দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সুযোগ কাজে লাগিয়ে অনেকেরই নৌকা ডুবিয়েছে স্বতন্ত্ররা। তারা নৌকা প্রতীকের প্রার্থীদের বিরুদ্ধে লড়াই করে জয়ী হয়েছেন। এসব প্রার্থীদের অনেকে আওয়ামী লীগের মনোনীতদের বিরুদ্ধে সরব আলোচনা তৈরি করেন। ফল ঘোষণার পর নৌকা ডুবিয়ে তাদের জয় চমক হিসেবে এসেছে।
বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়া ঠেকাতে আওয়ামী লীগে এই কৌশলের কারণে রেকর্ড সংখ্যক স্বতন্ত্র প্রার্থীর মনোনয়নপত্র জমা পড়ে রিটার্নিং কর্মকর্তাদের দপ্তরে। এবারের ভোটে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় যাতে কেউ নির্বাচিত হতে না পারেন, সেজন্য দলের নেতাদেরও স্বতন্ত্র হওয়ার সুযোগ দেয় ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ।
মাঠে ছিলো ৪৩৬ জন স্বতন্ত্র প্রার্থী। যাদের বেশিরভাগই আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতা। এসব প্রার্থীদের অনেকে আওয়ামী লীগের মনোনীতদের বিরুদ্ধে সরব আলোচনা তৈরি করেন। লড়াইটাও হয়েছে অনেক জায়গায় হাড্ডাহাড্ডি। ফলস্বরূপ ডুবেছে অনেকের নৌকা।
নৌকা নিয়ে হেরে যাওয়ার তালিকায় আছে- আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির প্রচার সম্পাদক আবদুস সোবহান গোলাপ, টানা তিনবারের সংসদ সদস্য ধীরেন্দ্র দেবনাথ শম্ভু, সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য কাজী জাফর উল্যাহ, কেন্দ্রীয় কমিটির সাংস্কৃতিক সম্পাদক অসীম কুমার উকিল। এছাড়াও নৌকা নিয়ে হেরেছেন তিন প্রতিমন্ত্রী। দুই বারের সংসদ সদস্য বিমান ও পর্যটন প্রতিমন্ত্রী মাহবুব আলী, ত্রাণ ও দুর্যোগ প্রতিমন্ত্রী দুই বারের সংসদ সদস্য এনামুর রহমান এবং স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় প্রতিমন্ত্রী তিনবারের সংসদ সদস্য স্বপন ভট্টাচার্য্য।
স্বতন্ত্রের কাছে যাদের নৌকা ডুবেছে:
বরগুনা-১ আসনে আসনে হেরেছেন টানা তিনবারের সংসদ সদস্য আওয়ামী লীগের ধীরেন্দ্র দেবনাথ শম্ভু। এ আসনে জয় পেয়েছেন ঈগল প্রতীকের স্বতন্ত্র প্রার্থী আওয়ামী লীগ নেতা গোলাম সরোয়ার টুকু।
নেত্রকোণা-৩ (কেন্দুয়া-আটপাড়া) আসনে নৌকার অসীম কুমার উকিল হেরে গেছেন। এ আসনে জয় পেয়েছেন ট্রাক প্রতীকের স্বতন্ত্র প্রার্থী সাবেক সংসদ সদস্য ও আওয়ামী লীগ নেতা ইফতিকার উদ্দিন তালুকদার পিন্টু ।
মুন্সীগঞ্জ-৩ আসনে হেরেছেন নৌকার মৃণাল কান্তি দাশ। জয়ী হয়েছেন তার প্রতিদ্বন্দ্বী স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা স্বতন্ত্র প্রার্থী মোহাম্মদ ফয়সাল। তার প্রতীক ছিলো কাঁচি।
নরসিংদী-৩ আসনে নৌকার ফজলে রাব্বি খান হেরেছেন। তাকে হারিয়েছেন আওয়ামী লীগের আরেক নেতা সিরাজুল ইসলাম মোল্লা।
যশোর-৬ আসনে নৌকা নিয়ে হেরেছেন শাহীন চাকলাদার। জয়ী হয়েছেন ঈগল প্রতীকের আজিজুল ইসলাম।
চট্টগ্রাম-১৬ আসনে শেষ বেলায় আচরণিবিধি লঙ্ঘনের দায়ে প্রার্থিতা হারান নৌকার মোস্তাফিজুর রহমান চৌধুরী। এ আসনে জেলা আওয়ামী নেতা মুজিবুর রহমান ঈগল প্রতীকে জয়ী হয়েছেন।
ফরিদপুর-৩ সদর আসনে জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি নৌকা প্রতীকের প্রার্থী শামীম হক ৭৫ হাজার ৮৯ ভোট পেয়ে হেরে যান। এই আসনে জয়ী হয়েছেন ঈগল প্রতীকের স্বতন্ত্র প্রার্থী এ কে আজাদ। তিনি ঈগল প্রতীকে পেয়েছেন এক লাখ ৩৪ হাজার ৯৮ ভোট।
