ঢাকাসংবাদ সারাদেশ
গোপালগঞ্জে নির্বাহী প্রকৌশলী ও ঠিকাদারের অবহেলায় কৃষকের ব্যাপক ক্ষতি
মাসুদ পারভেজ, গোপালগঞ্জ
গোপালগঞ্জ সদর উপজেলার হরিদাশপুর ইউনিয়নের খাগাইল গ্রামে ধান নষ্ট করে খাল পুনঃ খনন করছে পানি উন্নয়ন বোর্ড। চাষের জন্য অতীব প্রয়োজনীয় খাগাইল খালটি খনন করে এর দুই পাশের বোরো ধানের জমিতে ফেলানো হচ্ছে মাটি। এতে ফলন্ত ধান নষ্ট হয়ে ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে শত কৃষক। পানি উন্নয়ন বোর্ডে লিখিতভাবে জানিয়েও কোন প্রতিকার পায়নি এ এলাকার কৃষকরা। একদিকে পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী বলছেন খালে পানি থাকায় সময়মতো কাজ শুরু করতে পারেনি। অন্যদিকে কাজ দেরীতে শুরু করে কৃষকদের ক্ষতির জন্য নির্বাহী প্রকৌশলীকে দায়ী করলেন স্থানীয় ইউনিয়ন চেয়ারম্যান।
২০২৩ সালের সেপ্টেম্বর মাসের ২৫ তারিখে জয় ট্রেডার্স নামে একটি ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানকে প্রায় দেড় কিলোমিটারের খাগাইল খালটি পুনঃ খননের কার্যাদেশ দেয় গোপালগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ড। অদৃশ্য কারণে খননের কাজ শুরু হয় ২০২৪ সালের মার্চের প্রথম সপ্তাহে। যে সময়টিতে খালের দুই পাড়ের বেশিরভাগ জমির ধানে শীষ বের হওয়া শুরু হয়। ধান নষ্ট হওয়ায় জমিতে মাটি ফেলতে নিষেধ করেন কৃষকরা। কিন্তু ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের লোকজন প্রভাব খাটিয়ে খাল খননের মাটি জোর করে ফেলেছে সেই ধানের উপরে । বিলের এক ফসলী বোরো ধানের এ জমিই কৃষকদের বেচে থাকার একমাত্র অবলম্বন। এ ঘটনার ফলে ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে এখানকার কৃষকরা। তাই ক্ষতি পূরণের দাবী ফসল হারানো দিশেহারা কৃষকদের।
ভুক্তভোগী কৃষক নিয়ামত খা বলেন, আমাদের এখানে এক ফসলী জমি। আমার ২ জায়গায় মোট ২ বিঘা জমিতে ধান হয়। আমরা গরিব মানুষ। এই ধান লাগিয়ে আমরা খাই। আমার ধানের ভিতর দিয়ে মাটি ফেলায় চলে গেছে। মানা করছি শোনে নায়। বলছে অল্প একটু ফেলাবানি। কিন্তু তা না করে প্রায় অর্ধেক জমির ধান নষ্ট করে ফেলেছে।
ভুক্তভোগী এক কৃষকের স্ত্রী স্বপ্না বেগম বলেন, দ্যাড় (দেড়) বিঘে জমি রুইছি আমরা। সে জমিতে ফুলা ধান, তার উপর মাটি ফেলাইছে। আমাগে আর কোন কামাই নাই। আমাগে মরন (মৃত্যু) ছাড়া আর কোন ফত (রাস্তা) নাই। ছয়ড়া ছেলে-মেয়ে এ্যাল্যা (একা) বেডা কামাই হরে তাই দিয়ে আমরা খাইয়ে, দিন যাইয়ে রাত ফোয়াইয়ে কোন রহম বাইচে থাহি। এইভাবে ধানের উপর মাটি ফেলানুর কোন যুক্তি আছে।
ভুক্তভোগী কৃষক শাহানুর মোল্লা বলেন, আমাগে একই ফসল, এর পরে আর কোন ফসল নাই। আমাগে যে কি ক্ষতি করে গেছে । আমাগে আগে বললো না কেন। কাতি (কার্তিক) মাসে যদি বলতো এই জমিগুলো লাগাইও না, তাহলে আমরা লাগাতামনা। তারপর আমাগে যে ফুলা (শীষ বের হওয়া শুরু) ধানডা তার উপরে মাটি ফেলাইছে। বলার পরেও শোনলো না। তাগে মোনমত কাজ চালায়ই (চালিয়ে) গেছে। আমরা কৃষক মানুষ আমরা কি খাইয়ে বাচপো।
