বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরের কবি সুফিয়া কামাল মিলনায়তনে ১৯৭১ : গণহত্যা-নির্যাতন আর্কাইভ ও জাদুঘর, বাংলাদেশ ইতিহাস সম্মেলনী, বাংলাদেশ চর্চা ও অনন্যা এর যৌথ আয়োজনে প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বঙ্গবন্ধু অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন রচিত ও সম্পাদিত দুটি গ্রন্থের প্রকাশনা উৎসব অনুষ্ঠিত হয়েছে।প্রকাশিত প্রথম বইটির নাম বঙ্গবন্ধুর জীবন। দ্বিতীয়টি মুক্তিযুদ্ধের দলিলপত্র বিষয়ক সবচেয়ে বড় সংকলন মিডিয়া অ্যান্ড দি লিবারেশন ওয়ার গ্রন্থমালার ৩০তম গ্রন্থ। বই দুটি প্রকাশ করেছে প্রকাশনা সংস্থা অনন্যা।
অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির আসন অলঙ্কৃত করেন বাংলাদেশের মাননীয় প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসান। আলোচক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন লেখক-সাংবাদিক শাহরিয়ার কবির, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশিষ্ট অধ্যাপক ও ইতিহাসবিদ ড. মো. মাহবুবর রহমান এবং গণহত্যা জাদুঘরের ট্রাস্টি সম্পাদক ড. চৌধুরী শহীদ কাদের। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন প্রবন্ধকার ও সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের প্রাক্তন বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসান বলেন,‘‘বঙ্গবন্ধুর আত্মজীবনী ও তাকে নিয়ে সরকারি প্রতিবেদন – এই দুটো বাজারে আসার পর বাংলাদেশ অপেক্ষা ছিল বঙ্গবন্ধুর জীবনী নতুন করে লেখার ও দেখার। বাংলাদেশের প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ মুনতাসীর মামুনই বরাবরের মতো তার কাঁধে সেই গুরুদায়িত্ব নিয়ে একেবারে নতুন আঙ্গিকে বঙ্গবন্ধুকে আমাদের সামনে তুলে ধরেছেন।’’
তিনি বলেন, “বঙ্গবন্ধুর অন্যান্য জীবনীগ্রন্থের সাথে মুনতাসীর মামুন রচিত জীবনীগ্রন্থের কয়েকটি বড় অমিল আছে। পুনরাবৃত্তির দুষ্টচক্র এড়িয়ে মুনতাসীর মামুন একেবার তরতাজা তথ্য প্রদান করেছেন। কিন্তু তার গ্রন্থের শক্তির জায়গা অন্যত্র। আগের যারাই লিখেছেন তারা বঙ্গবন্ধুকে বৃহত্তর রাজনৈতিক ইতিহাসের প্রেক্ষাপটে তুলে ধরেছেন। এটা জরুরি কাজ বটে, মুনতাসীর মামুন সেই কাজ নতুন প্রজন্মের হাতে ছেড়ে দিয়েছেন। তিনি বরঞ্চ প্রশ্ন তুলেছেন উলটো জায়গা থেকে। তৎকালে শেখ মুজিবের মতো আরও অনেক নেতা থাকলেও, কেন আর কেউ ‘বঙ্গবন্ধু’ হতে পারলেন না? কেন শেখ মুজিবই ‘বঙ্গবন্ধু’ হয়ে উঠলেন?”