ফরিদপুর-৪ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী কাজী জাফর উল্যাহ আবারও হেরে গেছেন। এ আসনে আওয়ামী লীগের আরেক নেতা মুজিবুর রহমান চৌধুরী নিক্সন ঈগল প্রতীকে জয় পেয়ে হ্যাট্রিক করেছেন।
হবিগঞ্জ ৪ আসনে নৌকার প্রার্থী বেসামরিক বিমান ও পর্যটন প্রতিমন্ত্রী মাহবুব আলী হেরে গেছেন। তিনি পেয়েছেন ৬৯ হাজার ৫৪৩ ভোট। তার প্রতিদ্বন্দ্বী সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ভাইরাল মুখ স্বতন্ত্র প্রার্থী ব্যারিস্টার সৈয়দ সায়েদুল হক সুমন জয়ী হয়েছেন। যুবলীগের সাবেক এই নেতা এক লাখ ৬৯ হাজার ৯৯ ভোট।
মাদারীপুর ৩ আসনে আওয়ামী লীগের আবদুস সোবহান গোলাপ হেরে গেছেন। তার প্রতিদ্বন্দ্বী আরেক আওয়ামী লীগ নেতা সংরক্ষিত আসনের সংসদ সদস্য তাহমিনা বেগম স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে জয়ী হয়েছেন।
ঢাকা-১৯ আসনে নৌকার প্রার্থী ত্রাণ ও দুর্যোগ প্রতিমন্ত্রী এনামুর রহমান হয়েছেন তৃতীয়। তাকে হারিয়েছেন ট্রাক প্রতীকের স্বতন্ত্র প্রার্থী সাইফুল ইসলাম। সাইফুল আশুলিয়া থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্বে আছেন। সাইফুল পেয়েছেন ৮৪ হাজার ৪১২ ভোট। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী সাবেক সংসদ সদস্য ঈগল প্রতীকের তৌহিদ জং মুরাদ পেয়েছেন ৭৬ হাজার ২০২ ভোট। আর নৌকা প্রতীকের এনামুর পেয়েছেন ৫৬ হাজার ৩৬১ ভোট।
রাজশাহী-২ আসনে নৌকা প্রতীকের ১৪ দলের প্রার্থী ফজলে হোসেন বাদশা স্বতন্ত্র প্রার্থীর কাছে হেরে গেছেন। জিতেছেন তার প্রতিদ্বন্দ্বী নগর আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি স্বতন্ত্র প্রার্থী শফিকুর রহমান বাদশা। ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক ফজলে হোসেন বাদশা এর আগের টানা তিনবারের সংসদ সদস্য।
কুষ্টিয়া-২ জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনু নৌকা প্রতীক নিয়ে হেরেছেন। ইনু পেয়েছেন ৯২ হাজার ৪৪৫ ভোট। ওই আসনে ট্রাক প্রতীকের স্বতন্ত্র প্রার্থী আওয়ামী লীগ নেতা কামারুল আরেফিন এক লাখ ১৫ হাজার ৭৯৯ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হয়েছেন।
যশোর-৫ আসনে তিনবারের সংসদ সদস্য এবং পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় প্রতিমন্ত্রী স্বপন ভট্টাচার্য্য হেরে গেছেন। নৌকা প্রতীকে তিনি পেয়েছেন ৭২ হাজার ৩৩২ ভোট।
ঈগল প্রতীকের স্বতন্ত্র প্রার্থী আওয়ামী লীগ নেতা ইয়াকুব আলী ৭৭ হাজার ৪৬৮ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হয়েছেন।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া-১ (নাসিরনগর) আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী ও বর্তমান সংসদ সদস্য বদরুদ্দোজা মো. ফরহাদ হোসেন সংগ্রামকে হারিয়ে জয়ী হয়েছেন স্বতন্ত্র প্রার্থী সৈয়দ এ. কে. একরামুজ্জামান।
মানিকগঞ্জ-২ আসনে নিজ দলের স্বতন্ত্র প্রার্থীর কাছে হেরে গেছেন তিনবারের সংসদ সদস্য কণ্ঠশিল্পী মমতাজ বেগম। এ আসনে ট্রাক প্রতীক নিয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছিলেন জেলা আওয়ামী লীগের কোষাধ্যক্ষ দেওয়ান জাহিদ আহমেদ টুলু।
ময়মনসিংহ-১ (হালুয়াঘাট-ধোবাউড়া) আসনে জুয়েল আরেং নৌকা প্রতীক নিয়ে লড়ে হেরে গেছেন। তাকে হারিয়েছেন স্বতন্ত্র প্রার্থী স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা মাহমুদুল হক সায়েম।