
মধ্যপ্রাচ্যে ইসরায়েলের একক অধিপত্যে নিয়ে আঞ্চলিক মুসলিম দেশগুলোর নিষ্ক্রিয়তায় বিশ্বের মুসলমানদের মধ্যে একটা ক্ষোভ রয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যের বাইরের মুসলিম গোষ্ঠী মনে করে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো ঐক্যবদ্ধ হলে ইসরায়েল একক শক্তি প্রদর্শন করতে পারতো না। কিন্তু তাদের অনেকে ধারণাই নেই রাষ্ট্রগুলো কিভাবে হাত-পা বাঁধা। তাঁদের প্রাণশক্তি অর্থ গচ্ছিত রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের ব্যাঙ্ক এবং বিনিয়োগ প্রতিষ্ঠানে। এই প্রতিষ্ঠানগুলোর মালিকানা’র অধিকাংশই ইহুদি সম্প্রদায়ের হাতে। তাই ইচ্ছে থাকলেও কোন উপায় নেই !
সত্তরের দশকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রচন্ডভাবে মুদ্রা সঙ্কটে পড়ে যায়। এই মুদ্রা সঙ্কট কাটাতে তারা সিদ্ধান্ত নেয়ে স্বর্নের পরিবর্তে ডলার হবে আন্তর্জাতিক মুদ্রা বিনিময়। ১৯৭১ সালের ১৫ আগস্ট মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন এই ঘোষণা দেন। নিক্সন-ও কিন্তু রিপাবলিকান ছিলেন।
নিক্সন এই পদক্ষেপ নিয়ে ইউরোপের অর্থনৈতিক শক্তিশালী দেশগুলোর সাথে বৈঠক করেন। কিন্ত ইউরোপ মার্কিন এই পদক্ষেপ প্রত্যাখ্যান করে। বিশেষ করে জার্মান এই পদক্ষেপের তীব্র বিরোধিতা করে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ঘনিষ্ঠ মিত্র যুক্তরাজ্য-ও এব্যাপার মেনে নেয় নি।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিশেষ করে নিক্সন তাঁর পদক্ষেপ নিয়ে মিত্রের সন্ধান করতে থাকে। ইতিমধ্যে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো জ্বালানি তেল উত্তোলনের মাধ্যমে অর্থনৈতিক অগ্রগতির পথে যাত্রা শুরু করে দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র ইউরোপের পরিবর্তে মধ্যপ্রাচ্যের সাথে সম্পর্কে আগ্রহী হয়ে ওঠে। এবং সম্পর্ক স্থাপনের সবধরনে উদ্যোগ নেয়।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর সাথে আলাপ-আলোচনা চলাকালেই, আরব-ইসরাইল যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। ১৯৭৩ সালের অক্টোবর মাসে যুদ্ধ বেধে যায়। ১৯৭৩ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে তেলের দাম আরব বিশ্ব ৩০০ শতাংশ বাড়িয়ে ফেলে । ওপেক সংগঠনের একটি বড় অংশ আরব বিশ্ব, ইসরায়েলের সাথে অতিরিক্ত বন্ধুত্বের জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা ঘোষণা করে। এর প্রভাব আমেরিকাজুড়ে অনুভূত হয়। ১৯৭৪ সালে জ্বালানি তেলের মুল্য বেড়ে যাওয়ায় আমেরিকার জনজীবন স্থবির হয়ে পড়ে। বিদ্যুত ব্যবহারে সাশ্রয়ী হওয়ার অনুরোধ জানায় যুক্তরাষ্ট্রের সরকার। এবং যানবাহন চলাচলে গতিসীমা নির্ধারণ করে দেয়। জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধি পাওয়ায়, আমেরিকায় মুদ্রাস্ফীতি বেড়ে যায়। শেয়ার বাজার ভেঙে পড়ে এবং মার্কিন অর্থনীতিতে ধ্বস নামে। এর কারণে যুক্তরাষ্ট্রের উদ্যোগে দ্রুত যুদ্ধ বন্ধ হয় !
