
শনিবার রাত প্রায় শেষ এবং রোববার ভোরের অপেক্ষায় সময়। ইরানের ধুসর বালু তখনও শিশিরভেজা। ঠিক এমন এক সময়! মার্কিন যুদ্ধবিমান বোমা বোমা নেমে আসে। ৩০ হাজার পাউন্ড ওজনের বাঙ্কার বাস্টার বোমা। লক্ষ্যস্থান ইরানের পারমাণবিক স্থাপনা! গোটা বিশ্ব বিস্মিত হল আরেকবার। তবে পরমুহূর্তেই ইতিহাস সামনে চলে আসে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এমন অনেক ইতিহাস আছে!
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় বোমা ফেলার পক্ষে যুক্তি দেখিয়েছে, “শক্তির মাধ্যমে শান্তি”! এই যদি শান্তির বার্তা হয়, তাহলে শান্তি কী? অপরদিকে ইরানের বিপ্লবী গার্ড প্রতিক্রিয়া হিসেবে বলেছে, “প্রতিশোধ নেবই, আমেরিকার পালানোর কোনও পথ নেই”! তাহলে আর শান্তির অবস্থান কোথায়?
ট্রাম্প, রাজনীতিতে আসার পর দীর্ঘ সময় ইরাক এবং আফগানিস্তান যুদ্ধের সমালোচনা করতেন। তিনি আফগানিস্তানে আমেরিকার “চিরস্থায়ী যুদ্ধ” বোকামি বলে উপহাস করতেন। তিনি এ ধরনের যুদ্ধে জড়াবেন না বলে প্রচার করতেন। অথচ তার শাসনামলে বড় যুদ্ধে জড়িয়ে গেলেন। বিশ্ব মোড়লেরা যদি একটা শান্তিপূর্ণ নিষ্পত্তি বা সমাধানে এগিয়ে না আসে, এই যুদ্ধ বিশ্ববাসীর জন্য হবে ভয়াবহ। আফগানিস্তান এবং ইরাকের তুলনায় এই যুদ্ধ হবে অনেক বিস্তৃত এবং দীর্ঘ সময়ের!
এই যুদ্ধের প্রধান ভয়াবহতা হচ্ছে অর্থনৈতিক মন্দা! বিশ্বের প্রতিটি দেশ আক্রান্ত হবে। তবে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর মানুষের কষ্ট বহুগুণ বেড়ে যাবে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং তার সহযোগী ইসরায়েল ভাবছে, শক্তির মাধ্যমে ইরানকে দুর্বল করে দেওয়া। ইরান দুর্বল হয়ে পড়লে, ভেতর থেকে সরকার পরিবর্তন। অতীতে ইরাক এবং লিবিয়ায় তাই করা হয়েছে। সম্প্রতি সিরিয়াতেও একই ফর্মুলা প্রয়োগ করা হয়েছে। কিন্তু তিনটি দেশেই শান্তির পরিবর্তে অশান্তি বহুগুণ বেড়ে গেছে। তদুপরি, এই তিন দেশের তুলনায় ইরান ব্যতিক্রম। ইরানের কাঠামো বুনিয়াদ অনেক কঠিন।
ইরান যদি আমেরিকার বিরুদ্ধে প্রতিঘাত নিতে দৃঢ়ভাবে দাঁড়িয়ে যায় এবং যুদ্ধ চালিয়ে নেওয়ার ব্রত হয়ে ওঠে, তাহলে তা হবে এই সময়ে দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধ।
ইরান যদি মনে করে যুদ্ধ চালিয়ে যাবে, তাহলে প্রণালী অবরুদ্ধ করে ফেলবে। সংঘাতের আবহে ইরান হরমুজ প্রণালীতে অবরোধ সৃষ্টি করতে পারে। হরমুজ প্রণালী আটকে দিলে গোটা বিশ্ব জ্বালানী তেলের সংকটে পড়বে। কেননা, এই জলপথ দিয়েই বিশ্বের অধিকাংশ তেল আমদানি-রফতানি হয়। বিশ্ববাজারে তেলের দাম হু হু করে বৃদ্ধির সম্ভাবনা রয়েছে। এই সকল বিবেচনা করে, ইরান তার নৌশক্তিকে ব্যবহার করে হরমুজ প্রণালী সাময়িকভাবে আটকে রাখতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
পশ্চিম এশিয়ায় ইরানের সমর্থিত বেশ কয়েকটি সক্রিয় সশস্ত্র গোষ্ঠী রয়েছে। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হুথি। আশঙ্কা করা হচ্ছে, লোহিত সাগরে মার্কিন ঘাঁটিতে হামলা চালাতে পারে তারা। শুধু হুথি নয়, হিজবুল্লার মতো সংগঠনও হামলার ছক কষতে পারে বলেই মনে করছেন অনেকে।
