
শাহীন রাজা : রোমান ইতিহাসে, জুলিয়াস সিজার, অগাস্টাস সিজার, মার্কাস অ্যান্টনির নাম যেমন কিংবদন্তি হয়ে আছে, হ্যানিবল আছে এই সারিতে। তেমনি ঐতিহাসিক আইকনদের ভিড়ে আরও একজনের আলোচনা অপরিহার্য হয়ে ওঠে। তার নাম ‘স্পার্টাকাস’। পৃথিবীর ইতিহাসে স্পার্টাকাসই প্রথম সংঘবদ্ধভাবে শাসক গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিলেন। কিন্তু সুবিধাবাদী গোষ্ঠী রাজতন্ত্রের প্রতি অধিক অনুগত হওয়ায়, স্পার্টাকাস ব্যর্থ হন।
রোমান সাম্রাজ্যের থ্রেস নামে অঞ্চলের একটা ছোট্ট গ্রামে স্পার্টাকাসের জন্ম হয়। ধারণা করা হয়, তরুণ স্পার্টাকাস তার শক্তিশালী গড়নের কারণে রোমান সেনাবাহিনীতে চাকরি লাভ করেছিলেন। কিন্তু পরবর্তীতে অজ্ঞাত কারণে তাকে সেনাবাহিনী থেকে বহিষ্কার করা হয়। চাকরিচ্যুত স্পার্টাকাসের ঠাঁই মিললো দাস বিক্রির হাটে। খুব দ্রুত তিনি এক দিনমজুর ঠিকাদারের নিকট বিক্রি হয়ে যান।
ক্রীতদাসের শেকল থেকে মুক্ত হয়ে স্পার্টাকাস জড়িয়ে পড়লেন রোমান পাশবিকতার ফাঁদে। গ্ল্যাডিয়েটর হিসেবে শুরু হল তার জীবনযাত্রা। কিন্তু অচিরেই বিদ্রোহ করে বসলেন তিনি। এই পাশবিক হত্যাযুদ্ধ তার কাছে সম্পূর্ণ অনৈতিক মনে হল। তার ভেতরে অসন্তোষ এবং বিদ্রোহের আগুন জ্বলতে লাগলো। সহচর হিসেবে আরও কিছু বিদ্রোহী গ্ল্যাডিয়েটরকে দলে ভেড়ালেন তিনি। আশেপাশের বিভিন্ন জায়গা থেকে অনেক ক্রীতদাসও যোগ দিল তার সাথে।
অবশেষে রোমান সম্রাটের কূটকৌশল এবং বিদ্রোহীদের লোভে স্পার্টাকাস ব্যর্থ হন। সেই সময় সাধারণ মানুষ রাজার শাসনের বাইরে বসবাস করা অভ্যস্ত হয়ে ওঠেনি। তাই বিদ্রোহীদের একটা বড় অংশ সম্রাটের আনুগত্য মেনে নেয়। এবং স্পার্টাকাস, সনাতনী ব্যবস্থার কাছে হেরে যান। তবে স্পার্টাকাস হারেনি হেরে গেছে সময়!
এরও প্রায় সতেরশো বছর পর, ১৮৭১ সালে ইউরোপের আরেকটি দেশ ফ্রান্সে আরেকটি বিপ্লব হয়েছিল, যা “প্যারিস কমিউন” নামে পরিচিত। ঐতিহাসিক সংগ্রামে উত্তাল হয়েছিল ফ্রান্স তথা সমগ্র ইউরোপ। বুর্জোয়া শাসকদের ক্ষমতাচ্যুত করে ১৮ মার্চ বিপ্লবী কেন্দ্রীয় কমিটি প্যারিসের ক্ষমতা দখল করে শ্রমিক শ্রেণির রাষ্ট্র কমিউন প্রতিষ্ঠা করে। কমিউন গুণগতভাবে ছিল বুর্জোয়া রাষ্ট্র থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। প্যারিসের শ্রমিক শ্রেণির নেতৃত্বে এই বিপ্লব ঘটে। কার্ল মার্ক্স তাঁর গ্রন্থে উল্লেখ করেন, আধুনিক বিশ্বে এটাই হচ্ছে প্রথম বিপ্লব।
প্যারিসে বিপ্লবের পর,বিপ্লবীরা শ্রমিক প্রতিনিধিদের নিয়ে শ্রম কমিশন গঠন করে। বেকার শ্রমিকদের কাজ ও সাহায্যের ঘোষণা করা হয়। অফিসার, সেনা অফিসার, বিচারপতি সকলের নির্বাচিত হওয়া বাধ্যতামূলক করা হয়। সব ধরনের নির্বাচিত ব্যক্তি অযোগ্য প্রমাণিত হলে নির্বাচকদের হাতে তাদের প্রত্যাহার করে নেওয়ার অধিকার দেওয়া হয়। শিক্ষা হয় অবৈতনিক এবং বাধ্যতামূলক।
প্যারিস কমিউন বিপ্লবও ৭৮ দিনের মাথায় ব্যর্থ হয়ে যায়! এই বিপ্লবে, বুদ্ধিজীবীদের এক অংশ প্রাথমিক পর্যায়ে অন্যায় শাসন ও শোষণে ক্লিষ্ট দেশের শ্রমিকদের পক্ষ নেয়। মেহনতি মানুষের সঙ্গে অনেকাংশে একাত্মতা প্রকাশ করে। কিন্তু উদারনৈতিক মনোভাবাপন্ন হলেও মূলত বুর্জোয়া চিন্তাধারার মধ্যেই তারা আবদ্ধ ছিল। ফলে সেই সময়কার সমাজতান্ত্রিক ভাবধারাকে তারা পুরোপুরি মেনে নিতে পারেনি।
প্যারিসের বুদ্ধিজীবীরা পূর্বতন যুগের জ্যাকোবিন চিন্তাধারার উত্তরসূরি নয়া জ্যাকোবিন চিন্তাধারাতেও পুরোপুরি আকৃষ্ট হয়ে উঠতে পারেননি। এদের অধিকাংশই ব্লাঙ্কির অনুগামী হন। ব্লাঙ্কি ছিলেন মূলতঃ নৈরাজ্যবাদী। শ্রমিক শ্রেণির বিপ্লবী ক্ষমতার প্রতি তাঁর আস্থা ছিল না। যার প্রেক্ষিতে বিপ্লবের ৭২ দিনের মাথায়, ১৮৭১ সালের ২৮ মে এই বিপ্লব ইতিহাসের পাতায় স্থান লাভ করে!
