রাফিয়াত রশিদ মিথিলা—অভিনেত্রী, গায়িকা, মডেল, শিক্ষক, উন্নয়নকর্মী, মা। প্রতিটি পরিচয়ের ছায়া পেরিয়ে তাঁর জীবনগাথায় যে অনন্য কাহিনি জ্বলজ্বলে হয়ে ওঠে, তা হলো—একজন নারীর আত্মপ্রতিষ্ঠার অদম্য সংগ্রাম। তিনি রাফিয়াত রশিদ মিথিলা—বাংলাদেশের বিনোদন অঙ্গনের এক উজ্জ্বল নাম, যিনি দীর্ঘদিন ধরে নিজের অবস্থান দৃঢ়ভাবে ধরে রেখেছেন। তবে তাঁর পরিচয় শুধু একজন তারকা নয়, বরং একজন নারীর প্রেরণার প্রতীক।
মিথিলা জানেন, কীভাবে জীবনের কঠিন বাস্তবতায় দাঁড়িয়েও স্বপ্ন আঁকড়ে এগিয়ে যেতে হয়। যেমন গানে, যেমন পর্দায়—তেমনই বাস্তব জীবনের দৃঢ়তায়। সাম্প্রতিক সময়ে তাঁর ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে কৌতূহল থাকলেও, তিনি নিজের কাজ আর বক্তব্যের মাধ্যমে তুলে ধরেছেন এক ভিন্ন বার্তা—নারীর অর্থনৈতিক স্বাধীনতার বার্তা।
নিজের কথায় উঠে এসেছে জীবনের কঠিন অধ্যায়গুলো—২৩ বছর বয়সে বিয়েবন্ধনে আবদ্ধ হওয়া, অল্প বয়সেই মা হয়ে ওঠা, স্বপ্নের সংসার ভেঙে যাওয়া এবং নতুন করে পথচলার সংগ্রাম। মিথিলা বলেন, ‘২৩ বছর বয়স থেকে আমি আমার জীবনটাকে অন্যভাবে দেখতাম। হঠাৎ করে সেটি পাল্টে গেল… মেয়েদের নিজেদের কোনো আসল জায়গা থাকে না। নয় শ্বশুরবাড়ি, নয় বাপের বাড়ি। এখন এত বছর পর আমার নিজের একটা জায়গা আছে। এর কৃতিত্ব কিন্তু সম্পূর্ণ আমার।’
এই কৃতিত্ব শুধুমাত্র কথায় নয়, তাঁর কাজে প্রতিফলিত। ইউনিসেফ, ব্র্যাক, ইউনেস্কোর মতো আন্তর্জাতিক সংস্থায় যুক্ত থাকা, শিশু মনোবিজ্ঞান নিয়ে পড়াশোনা এবং পিএইচডি পর্যায়ে একাডেমিক যাত্রা—সব মিলিয়ে মিথিলা একজন অনন্য ব্যক্তিত্ব।
অভিনয় থেকেও তিনি কখনো বিচ্ছিন্ন হননি। ২০২৪ সালের শুরুতেই মুক্তি পাওয়া ‘জলে জ্বলে তারা’ কিংবা ওয়েব সিরিজ ‘অ্যালেন স্বপন ২’-এ তাঁর অভিনয় মুগ্ধ করেছে দর্শককে। ফিচার ফিল্ম থেকে নাটক, আন্তর্জাতিক প্রজেক্ট থেকে সীমান্ত পেরোনো সংলাপ—সবখানেই তিনি সরব ও দৃপ্ত।
তবে এই আলোকিত পথচলা সহজ ছিল না। বিচ্ছেদের পর জীবনের ভার একাই বহন করেছেন তিনি। ছিল অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা, অভ্যাসের সঙ্গে বাস্তবতার সংঘর্ষ। নিজের ও সন্তানের জন্য তখন একটি গাড়িও ছিল না তাঁর হাতে। সেসব অভিজ্ঞতা তাঁকে শিখিয়েছে, একজন নারীর জন্য আর্থিক স্বনির্ভরতা কতটা জরুরি। তাঁর ভাষায়, ‘আমার একটা গাড়িও ছিল না। আমি গাড়িতে চলাফেরায় অভ্যস্ত ছিলাম, আমার বাচ্চাও তাই। তখন বুঝেছিলাম, জীবনে নিজের জায়গা থাকাটা খুব দরকার। মেয়েদের জন্য সবচেয়ে আগে দরকার অর্থনৈতিক স্বাধীনতা। এই স্বাধীনতা না থাকলে তারা অনেক কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে পারে না।’
আজকের মিথিলা সেই সব বাধা পেরিয়ে নিজের জায়গা তৈরি করেছেন। সংসার, ক্যারিয়ার, একাডেমিক জীবন আর সামাজিক সচেতনতা—সব মিলিয়ে তিনি হয়ে উঠেছেন এক শক্তিশালী অনুপ্রেরণা। তাঁকে ঘিরে জনমনে যতটা কৌতূহল তাঁর ব্যক্তিজীবন নিয়ে, তার চেয়েও বেশি আলোচনার দাবি রাখে তাঁর কর্মজীবন। কারণ, আজকের এই ‘মিথিলা’ হয়ে ওঠার পেছনে রয়েছে শ্রম, সাহস, আত্মবিশ্বাস এবং স্বপ্নের প্রতি নিষ্ঠা।
তবে তাঁকেও পিছু ছাড়ে না গুঞ্জন। এসব প্রসঙ্গে মিথিলার সোজাসাপটা জবাব, ‘এত ব্যস্ত থাকি, সময়ই নেই এসব নিয়ে ভাবার। নিজের কাজ নিজেই করতে পছন্দ করি, আমার স্বামীও তাই। যারা কাজের মানুষ, তারা এসব বোঝে এবং অন্যের ব্যাপারে মাথা ঘামায় না।’
তিনি আরও বলেন, ‘যাদের কোনো কাজ নেই, তারাই সারাক্ষণ এসব নিয়ে মেতে থাকে। মানুষ কী ভাবছে, তা নিয়ে আমি কখনো চিন্তিত হই না। আমার পরিবার, সন্তান, আর কাছের মানুষরাই আমার শক্তি, তারাই আমাকে বোঝে।’
রাফিয়াত রশিদ মিথিলা কেবল একজন তারকা নন, তিনি এক জীবন্ত উদাহরণ—নারী কীভাবে প্রতিকূলতাকে পেরিয়ে নিজেকে গড়ে তুলতে পারে।