পশ্চিম এশিয়ার এই উত্তেজনাপ্রবণ এলাকায় আমেরিকার কয়েক হাজার সেনা মোতায়েন রয়েছে। শুধু তা-ই নয়, কাতার, সংযুক্ত আরব আমিরাত, কুয়েতের মতো জায়গায় স্থায়ী ঘাঁটিও রয়েছে আমেরিকার। আশঙ্কা, এই সকল ঘাঁটি ইরানের লক্ষ্যবস্তু হতে পারে! এ ছাড়াও, পশ্চিম এশিয়ায় আমেরিকার বন্ধু দেশগুলির তেল এবং গ্যাসভাণ্ডারে আক্রমণের সিদ্ধান্ত নিতে পারে ইরান।
ইরান এই সকল উদ্যোগ গ্রহণ করলে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং তার মিত্রগোষ্ঠী ইউরোপীয় ইউনিয়ন বসে থাকবে না। কেননা, জ্বালানী তেলের সংকট দেখা দিলে তারা কেউ আর বসে থাকবে না। এরা সকলেই আমেরিকার সাথে এই যুদ্ধে অংশীদার হয়ে যাবে। মিশরের প্রেসিডেন্ট সুয়েজ খাল বন্ধ করে দেওয়ার পর ইউরোপের বৃহৎ শক্তিধর রাষ্ট্রগুলো মিশরের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছিল এবং নাসের ক্ষমতাচ্যুত করা হয়। এটা ইরানকে মাথায় রেখে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
ইরান যদি প্রতিশোধ নিতে গিয়ে কাতার, সংযুক্ত আরব আমিরাত, কুয়েতে হামলা চালায়, এই দেশগুলো ইরানের বিপক্ষে যুদ্ধে নেমে যাবে। এর মধ্যে কাতারের সামরিক সক্ষমতা অনেক বেশি। ইরান আঞ্চলিক যুদ্ধে জড়িয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। আঞ্চলিক ঐক্য না বিভেদ—তা ভাবতে হবে।
মার্কিন বিশেষজ্ঞদের বক্তব্য হচ্ছে, তেহরান যদি বড় ধরনের প্রতিশোধ নেয় বা পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির পদক্ষেপ নেয়, তবে তিনি শাসন পরিবর্তনের চেষ্টা করতে পারেন। এর ফলে হয়তো অতিরিক্ত ঝুঁকি তৈরি হবে। শাসন পরিবর্তন এবং গণতন্ত্রীকরণ প্রচারণার লক্ষ্যে উন্মাদনা না হওয়ার জন্য পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। ওয়াশিংটনের জনস হপকিন্স স্কুল ফর অ্যাডভান্সড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের মধ্যপ্রাচ্য বিশ্লেষক লরা ব্লুমেনফেল্ড বলেন, “আপনি মধ্যপ্রাচ্যের বালিতে অনেক ব্যর্থ মার্কিন নৈতিক মিশনের হাড় খুঁজে পাবেন।”
মধ্যপ্রাচ্যের জন্য প্রাক্তন মার্কিন ডেপুটি গোয়েন্দা কর্মকর্তা জোনাথন প্যানিকফ বলেছেন যে ইরানের নেতৃত্ব যদি মনে করে, তাদের অস্তিত্ব বিপন্ন, তাহলে তারা দ্রুত আক্রমণ শুরু করবে। তবে তেহরানকে পরিণতি সম্পর্কেও সচেতন থাকতে হবে, তিনি বলেন।
হরমুজ প্রণালী বন্ধ করার মতো পদক্ষেপগুলি তেলের দাম বৃদ্ধি এবং সম্ভাব্য মার্কিন মুদ্রাস্ফীতির প্রভাবের কারণে ট্রাম্পের জন্য সমস্যা তৈরি করবে। তবে এটি ইরানের কয়েকটি শক্তিশালী মিত্রদের মধ্যে একটি চীনকেও ক্ষতিগ্রস্ত করবে।
একই সময়ে, ট্রাম্প ইতিমধ্যেই ইরান আক্রমণের বিরুদ্ধে কংগ্রেসনাল ডেমোক্র্যাটদের তীব্র প্রতিক্রিয়ার মুখোমুখি হচ্ছেন। এবং তার দল রিপাবলিকানদেরও বিরোধিতার মুখোমুখি হতে হবে।
ট্রাম্প, তার প্রথম মেয়াদে কোনও বড় আন্তর্জাতিক সংকটের মুখোমুখি হননি। এখন তার দ্বিতীয় মেয়াদের মাত্র ছয় মাসের মধ্যেই যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছেন।
ট্রাম্পের “শক্তির মাধ্যমে শান্তি” স্লোগান অবশ্যই আগের চেয়ে বেশি পরীক্ষিত হবে। বিশেষ করে ইউক্রেন এবং গাজায় যুদ্ধ দ্রুত শেষ করার জন্য তার প্রচারণার প্রতিশ্রুতি পূরণে ব্যর্থ হয়েছেন। তারপরও তিনি যুদ্ধের একটা নতুন ফ্রন্ট খুললেন!
আন্তর্জাতিক সংকট গ্রুপের জাতিসংঘ পরিচালক রিচার্ড গোয়ান বলেছেন, “আমি নিশ্চিত মস্কো, তেহরান বা বেইজিং কেউ কখনও বিশ্বাস করবে না তিনি একজন শান্তিরক্ষী।”