অপরিকল্পিত নগরায়ন, অনিয়ন্ত্রিত উন্নয়ন কার্যক্রম এবং দ্রুত জনসংখ্যা বৃদ্ধি—এই সব মিলিয়ে বাংলাদেশের কৃষিজমি প্রতি বছরই কমে যাচ্ছে। কৃষিনির্ভর দেশের খাদ্য নিরাপত্তা ভবিষ্যতে হুমকির মুখে পড়তে পারে—এমন শঙ্কা থেকে সরকার প্রণয়ন করেছে ‘ভূমি ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ ও কৃষি ভূমি সুরক্ষা অধ্যাদেশ, ২০২৫’।
এ অধ্যাদেশ অনুযায়ী অনুমোদন ব্যতীত কৃষিভূমি অকৃষিকাজে ব্যবহার ও কৃষিজমিতে বাণিজ্যিক আবাসন, রিসোর্ট, শিল্পপ্রতিষ্ঠান বা কারখানা নির্মাণ হবে অপরাধ। যার জন্য পেতে হবে শাস্তি।
অধ্যাদেশের প্রয়োজনীয়তার ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে—নগরায়ন, আবাসন ব্যবসা, শিল্পকারখানা, সড়ক নির্মাণসহ নানাবিধ উন্নয়ন কাজের কারণে ভূমির প্রকৃতি ক্রমাগত পরিবর্তন হচ্ছে এবং কৃষিজমি কমছে। খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতে, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য উর্বর ভূমি রক্ষায় এবং ভূমিরূপ অনুযায়ী জোনভিত্তিক পরিকল্পনা প্রণয়নে এই অধ্যাদেশ প্রয়োজনীয় হয়ে উঠেছে। রাঙ্গামাটি, বান্দরবান এবং খাগড়াছড়ি ছাড়া পুরো দেশে এই আইন কার্যকর হবে।
অধ্যাদেশ অনুযায়ী সরকার আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে দেশের প্রতিটি এলাকার ভূমির বৈশিষ্ট্য, ভূমিরূপ ও বিদ্যমান ব্যবহার বিশ্লেষণ করে ‘ভূমি ব্যবহার জোনিং ম্যাপ’ তৈরি করবে। জোনিং ম্যাপের ডাটাবেজ সংরক্ষণ ও নিয়মিত হালনাগাদ করা হবে। সরকার একযোগে বা ধাপে ধাপে অথবা বিশেষ কোনো অঞ্চলের প্রয়োজনকে অগ্রাধিকার দিয়ে ম্যাপ প্রণয়ন করতে পারবে এবং স্থানিক পরিকল্পনার সাথে সঙ্গতি নিশ্চিত করবে।
এই অধ্যাদেশের মাধ্যমে ভূমিকে ১৮ শ্রেণিতে ভাগ করা হবে। এর মধ্যে রয়েছে কৃষি অঞ্চল, বিশেষ কৃষি অঞ্চল, কৃষি-মৎস্য চাষ অঞ্চল, নদী-খাল, জলাশয়, পরিবহণ অঞ্চল, শহুরে আবাসিক এলাকা, গ্রামীণ বসতি, বাণিজ্যিক অঞ্চল, শিল্প এলাকা, বন, পরিবেশগতভাবে সংকটাপন্ন এলাকা, পাহাড়-টিলা, পতিতসহ অন্যান্য অঞ্চল। প্রয়োজন হলে সরকার নতুন জোন তৈরি, জোন একীভূত, পৃথক বা বাতিল করতে পারবে।
অধ্যাদেশের ৭ নম্বর ধারা অনুযায়ী নিচের সকল শ্রেণির জমি কৃষিজমি হিসেবে গণ্য হবে—নাল, বিলান, ধানি জমি, বোরো, চর ভূমি, বীজতলা, বাগান, পান বরজ, ঘাসবন, পতিত, হোগলবন, নলবন, বাইদ, চালা, মাঠ, বেগুন টিলা, মরিচ টিলা, ভিটি, ডাঙ্গা, ছোণখোলা, পশুচারণভূমি, পুকুরপাড়, বাগার, বাঁশঝাড় ও সমজাতীয় জমি। সরকার প্রয়োজনমতো আরও শ্রেণি যুক্ত করতে পারবে। কৃষিজমি রক্ষায় সরকার দ্রুত ভূমি ম্যাপিং শুরু করবে ও জেলা প্রশাসকদের কাছ থেকে কৃষিজমির তালিকা সংগ্রহ করবে।