তেমনি আমাদের দেশে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট এক পটপরিবর্তন ঘটে। এই পরিবর্তনকে নানাজন, নানাভাবে বিশেষায়িত করছে। কেউ বলছে বিপ্লব। আবার কেউ বলছে সাধারণ জনগণের গণঅভ্যুত্থান। যে যাই বলুক, এটা তাদের নিজস্ব ব্যাপার। তবে দেশে এক বিশাল পরিবর্তন ঘটেছে। যে পরিবর্তন গণমানুষের মধ্যে দীর্ঘ আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন। মানুষের দীর্ঘ আকাঙ্ক্ষা ছিল, মানবিক এবং কল্যাণমুখী শাসনব্যবস্থা।
৫ আগস্ট পরবর্তী আমরা দেখলাম কিছু রাজনৈতিক দল নির্বাচনের জন্য অস্থির। বিপরীত পক্ষ নির্বাচনকে প্রলম্বিত করতে সর্বক্ষণ ব্যস্ত। একটা অবাধ এবং নিরপেক্ষ নির্বাচন অবশ্যই প্রয়োজন। কেননা অনির্বাচিত সরকার দীর্ঘ সময় থাকা জনকল্যাণকর নয়। আবার যেনতেন প্রকারের নির্বাচনও মানুষের আকাঙ্ক্ষা নয়। এই নির্বাচন ও সংস্কারের ঘোড়দৌড়ে দেশ এবং জাতি একসময় অনিশ্চয়তার দিকে ধাবিত হতে পারে!
আরেকদিকে, সংস্কার কী হবে না হবে তা শীততাপনিয়ন্ত্রিত কক্ষে বসে নির্ধারণ করার বিষয় নয়। কেননা এই অভ্যুত্থানের প্রধান নায়ক হচ্ছে বাংলাদেশের জনগণ। কী হচ্ছে না হচ্ছে তা জনগণকে অবহিত করতে হবে। কেননা এই সংস্কার তো এদেশের মানুষে জন্যই। এটা জানতে হবে।
এর বাইরেও আরেকটি বিষয় আছে জনগণ সবকিছু যে জানবে, তা-ও সঠিক নয়। মানুষ সনাতন ব্যবস্থা আঁকড়ে ধরে রাখতে স্বাচ্ছন্দ্য পায়। তাই জনগণের কাছে যেতে হবে। রাজপথে সভা-সমাবেশ করলেই হবে না। সমাবেশে গণমানুষের থেকে দলীয় লোকের সংখ্যাই বেশি থাকে।
বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, অফিস-আদালত, মিল-কারখানায় যাওয়া জরুরি ছিল। বাংলাদেশের অর্থনীতিতে সবচেয়ে বড় অবদান রাখছে কৃষক। কী করলে এদের জীবন ব্যবস্থার উন্নতি ঘটবে তা জানা একটা জরুরি কাজ। এবং সংস্কারের মধ্য দিয়ে তাদের জীবনে মানোন্নয়নে কী ভূমিকা রাখবে তা-ও জানানো দরকার। যার জন্য সংস্কার, সেই যদি না জানে তাহলে শ্রম পণ্ড হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
দেশের জনগণ যদি অতীত সংস্কৃতির বৃত্তে আবদ্ধ থাকে তাহলে নতুন কিছু গ্রহণ করা তাঁদের পক্ষে সম্ভব হবে না। দেশের মানুষকে উদ্বুদ্ধ করতে হবে, দীর্ঘদিনের সনাতনী চিন্তাভাবনার উন্নত পথে চলতে হবে। বিবর্তনকে গ্রহণ করার লক্ষ্যে তাঁদের নতুন দিকনির্দেশনা দেওয়া ছিল বড় কাজ। উল্লেখিত বিপ্লবগুলো ব্যর্থ হওয়ার প্রধান কারণ হলো ঐ সময়কার জনগণ বিপ্লবীদের বুঝতে পারেনি!
কিন্তু গত এগারো মাসে তা খুব একটা চোখে পড়েনি। সবাই আগামীতে ক্ষমতা লাভের দৌড়ে দৌড়াচ্ছে। একটা কথা মাথায় রাখা জরুরি “যেদিন থেকে ভাবতে শুরু করবেন, আপনি বা আপনার দল ছাড়া জনকল্যাণ সম্ভব নয়, সেইদিন থেকেই আপনি এবং আপনার স্বৈরাচার হয়ে গেলেন!”



