নোয়াখালীতে সাউথ বাংলা হসপিটালের অব্যবস্হাপনা, চিকিৎসকের চরম অবহেলা ও ভুল চিকিৎসায় মা ও সন্তানের মৃত্যুর ঘটনায় ৪ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেছেন নোয়াখালীর সিভিল সার্জন ডা: মাসুম ইফতেখার।
কবিরহাট উপজেলা স্বাস্হ্য কমপ্লেক্সের ডা:খালেদা আক্তার খানম কে সভাপতি কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা স্বাস্হ্য কমপ্লেক্সের ডা: রওশন জাহান লাকী, সিভিল সার্জন অফিসে কর্মরত রেখা রানী মজুমদারকে সদস্য ও বেগমগঞ্জ উপজেলা স্বাস্হ্য কমপ্লেক্সের মেডিকেল অফিসার ডা:আবদুল কাদের চৌধুরীকে সদস্য সচিব করে এ কমিটি করা হয়। তদন্ত কমিটি আগামী ৭ কার্য দিবসের মধ্যে সুষ্ঠ তদন্ত করে বিস্তারিত প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দেন সিভিল সার্জন ডা: মাসুম ইফতেখার।
গত ২৩ অক্টোবর নিহত উম্মে সালমা নিশির পিতা বিশিষ্ট সাংবাদিক কাদরা হামেদিয়া দাখিল মাদ্রাসা ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি এম এ আউয়াল তার একমাত্র মেয়ে ও নাতিকে সেনবাগ এবং নোয়াখালীর সাউথ বাংলা হসপিটালের অব্যবস্হাপনায় সিজারের সময় ডা: ফৌজিয়া ফরিদ, ডা:আক্তার হোসেন অভি ও মেডিকেল অফিসার ডা: জাহিদের ভুল চিকিৎসা, অবহেলা ও হটপিটালের বিরুদ্ধে মা ও সন্তানেের মৃত্যুর বিষয়ে লিখিত অভিযোগ দেন।
উল্লেখ্য, গত ১৬ অক্টোবর সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায় সেনবাগ পৌরসভার কাদরা এলাকার সমাজ সেবক ও সাংবাদিক এম এ আউয়ালের এক মাত্র কন্যা নয় মাসের অন্ত:সত্তা উম্মে সালমা নিশিকে (২৭) তার মাতা নুর মহল মুন্নী সেনবাগ সরকারী হাসপাতালে অক্সিজেনসেবা দিতে নিয়ে আসেন। ওই সময় হাসপাতালের ২য় তলায় কর্তব্যরত নার্স শিউলী আক্তার অক্সিজেন সেবা দিতে ব্যর্থ হন। এরপর তারা সেনবাগের বেসরকারী সেন্ট্রাল হাসপাতালে নিয়ে গেলে সেখানে নিশিকে আল্ট্রাসনোগ্রাম করেন ডা: সাওদা তাসনিম। রিপোর্টে তার গর্ভের সন্তানের হার্টবিট ২৪১ পেয়ে দ্রুত নোয়াখালীতে রেফার করেন তিনি। সম্পূর্ণ সুস্হ ও সবল নিশিকে তার পরিবার রাত সোয়া ১১ টায় নোয়াখালীর সাউথ বাংলা হসপিটালে নিয়ে যান। এসময় কর্তব্যরত ডা: জাহিদকে শিশুর হার্টবিটের আল্ট্রা রিপোর্ট দেখালে তিনি পালস মেপে ১৬০ – ৯০ ও ডায়াবেটিস পান ৬.১। পুনরায় আল্ট্রাসনোগ্রামসহ অন্যান্য পরীক্ষার কথা বলে ডা: জাহিদের নেতৃত্বে ডা: ফৌজিয়া ফরিদ, ডা: আক্তার হোসেন অভিসহ সংশ্লিষ্ট ইউনিট নিশিকে ওটিতে নিয়ে যান।
কোনো রকম পরীক্ষা নিরীক্ষা না করে এবং নিশির পিতা মাতার অনুমতি না নিয়েই তারা সিজার করে তিন কেজি সাত শত গ্রামের পুত্র সন্তানকে একটি কার্টুনে বের করে আনেন এবং বলেন শিশুটি দু’দিন আগে মারা যায়। প্রশ্ন থেকে যায় এক ঘন্টা আগে করা রিপোর্টে সন্তানের হার্টবিট ২৪১ পাওয়া যায়। তাহলে সাউথ বাংলা হসপিটাল আরেকটা আল্ট্রা করলে বুঝা যেতো সন্তান বেঁচে আছে নাকি মৃত্যু হয়েছে। শিশু জীবিত না থাকলে মায়ের সিজার লাগতোনা। জড়িতদের ভুলের কারনেই প্রসূতির মৃত্যু হয়েছে মর্মে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা জানান। রাত সোয়া একটায় চিকিৎসকরা প্রসূতির অবস্হা সংকটাপন্ন জানিয়ে আইসিইউ সাপোর্টের জন্য কুমিল্লাতে পাঠান।
