমান

ঠিক তেমনই একজন ছিলেন শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান। স্বাধীনতার ডাক দিয়ে শুরু করে, গণতন্ত্র ফিরিয়ে দেওয়া, অর্থনীতিকে গতিশীল করা—সবকিছুতেই তিনি ছিলেন অগ্রপথিক। কিন্তু এই অগ্রযাত্রা অনেকের ভালো লাগেনি। আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক শক্তিগুলোর জন্য জিয়া হয়ে ওঠেন প্রমিথিউসের মতোই একজন বিপজ্জনক আলোকবাহক। আর তাই তাঁকেও ভাগ্য মেনে নিতে হয়।

এক. মারির শীতল হাওয়ায় সেই প্রথম দেখা

পাকিস্তানের মারি সেনানিবাস। শীতকাল, নভেম্বর কিংবা ডিসেম্বর। প্রচণ্ড ঠান্ডায় দাঁড়িয়ে আছে দুই তরুণ বাঙালি লেফটেন্যান্ট। অনুষ্ঠানে যোগ দিতে এসেছে, গাড়ির অপেক্ষায়। হঠাৎ এক জিপ সশব্দে এসে থামে। সামনে বসা এক অনিন্দ্যসুন্দর নারী। তাদের বিস্ময় কাটতে না কাটতেই, গাড়ি থেকে এক কর্মকর্তা জানতে চান, “তোমরা এই শীতে এখানে দাঁড়িয়ে কেন?”

জবাবে তাঁরা জানান, অনুষ্ঠানের গাড়ির অপেক্ষায় আছেন। কর্মকর্তা বলেন, “উঠে পড়ো।” তাদেরকে গাড়িতে তুলে হলরুমের সামনে নামিয়ে দেন এবং বলেন, “অনুষ্ঠান শেষে এখানে অপেক্ষা করবে, আমি মেসে পৌঁছে দেবো।”

এই কর্মকর্তা ছিলেন মেজর জিয়াউর রহমান। কর্নেল (অব.) আকবর এই স্মৃতি তুলে ধরেছিলেন। জিয়া শুধু ঊর্ধ্বতন অফিসার নন, একজন আপোষহীন বাঙালি। কর্নেল আকবর জানান, এরপর থেকে জিয়া প্রায়ই বাঙালি অফিসারদের সঙ্গে কথা বলতেন, সচেতন করতেন বৈষম্য নিয়ে। বলতেন, “সবসময় সতর্ক থাকবে, চোখ-কান খোলা রাখবে। কিছু জানলে আমাকে কিংবা মঞ্জুরকে জানাবে। প্রয়োজনে ওসমানী স্যারকেও।”

দুই. সার্ক এবং নেতৃত্বের প্রজ্ঞা

আশির দশকের শুরুতে রাষ্ট্রপতি জিয়া দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন দেশ সফর করছিলেন, সার্ক গঠনের উদ্যোগ নিয়ে। সফর শেষে একদিন যুবদল নেতাদের সঙ্গে বৈঠকে বসেন। আলোচনা চলতে থাকে সার্ক নিয়ে। জিয়া স্মৃতিচারণ করেন পাকিস্তান সফরের একটি মুহূর্ত—বিদায় দিতে এসেছিলেন জিয়াউল হক। বলেছিলেন, “আমরা তো ভাই ভাই।” উত্তরে জিয়া বলেন, “১৯৭১ সালে আপনারা তা শেষ করে দিয়েছেন!”

সেই বৈঠকে প্রেসিডেন্ট জিয়া ভারতের মনোভাব নিয়েও কথা বলেন। ইন্দিরা গান্ধীকে সরাসরি প্রশ্ন করেন—আপনি সার্কে সম্মত কি না। ইন্দিরা বলেন, “আপনি একজন মুক্তিযোদ্ধা। আমার সম্মতি আছে। তবে সফল হতে পারবেন কি না, তা দেখা যাক।”

গোলাম মহিউদ্দিন খান, তৎকালীন যুবদলের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সদস্য, এই স্মৃতিচারণ করেন। জিয়া তখনকার তরুণদের বলেছিলেন, “আন্তর্জাতিক রাজনীতি জানতে হবে। তোমরাই তো আগামী দিনের নেতা।

তিন. রাষ্ট্রনায়কের দায়বদ্ধতা

প্রাক্তন প্রতিমন্ত্রী এলকে সিদ্দিকী স্মরণ করেন, ১৯৭৯ সালের শেষ দিকে তিনি পানি ও সেচ প্রতিমন্ত্রী। রাষ্ট্রপতির নির্দেশে নদী বিষয়ক একটি প্রতিবেদন তৈরি করেন, ৪০ পৃষ্ঠার। রাত ১২টায় জমা দেন জিয়ার কাছে। জিয়া বলেন, “আজ রাতটা আপনি বিশ্রাম নিন। কাল সকালে এসে নিয়ে যাবেন।”

সকাল আটটার আগে প্রেসিডেন্টের বাসায় হাজির হন সিদ্দিকী। ভাবেন, এত অল্প সময়ে পড়া সম্ভব না। কিন্তু অবাক হয়ে দেখেন, প্রতিবেদনের পাতায় পাতায় লাল কালি দিয়ে আন্ডারলাইন করা, মন্তব্য লেখা। সিদ্দিকী বিস্ময়ে বলে ওঠেন, “এই হলো জিয়াউর রহমান। বুঝলা মিয়া কিছু!”

চার. জাতীয়তাবাদ—জিয়ার ভাষ্যে

একসময় বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকাকালীন, সিনিয়র বন্ধু গোলাম মোস্তফা বলেন, “তুই জানিস, প্রেসিডেন্ট জিয়া ধানমন্ডি ২৭ নম্বরে রাজনৈতিক ক্লাস নিতেন?”

আমি বললাম, “না জানি না।” মোস্তফা একটি উদাহরণ দিলেন—“জিয়া একদিন বললেন, ক্লাস শেষে সবাই বেরিয়ে আসে। কিন্তু যে ছাত্রটি বের হবার আগে প্রতিটি বাতি ও পাখার সুইচ বন্ধ করে বের হয়, সে-ই প্রকৃত জাতীয়তাবাদী। আর রাস্তার পাশে ওয়াসার কল থেকে যদি পানি পড়ে, আর একজন রিকশাচালক যদি তা বন্ধ করে—তবে তাকেও জাতীয়তাবাদী বলো। যার মন-মননে সবসময় দেশের কল্যাণের কথা, সে-ই প্রকৃত জাতীয়তাবাদী।”

শহীদ জিয়াউর রহমান ছিলেন আলোর ফেরিওয়ালা। তাঁর গল্প শুধু একজন নেতার নয়, বরং একটি আদর্শের। প্রমিথিউসের মতোই, তিনি আগুন এনে দিয়েছিলেন—আলোকিত করেছিলেন জাতিকে। সেই আলো নিভে গেলেও তার তাপ, তার প্রভাব এখনও ইতিহাসের পাতায় স্পষ্ট।

Show More

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button