তিনি বলেন, “ছয়টি পর্বে বঙ্গবন্ধুর জীবন কালানুক্রমে আলোচনা করে মুনতাসীর মামুন আসলে শেখ মুজিব থেকে বঙ্গবন্ধু হয়ে ওঠার যাত্রার ছকটি আমাদের সামনে তুলে ধরেছেন। কিভাবে একজন শেখ মুজিব বঙ্গবন্ধু হয়ে উঠলেন, তার পুরো গল্পটা, পুরো রূপরেখা তুলে ধরা হয়েছে এই গ্রন্থে।”
ড. মো. মাহবুবর রহমান বলেন, ‘বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে এখনো সকল গ্রন্থ লেখা হচ্ছে তার খুব কম গ্রন্থই বঙ্গবন্ধুর আত্মজীবনী, গোয়েন্দা প্রতিবেদন ও সংবাদপত্রে বঙ্গবন্ধু প্রভৃতি উৎস থেকে তথ্যের সন্নিবেশ করা হয়েছে। তবে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে লেখালেখির এই জোয়ারের মধ্যে কিছু লেখক-গবেষক বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে মৌলিক এবং গবেষণাধর্মী গ্রন্থ রচনা করেছেন। তাদের মধ্যে অন্যতম হচ্ছেন মুনতাসীর মামুন। তিনি ইতিমধ্যে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে ২৫টির অধিক গ্রন্থ ও ৩০ এর অধিক প্রবন্ধ রচনা করেছেন’।
ড. চৌধুরী শহীদ কাদের মুনতাসীর মামুনের দুটো গ্রন্থ সম্পর্কে বলেন, “আমাদের ইতিহাসবিদ্যার ইতিহাসে খুব অল্প ব্যক্তি পাওয়া যায় যারা একই সাথে ইতিহাসের দলিল সংগ্রহ ও সংরক্ষণ এবং ইতিহাসচর্চা দুটো একই সাথে সমানতালে করেছেন। দুই বাংলা মিলিয়ে এই অল্প কয়েকজন ইতিহাসবিদের মধ্যে সর্বাধিক অগ্রগণ্য হচ্ছে মুনতাসীর মামুন”।
তিনি বলেন, “তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ভারত, অস্ট্রেলিয়া, ইন্দোনেশিয়াসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের পত্রিকাতে প্রকাশিত সংবাদগুলো সঙ্কলন করেছেন। তিনি যখন সঙ্কলন করেছেন তার ব্যক্তি অভিরুচির চেয়ে পদ্ধতির দিকে বেশি মনযোগ দিয়েছেন। ফলে, এমন অনেক সংবাদের সঙ্কলন হয়েছে যেগুলোর আপাত গুরুত্ব হয়তোবা একজনের পাঠকের কাছে নেই, কিন্তু ভবিষ্যতে যদি কোনো গবেষক মুক্তিযুদ্ধের সামূহিক পরিস্থিতি ধরতে চান, তাহলে সেটার প্রয়োজন আছে। এই সঙ্কলনকে পদ্ধতিগত বলছি এই কারণে যে, প্রতিটি সংবাদপত্রের সংবাদগুলোকে তিনি বিষয়ভিত্তিক ক্যাটাগরিতে বিভক্ত করেছেন।”
তিনি বলেন, “মুক্তিযুদ্ধের সাথে আমাদের কালিক দূরত্ব যত বাড়বে এই গ্রন্থের উপযোগিতা ততই বৃদ্ধি পাবে। নতুন প্রজন্মের কোনো গবেষক মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কাজ করতে চাইলে তাকে অবশ্যই এই সঙ্কলনকে নিতে হবে। গত পঞ্চাশ বছরে মুক্তিযুদ্ধের দলিল/পত্রিকা সংগ্রহের এতো বড়ো কর্মযজ্ঞের আর কোনো দ্বিতীয় নজির নেই।”