কাপড়ে ঢাকা নিথর নিশির প্রান বাঁচাতে এ্যাম্বুলেন্স যোগে কুমিল্লা টাওয়ারস্হ মেডিকেল সেন্টারে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসকরা ইসিজি করে তার মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত করেন। তারা বলেন, মৃত লাশ নিয়ে এসেছেন, দেড় ঘন্টা আগেই তার মৃত্যু হয়েছে। সন্তান যদি গর্ভে মারা যায় তাহলে প্রসূতি মায়ের সিজারের প্রয়োজন ছিলোনা। চিকিৎসক ও হাসপাতালের ভূল চিকিৎসায় পিতা মাতার আদরের একমাত্র মেয়ের মৃত্যুতে পুরো জেলায় তোলপাড়ের সৃষ্টি হয়।
ভোর সোয়া ৪টায় কুমিল্লা থেকে লাশবাহী গাড়ী নিয়ে বাড়ীতে ফিরলে এ্যাম্বুলেন্সের সাইরেনের শব্দে ঘুম ভাঙ্গে শহরবাসির।তাদের একমাত্র মেয়ে ও নাতির মৃত্যুর সংবাদ শুনে কাক ডাকা ভোরে হাজার হাজার নারী পুরুষ ভীড় করেন তার বাড়ীতে। ৩কেজি ৮শত গ্রাম ওজনের নবজাতকের নাম রাখা হয় নিজাম উদ্দিন নিহাল। সকাল ৯ টায় পারিবারিক কবরস্থানে তাকে সমাহিত করেন এলাকাবাসী। বেলা সাড়ে ১১ টায় কাদরা হামেদিয়া দাখিল মাদ্রাসা মাঠে উম্মে সালমা নিশির জানাজা শেষে শিশু নিহালের পাশেই তাকে দাফন করা হয়।
জানা যায় ইউএনও জিসান বিন মাজেদ, মেয়র আবু নাছের দুলাল, এসিল্যান্ড মো: জাহিদুল ইসলাম, ওসি নাজিমউদ্দিন, জনপ্রতিনিধি, সাংবা দিক, শিক্ষক, রাজনীতিক নেতৃবৃন্দ, ব্যবসায়ী, স্বজনসহ কয়েকহাজার মুসল্লী অংশ গ্রহন করেন।
এদিকে, মৃত্যুর বিষয়ে নিহতের মাতা নুর মহল মুন্নী মোহনা টেলিভিশনকে জানান, তার মেয়ে সম্পূর্ণ সুস্হ ও স্বাভাবিক ছিলো। ওইদিন সন্ধ্যায় তার গর্ভের সন্তানের হার্টবিট না থাকায় সে নিজেই হেঁটে সেনবাগ সরকারী হাসপাতালে অক্সিজেন সেবা নিতে যান। নোয়াখালী জেনারেল হাসপাতালের সহকারী রেজিস্ট্রার গাইনী বিভাগের ডা: শাহানা আক্তার লিপির অধীন চিকিৎসাধীন ছিলেন নিশি। ১৩ অক্টোবর বিকেলে ও তাকে দেখে হরমনসহ ৩ টি টেষ্ট দেন। ২৪ অক্টোবর নিশির ডেলিভারির তারিখ ও নির্ধারন করেন ডা: লিপি। ১৪ অক্টোবর ডা: লিপিকে রিপোর্ট গুলো দেয়ার পর আর কোন পদক্ষেপ নেননি তিনি। ঘটনার দিন সন্ধ্যায় ডা: লিপিকে রোগীর বিষয়ে ২০ বারের অধিক ফোন দিলে ও তিনি রিসিভ করেননি। এর আগে সেনবাগ সরকারী হাসপাতালের স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা: মুহিবুস সালাম খাঁন সবুজের সহায়তা চেয়েও ব্যর্থ হন তারা।
সাউথ বাংলা হসপিটাল কর্তৃপক্ষ ও সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকদের অবহেলা এবং ভুল চিকিৎসায় এ হাসপাতালেই তাদের মৃত্যু ঘটে। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ও অভিযুক্ত চিকিৎসকরা মৃত্যুর বিষয়টি ধামাচাপা দিতে আইসিইউর নামে প্রতারনা করেন।
চট্রগ্রাম সরকারী কলেজের মেধাবী ছাত্রী নিশি ২০২২ সালে ফাস্টক্লাস পেয়ে এমবিএ ডিগ্রী অর্জন করেন। একই সনে কবিরহাট উপজেলার মিয়া বাড়ীর প্রিমিয়ার ইউনিভার্সিটি থেকে এমবিএ করা ব্যবসায়ী কুতুব উদ্দিন বখতিয়ারের সাথে পারিবারিক ভাবে বিয়ে হয়।
নোয়াখালীর সিভিল সার্জন ডা: মাসুম ইফতেখার মোহনা টেলিভিশনকে জানান, সুষ্ঠ তদন্তের জন্য ৪ সদস্যের কমিটি গঠন হয়েছে। তদন্ত শেষে দোষীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেব।
সাংবাদিক এম এ আউয়ালের মেয়ে ও নাতির মৃত্যুতে পরিবার স্বজনসহ এলাকায় চলছে শোকের মাতম।
হাসপাতাল ও চিকিৎসকদের ভূল চিকিৎসা এবং চরম অবহেলায় মা সন্তানের মৃত্যুর ঘটনায় জড়িতদের শাস্তির দাবী জানিয়েছেন এলাকাবাসী।