Top Newsঅপরাধজাতীয়

প্রকল্পে দুর্নীতি–ব্যর্থতার আরেক নাম ডিএসআই

মনিরুল ইসলাম মনি, চিফ রিপোর্টার (প্ল্যানিং)

এটি কোনো কল্পকাহিনি নয়। কোটি কোটি টাকার সরকারি প্রকল্প, যা নাগরিকদের সেবা পৌঁছে দেওয়ার জন্য তৈরি, অথচ জনগণ এখনও বঞ্চিত। ফ্যাসিবাদি সময়ে দেশের প্রকল্প বাস্তবায়নে যেন দুর্নীতির মচ্ছবে মেতে ওঠে ডায়নামিক সলিউশনস ইনোভেটরস (ডিএসআই) নামের একটি সফটওয়্যার কোম্পানি। ঘুষ-দুর্নীতির মাধ্যমে কোটি কোটি টাকার প্রকল্প বাগিয়ে নিলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রেই প্রকল্পের কাঙ্ক্ষিত অগ্রগতি হয়নি। উল্টো, নিম্নমানের প্রযুক্তি, অভ্যন্তরীণ স্বার্থ, এবং রাজনৈতিক প্রভাবের অভিযোগের পর্ব চলছেই।

নাগরিকদের জন্ম, মৃত্যু, বিবাহ ও তালাকের তথ্য ডিজিটাল করার উদ্দেশ্যে ২০১৪ সালে শুরু হয় সিআরভিএস (সিভিল রেজিস্ট্রেশন অ্যান্ড ভাইটাল স্ট্যাটিসটিকস) প্রকল্প। কক্সবাজার, জামালপুর ও গাইবান্ধায় পরীক্ষামূলকভাবে ওপেন সিআরভিএস চালু হলেও ২০২২ সালে প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হওয়ার পরও সারাদেশে রোলআউট করা সম্ভব হয়নি। কোটি কোটি টাকা খরচের পরও প্রকল্পটি সীমিতভাবে বাস্তবায়ন হয়েছে। অভিযোগ রয়েছে, ডিএসআই নিম্নমানের সফটওয়্যার তৈরি করেছে, অতিরিক্ত বিলিং করেছে এবং অপ্রয়োজনীয় হার্ডওয়্যার ও ল্যাপটপ ক্রয়ের নামে অর্থ আত্মসাৎ করেছে। মাঠ পর্যায়ের রেজিস্টারদের যথাযথ প্রশিক্ষণ না দেওয়াও এ প্রকল্পে অনিয়মের অন্যতম দিক।

শিক্ষা খাতেও ডিএসআইয়ের ব্যর্থতা ও দুর্নীতির ছাপ স্পষ্ট। ২০১৮ সালে নেয়া হয় ইন্টিগ্রেটেড এডুকেশন ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেম (আইইআইএমএস) প্রকল্প। ৬ষ্ঠ থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের ডিজিটাল প্রোফাইল তৈরি এবং তথ্য সংরক্ষণের লক্ষ্য নিয়ে প্রকল্পটির মেয়াদ ছিল জুলাই ২০১৮ থেকে জুন ২০২২ পর্যন্ত, বাজেট প্রায় ২৩ কোটি টাকা। কিন্তু জাতীয় পর্যায়ে এখনও রোলআউট হয়নি, লাইভ পাবলিক পোর্টাল চালু হয়নি। কিছু শিক্ষা বোর্ড ও জেলা পর্যায়ে সীমিত ইউআইডি তৈরির কাজ মাত্র আংশিকভাবে সম্পন্ন হয়েছে। সরকারি তদন্তে দেখা গেছে, ব্যবহৃত সফটওয়্যার দুর্বল, অবকাঠামো অপর্যাপ্ত এবং তথ্য সংরক্ষণে অদক্ষ। এছাড়া সফটওয়্যার ও হার্ডওয়্যার কেনাকাটায় মূল্যফাঁকি, অপ্রয়োজনীয় ক্রয় এবং একাধিক পেমেন্টের অভিযোগ উঠেছে।

ডিএসআইয়ের বিতর্কিত ভূমিকা বিসিআইসি প্রকল্পেও দেখা যায়। সাবেক শিল্পমন্ত্রী নুরুল মজিদ হুমায়ূন ও কিছু অসৎ কর্মকর্তার সঙ্গে যোগসাজশে তারা বিসিআইসির ইন্টিগ্রেটেড বিজনেস প্রসেস অটোমেশন প্লাটফর্ম প্রকল্পটি হাতিয়ে নেয়। দীপন গ্রুপের সঙ্গে যোগসাজশ করে ডিএসআই সরাসরি লেনদেনের সুবিধা পায়। অভিযোগ রয়েছে, সাবেক মন্ত্রীর ঠিকাদারি পছন্দ ও ক্রয়ের ক্ষেত্রে মিলেমিশে সিদ্ধান্ত নেওয়া হতো, যা ডিএসআইকে অপ্রত্যাশিত সুবিধা দেয়।

প্রাথমিক শিক্ষা প্রকল্পেও ডিএসআইয়ের প্রভাব স্পষ্ট। আইপিইএমআইএস (ইন্টিগ্রেটেড প্রাইমারি এডুকেশন এমআইএস) প্রকল্পে অপ্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি কেনা এবং বিতর্কিত ভূমিকার অভিযোগ রয়েছে। ইউনিসেফ ও এডিবি অর্থায়িত প্রকল্পটি এখনও পুরোপুরি চালু হয়নি। এটুআইয়ের আওতায় পরিচালিত আইএসডিপি (ইন্টিগ্রেটেড সার্ভিস ডেলিভারি প্লাটফর্ম) প্রকল্পেও ডিএসআইয়ের কার্যক্রম ব্যর্থতা ও দুর্নীতির অভিযোগের মুখে পড়েছে।

ডিএসআইয়ের কর্মকর্তারা সরকারের কাজে অংশ পেতে ঘুষ এবং যোগসাজশের মাধ্যমে সুবিধা নিয়েছে। তাদের পরিচয়ও সরকারি দপ্তরে মূলত এইভাবে। সম্প্রতি সারের ডিজিটাল ব্যবস্থাপনা ও মজুদ থেকে ডিলার পর্যায়ের তথ্য অনলাইনে আনার জন্য ‘অনলাইন বেইজড ফার্টিলাইজার ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম’ প্রকল্পেও যোগসাজশের অভিযোগ উঠেছে।

প্রশ্ন জাগে—বারবার দুর্নীতি ও ব্যর্থতার অভিযোগের পরও কীভাবে ডিএসআই কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে? কেন সরকারি তদন্ত রিপোর্ট গোপন রাখা হয়? কেন প্রতিষ্ঠানটি ব্ল্যাকলিস্ট করা হয় না? বিশ্লেষকদের মতে, জনগণের করের টাকায় পরিচালিত প্রকল্পগুলোর এই ব্যর্থতা ও দুর্নীতি দেশে প্রযুক্তিগত উন্নয়ন ও জনসেবা থেকে বিরত রাখছে। তাই ডিএসআই সম্পর্কিত সব প্রকল্পের স্বাধীন তদন্ত, পূর্ণাঙ্গ অডিট রিপোর্ট প্রকাশ, দায়ীদের শাস্তি এবং কোম্পানিটিকে কালো তালিকাভুক্ত করার জোর দাবি উঠেছে।

Show More

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button