যুদ্ধ বন্ধের কিছুদিনের মধ্যেই মার্কিন প্রেসিডেন্ট নিক্সন মধ্যপ্রাচ্য সফরে যান। ১৯৭৪ সালের জুন মাসে নিক্সন প্রথম সৌদি আরব সফর করেন। এরপর একের পর এক মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য দেশ সফর করেন। এর কিছুদিন পর জুলাই মাসেই, মার্কিন ট্রেজারি সেক্রেটারি মধ্যপ্রাচ্যে “অর্থনৈতিক কূটনীতি”র দুই সপ্তাহের সফরে যান। ট্রেজারী সেক্রেটারির সফরের উদ্দেশ্য ছিল, অর্থনৈতিক অস্ত্র হিসেবে অপরিশোধিত তেলকে নিরপেক্ষ করা। এবং একটি প্রতিকূল রাজ্যকে তার নতুন আবিষ্কৃত পেট্রোডলার সম্পদ দিয়ে আমেরিকার ক্রমবর্ধমান ঘাটতি অর্থায়নের জন্য রাজি করানো !
জুলাই মাসেই, সৌদি আরব তার তেলের ডলার মার্কিন ট্রেজারিগুলিতে বিনিয়োগ করার সিদ্ধান্ত নেয়।এই তথ্যটি ২০১৬ সাল পর্যন্ত গোপন রাখা হয়েছিল। এরপর একে একে মধ্যপ্রাচ্যের সবকয়টি দেশের সাথে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র একই ধরনের চুকি স্বাক্ষর করে।
১৯৭৪ সালের জুন মাসে, নিক্সন মার্কিন-সৌদি আরব অর্থনৈতিক সহযোগিতা সংক্রান্ত যৌথ কমিশন প্রতিষ্ঠা করে। যা মার্কিন অস্ত্রের বিনিময়ে তেল বিক্রি এবং সৌদি রাজ্যকে সুরক্ষা প্রদানের জন্য ডলারে তেল বিক্রির মূল্য নির্ধারণ করবে। চুক্তির পরের সপ্তাহ থেকে ১৯৭৫ সালের মধ্যে সমস্ত ওপেক ভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে মধ্যপ্রাচ্য ভিত্তি সদস্যরা অস্ত্র এবং সামরিক সহায়তার বিনিময়ে ডলারে তেল বিক্রি করতে সম্মত হয়। চুক্তিটি পাঁচ বছরের জন্য হলেও বছরের পর বছর ধরে এটি পুনরাবৃত্তি করা হয়েছিল।
১৯৭৪ থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে ডলার নিজেই ৫৩৭ শতাংশ মুদ্রাস্ফীতির সম্মুখীন হওয়া সত্ত্বেও, পেট্রোডলার তখন থেকে শক্তিশালীভাবে রাজত্ব করেছে !
এই চুক্তির পরবর্তী পর্যায়ে যুক্তরাষ্ট্রের ডলার আর্থিক বিনিময়ে স্বর্নের বিকল্প হিসেবে বিশ্ববাজার লাভ করে। আর মধ্যপ্রাচ্য হারায় দরকষাকষির সুযোগ।
তবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র লাভবান হলেও, মূলতঃ লাভবান হয় ইহুদি সম্প্রদায়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ব্যাঙ্ক এবং বিনিয়োগ প্রতিষ্ঠানগুলো অধিকাংশ ইহুদিদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের সবকয়টি দেশের টাকা গচ্ছিত রয়েছে এই সকল প্রতিষ্ঠানে। তার পরিমাণ হবে কয়েক ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার। তাই ইচ্ছে থাকলেও ইসরায়েলের বিরুদ্ধে তাদের কিছুই করার নেই। এমনকি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র-ও এই সম্প্রদায়ের কাছে জিম্মি।
মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো ইসরায়েলের বিরুদ্ধে কোন উদ্যোগ নেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া মাত্রই গচ্ছিত অর্থের সবটাই আটকে দেবে। এক্ষেত্রে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তাদের পক্ষেই থাকবে। কেননা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি ইহুদিরা নিয়ন্ত্রণ করছে। তাই তারা সবসময় ইসরায়েলের পাশে থাকবে। এবং শেষ পর্যন্ত ইসরায়েলের অস্তিত্ব রক্ষায় সচেষ্ট থাকবে।