
২০২৪ সালে বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতে আমানতের ক্ষেত্রে বড় ধরনের পরিবর্তন দেখা গেছে। আর্থিক অনিশ্চয়তার মধ্যে আমানতকারীরা ঝুঁকিপূর্ণ ও বিতর্কিত ব্যাংকগুলো থেকে টাকা তুলে নিয়ে সেগুলো ভালোভাবে পরিচালিত ব্যাংকে স্থানান্তর করেছেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ তথ্যে দেখা যায়, শুধু ১০টি সমস্যাগ্রস্ত ব্যাংক থেকেই গত এক বছরে প্রায় ২৩ হাজার ৭০০ কোটি টাকার আমানত তুলে নিয়েছেন গ্রাহকরা।
যেসব ব্যাংক নিয়ে বিতর্ক বা আর্থিক দুর্বলতা ছিল, সেগুলোর আমানত উল্লেখযোগ্য হারে হ্রাস পেয়েছে। উদাহরণস্বরূপ: সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক (এসআইবিএল)। ২০২৩ সালের ৩৫ হাজার ৬৮৫ কোটি টাকা থেকে ২০২৪ সালে কমে দাঁড়িয়েছে ৩০ হাজার ৯২১ কোটিতে, কমেছে ১৫%।
ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শফিউজ্জামান জানান, এস আলম গ্রুপের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা নিয়ে বিতর্ক শুরু হলে আমানতকারীদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়ায়। ন্যাশনাল ব্যাংক এক বছরে আমানত কমেছে ৫ হাজার ৬১২ কোটি টাকা, যা প্রায় ১৩% হ্রাস। বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক ১০% কমে আমানত দাঁড়িয়েছে চার হাজার ২৬৪ কোটি টাকায়। এবি ব্যাংক ২০২৩ সালে আমানত বাড়লেও ২০২৪ সালে প্রায় ১০% হ্রাস পেয়েছে। তবে ব্যাংকটির এমডি জেড এম বাবর খান জানিয়েছেন, গুজব ও মার্জার আশঙ্কা দূর হওয়ায় জুন পর্যন্ত নতুন করে সাড়ে ছয় হাজার কোটি টাকার আমানত যুক্ত হয়েছে। বেসিক ব্যাংক, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, এক্সিম ব্যাংক, জনতা ব্যাংক উচ্চ হারে খেলাপি ঋণ ও সুশাসনের অভাবের কারণে এসব ব্যাংকের আমানত কমেছে। স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক ডলার সংকট ও বিমান খাতে ঋণ সম্প্রসারণের কারণে এই বিদেশি ব্যাংকের আমানতও প্রায় ১০% হ্রাস পেয়েছে।
অন্যদিকে, যেসব ব্যাংক ভালোভাবে পরিচালিত, স্বচ্ছতা ও সুশাসন বজায় রেখেছে, সেগুলোতে আমানতের উল্লেখযোগ্য প্রবৃদ্ধি দেখা গেছে। ব্র্যাক ব্যাংক ৩২% বেড়ে ৭৭ হাজার ৭০৫ কোটি টাকা। সিটি ব্যাংক ৩১% বেড়ে ৫১ হাজার ৪৩৬ কোটি টাকা। যমুনা ব্যাংক ২৭% বেড়ে ৩১ হাজার ৪০ কোটি টাকা। মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক, ইস্টার্ন ব্যাংক, পূবালী ব্যাংক, ট্রাস্ট ব্যাংক। প্রত্যেকটিরই আমানত প্রবৃদ্ধি হয়েছে ২০ শতাংশের বেশি। প্রাইম ব্যাংক, এনসিসি ব্যাংক, ব্যাংক এশিয়া এই ব্যাংকগুলোর শেয়ারদর বেড়েছে ১৫% এরও বেশি।
নতুন গঠিত কিছু ব্যাংকও ভালো পারফরম্যান্স দেখিয়েছে। মিডল্যান্ড ব্যাংক, বেঙ্গল কমার্শিয়াল ব্যাংক, মেঘনা ব্যাংক, সিটিজেন ব্যাংক ও সীমান্ত ব্যাংক। প্রত্যেকটির আমানত প্রবৃদ্ধি ২০% এর বেশি।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্টের অধ্যাপক ড. শাহ মো. আহসান হাবীব বলেন, “ভালো ব্যাংকগুলোতে আমানতের অস্বাভাবিক বৃদ্ধি মূলত ঝুঁকিপূর্ণ ব্যাংক থেকে অর্থ স্থানান্তরের ফল। রাজনৈতিক পরিবর্তনের পর ব্যাংকগুলোর প্রকৃত অবস্থা প্রকাশ পায় এবং গ্রাহকরা কেবল সুদের হার নয়, বরং স্থিতিশীলতা ও স্বচ্ছতাকেও গুরুত্ব দেন।”
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, দেশের ব্যাংকিং খাতের স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে সুশাসন, স্বচ্ছতা ও দক্ষ ব্যবস্থাপনার বিকল্প নেই। ব্যাংকগুলো যে আয়ের বড় অংশ ট্রেজারি বন্ড ও সরকারি বিল থেকে অর্জন করে, সেটি তাদের লাভজনকতা ও আস্থার ভিত্তি হিসেবে কাজ করছে।
২০২৪ সালের ব্যাংক খাতের চিত্র থেকে স্পষ্ট, ভালো পরিচালিত ও সুশাসিত ব্যাংকগুলোতে আমানতের প্রবাহ বেড়েছে, যা পুরো ব্যাংকিং ব্যবস্থার জন্য ইতিবাচক। তবে ঝুঁকিপূর্ণ ব্যাংকগুলোর জন্য এটি এক ধরনের সতর্ক সংকেত।