দুই, তিন বা চার ফসলি জমির ক্ষেত্রে মৎস্যচাষকে কৃষির অন্তর্ভুক্ত ধরা হবে। খাদ্য নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক গুরুত্ব বিবেচনায় সরকার বিশেষ কৃষি অঞ্চল ঘোষণা করতে পারবে। এসব অঞ্চলের জমি কোনোভাবেই অকৃষি কাজে ব্যবহার করা যাবে না। বিশেষ কৃষি অঞ্চলের বাইরে বহু ফসলি জমি সাধারণত অন্য কাজে ব্যবহারের অনুমতি দেওয়া হবে না, তবে জাতীয় প্রয়োজন—যেমন জ্বালানি বা খনিজ সম্পদ আহরণ—বিবেচনায় অল্প পরিমাণ জমিতে অনুমোদন দেওয়া যেতে পারে। তবে মোট জমির ১০ ভাগের বেশি কোনোভাবেই ব্যবহার করা যাবে না এবং প্রথমে আগেই অধিগৃহীত অব্যবহৃত জমি ব্যবহারের বাধ্যবাধকতা থাকবে।
ইটভাটায় কৃষিজমির উপরিভাগ বা পাহাড়-টিলার মাটি ব্যবহার সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। উন্নয়ন প্রকল্পের নামে জলাধার বা জলাভূমি ভরাট করা যাবে না; পাহাড় কাটা বা বনভূমি ক্ষতিসাধনও নিষিদ্ধ। কোনো স্থাপনা নির্মাণ করলে তা অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে এবং অপরাধীকে নির্মিত স্থাপনা অপসারণ করতে বাধ্য করা হবে। সাগর ও উপকূলীয় অঞ্চলের জমি রক্ষায় পৃথক বিধিমালা প্রণয়ন করা হবে। কৃষিজমি ছাড়া অন্যান্য শ্রেণিভুক্ত জমিও এই আইন অনুযায়ী সুরক্ষা পাবে—এবং অনুমতি ছাড়া ব্যবহারভিত্তিক শ্রেণি পরিবর্তন করা যাবে না।
জেলা প্রশাসকের দায়িত্বও স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। অধ্যাদেশের উদ্দেশ্য পূরণে জেলা প্রশাসক কৃষিজমির তালিকা প্রস্তুত ও সুরক্ষা, জলাধার, জলাভূমি, পাহাড়-টিলা ও বনভূমির তালিকা ও সীমানা নির্ধারণ, গোচারণভূমি সংরক্ষণ, ইটভাটার লাইসেন্স দেওয়ার সময় মাটির উৎস যাচাই এবং বাহিরের মাটি ব্যবহার নিয়ন্ত্রণসহ অন্যান্য আদেশ বাস্তবায়ন করবেন।
নিজস্ব কৃষিভূমিতে বসতবাড়ি, কুটির শিল্প, পারিবারিক পুকুর, উপাসনালয় বা কবরস্থান নির্মাণের ক্ষেত্রে স্থানীয় প্রশাসনের অনুমতি নিতে হবে। অনুমতি ছাড়া নির্মাণ করলে ক্ষমতাপ্রাপ্ত কর্মকর্তা স্থাপনা অপসারণের আদেশ দেবেন। জনস্বার্থে এবং শর্ত লঙ্ঘন হলে অনুমোদন বাতিল হবে।
জোনিং শ্রেণি পরিবর্তন বা অন্য ব্যবহার করতে চাইলে ১১ ধারা অনুযায়ী ক্ষমতাপ্রাপ্ত কর্মকর্তার অনুমোদন বাধ্যতামূলক। জনস্বার্থ, পরিবেশ ও প্রকৃতির ওপর প্রভাব বিবেচনায় অনুমোদন দেওয়া হবে। এ ক্ষমতা বিভাগীয় কমিশনার, জেলা প্রশাসক, ইউএনও ও এসি ল্যান্ডদের নিকট অর্পণ করা হবে।
অধ্যাদেশের ১৪ নম্বর ধারায় অপরাধ ও দণ্ডের বিস্তারিত বলা হয়েছে—
• অনুমোদন ছাড়া জোনিং শ্রেণি পরিবর্তন: সর্বোচ্চ ৬ মাস কারাদণ্ড বা ১ লাখ টাকা জরিমানা
• কৃষিজমি অকৃষিকাজে ব্যবহার: সর্বোচ্চ ১ বছর কারাদণ্ড বা ২ লাখ টাকা জরিমানা
• কৃষিজমিতে আবাসন/রিসোর্ট/কারখানা নির্মাণ: সর্বোচ্চ ২ বছর কারাদণ্ড বা ৪ লাখ টাকা জরিমানা
• ইটভাটায় কৃষিজমির উপরিভাগ বা পাহাড়-টিলার মাটি ব্যবহার: সর্বোচ্চ ২ বছর কারাদণ্ড বা ৪ লাখ টাকা জরিমানা
• বিশেষ কৃষি অঞ্চলের ক্ষতি: সর্বোচ্চ ৩ বছর কারাদণ্ড বা ১০ লাখ টাকা জরিমানা এবং অতিরিক্ত ক্ষতিপূরণ
• জলাধার/পাহাড়/বন ক্ষতি: প্রচলিত আইনের শাস্তি + পুনঃস্থাপনের নির্দেশ
• কোনো বিধি লঙ্ঘন: সর্বোচ্চ ৬ মাস কারাদণ্ড বা ১ লাখ টাকা জরিমানা
এ ছাড়া অপরাধে ব্যবহৃত যন্ত্রপাতি ও সরঞ্জাম জব্দ করা হবে।