তিনি বলেন, “দীর্ঘ পাচ ছয় বছর অক্লান্ত ঘাটাঘাটির পর মুনতাসীর মামুন বঙ্গবন্ধুর এই নতুন জীবনীগ্রন্থ রচনা করেছেন। নতুন তথ্যের ওপর ভর করে তিনি বঙ্গবন্ধুর জীবনের যে রূপরেখা একেছেন তাতে আসলে ফুটে উঠেছে কীভাবে একজন শেখ মুজিব ‘বঙ্গবন্ধু’ হয়ে উঠলেন। একজন সাধারণ নেতার অসাধারণ হয়ে উঠার রূপরেখা রয়েছে এই গ্রন্থে। বঙ্গবন্ধুর জীবনের ইতিহাস লিখতে গিয়ে আসলে মুনতাসীর মামুন বাংলাদেশের ইতিহাসই রচনা করেছেন। দূর্দান্ত বিশ্লেষন ও নতুন তথ্যের দারুণ সংশ্লেষে তিনি বঙ্গবন্ধুর জীবন ও বাংলাদেশের অভ্যুদয়কে একই ছকে নিয়ে এসেছেন।”
মুনতাসীর মামুন বলেন, “ইতিহাসের উপাদান হিসেবে আত্মজীবনী ব্যবহৃত হয়। আত্মজীবনী লেখা হয় স্মৃতির ওপর নির্ভর করে এবং যে বয়সে সাধারণত সবাই আত্মজীবনী লেখেন সে বয়সে স্মৃতি বিশ্বাসঘাতকতা করবে না এমন কথা বলা যায় না। ঘটনার সঙ্গে স্মৃতিও বদলে যায়। আত্মজীবনীতে আমি প্রবল হয়ে ওঠে। তাছাড়া, আত্মজীবনী কার যেভাবে জীবন বা সমাজকে দেখেন, যিনি সামাজিক বা রাজনৈতিক ইতিহাস লিখেছেন তিনিও কি ঐভাবে জীবন বা সমাজে দেখেছেন? যদি তা-না হয়, তাহলে যত্রতত্র উদ্ধৃতির ব্যবহার বিভ্রমের সৃষ্টি করবে মাত্র।”
তিনি বলেন, “সিক্রেটস ডকুমেন্টস পড়ার পর আমার মনে হলো, বঙ্গবন্ধুর আত্মজীবনী ও গোয়েন্দা দফতরের রিপোর্ট পাশাপাশি রেখে তার জীবনীটি পুনর্গঠন করা যেতে পারে কিনা?”
তিনি বলেন, “বঙ্গবন্ধুর জীবনীর নতুন উপাদানগুলি পেয়ে আমার মনে হয় নতুন করে তাঁর একটি জীবনী লেখা যেতে পারে। বঙ্গবন্ধুর সময়কালের রাজনীতির বিরাট ক্যানভাসে আমি বঙ্গবন্ধুকে বিচার করিনি। এই বয়সে সেটি সম্ভব নয়। পরবর্তীকালে কোনো তরুণ গবেষক সেটি করবেন।শেখ মুজিব থেকে তিনি কীভাবে বঙ্গবন্ধু হয়ে উঠলেন সেটিই ছিল আমার বিবেচ্য। তাঁর সমসাময়িক অনেক জনপ্রিয় রাজনীতিবিদ ছিলেন কিন্তু কেনো তাঁরা বঙ্গবন্ধু বা জাতির পিতা হতে পারলেন না, সে বিষয়টি দেখাবার চেষ্টা করেছি।”
জনাব শাহরিয়ার কবির মুনতাসীর মামুনের দুটো গ্রন্থের উচ্চকিত প্রশংসা করে বলেন, “স্বাধীনতা বিরোধীরা বিভিন্ন সময়ে মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে নেতিবাচক প্রচারণা চালিয়ে থাকেন। এগুলোর মোক্কম জবাব দিতে হলে মুনতাসীর মামুনের এই গ্রন্থগুলোর প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম। একদিকে দলিল সঙ্কলন, অন্যদিকে দলিলের ভিত্তিতে ইতিহাসের পুনর্ঠন – মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিস্তারের জন্য এগুলো খুব প্রয়োজন।”
সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের প্রাক্তন বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক বলেন, “অসাম্প্রদায়িক সোনার বাংলা বির্নিমাণে বঙ্গবন্ধুর জীবন ও কর্ম সম্পর্কে আমাদের জানতে হবে। বঙ্গবন্ধুকে বাদ দিয়ে বাংলাদেশের ইতিহাস রচনা করা যায় না। অধ্যাপক মুনতাসীর মামুনের এ কাজটি অত্যন্ত মূল্যবান।”