ভুক্তভোগী কৃষক আবুল মৃধা বলেন, আমাকে জমির ফোলা ধানের উপর মাটি ফেলাইছে। কিছুদিন পরে আবার মাটি ফেলালি ধান আরো নষ্ট হবে। জমি জড়াইয়ে কাটছে। পরে এসমস্ত জমি ভাইঙ্গে খালের মধ্যি পড়বে। আমাগেতো কিছুই থাকবেনা। আমাগে যে ক্ষতি হইছে তাই আমাগে বুইঝে দিক।
হরিদাশপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মো: ইলিয়াস হোসেন ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, খাগাইল খালটি খনন করা এলাকার কৃষকদের জন্য খুবই জরুরী। এই খালের টেন্ডার হওয়ার পরে পানি উন্নয়ন বোর্ডের গোপালগঞ্জের নির্বাহী প্রকৌশলীর সাথে অনেকবার কথা হয়েছে। তার কাছে এই খাল খননের বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করলে তিনি জানায় খালের টেন্ডার হয়েছে। দ্রুতই ওয়ার্ক অর্ডার দিয়ে কাজ শুরু করা হবে। তাকে বলা হয়েছে যেহেতু সামনে শীত মৌসুম সেসময় খাল খনন করলে মাটি ফেলানোর পর্যাপ্ত জায়গা পাওয়া যাবে। খনন শেষে কৃষক তাদের চাষাবাদও করতে পারবে। যত দ্রুত সম্ভব কাজটা শুরু করার জন্য তখন নির্বাহী প্রকৌশলীকে অনরোধ করে বলি যেহেতু আমার নির্বাচনী এলাকা ও আমার নিজের গ্রাম সেহেতু কাজ শুরু করার আগে অবগত যেন তাকে অবহিত করা হয়। যাতে কাজটি করতে তাদের সাহায্য করা যায়। কিন্তু ওয়ার্ক অর্ডার হওয়া ও চলতি মাসের প্রথম দিকে কাজ শুরু করেও আমাকে জানানো হয়নি। পরে খোজ নিয়ে জানতে পারলাম ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ওয়ার্ক অর্ডার হয়েছে। সেপ্টেম্বরে কাজ শুরু হওয়ার কথা কিন্তু সেই কাজ কেন ৫ মাস পরে ধানী জমি নষ্ট করে শুরু হলো। আমি কৃষকদের এই ব্যাপক ক্ষতির জন্য ঠিকাদার নয় নির্বাহী প্রকৌশলীকেই দায়ী করবো। কাজ শুরুর অনুমতি যখন দেওয়া হলো তখন খনন শুরু করলে কৃষকদের এই ক্ষতি হতোনা। আমি মনে করি তিনি আমার জনগনের সাথে প্রতারনা করেছেন এবং এটি তিনি ইচ্ছাকৃতভাবে করেছেন।
গোপালগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডর নির্বাহী প্রকৌশলী এস. এম. রেফাত জামিল বলেন, দেড় কিলোমিটার দৈর্ঘ্য ও ২০ ফুট প্রসস্তের খাগাইল খালটির পুনঃ খনন কাজের ওয়ার্ক অর্ডার ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বর মাসে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু সেসময় খালে পানি থাকায় খাল খনন করা সম্ভব হয়নি। ডিসেম্বর মাসের শেষ দিকে পানি শুকিয়ে যাওয়ায় জানুয়ারী মাসে কাজ শুরু করা হয়। চলতি বছরের জুন মাসে খনন কাজের মেয়াদ শেষ হবে। কৃষকদের সেচের সুবিধার জন্য এই খাল খননের ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। তাদের বোঝানোর চেষ্টা করেছি আমরা খান খননে উভচর স্কেভেটর দিয়ে করছি যাতে খালের দুইপাড় থেকে তারা কম ক্ষতিগ্রস্থ হবে এবং যে মাটিটা উঠবে সেটি খালের দুইপাড়ে রাখবো। সেই মাটিটা ভবিষ্যতে তারা তাদের জমিতে ব্যবহার করতে পারবে। এটি পলি সম্বলিত মাটি এটি জমির উর্বরতা বাড়াবে। স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের সাথে আলাপ আলোচনার পরে তারা কিছুটা আস্বস্ত হয়েছে এবং কাজটি চলমান রয়েছে। আমরা মাঠ পর্যায়ে কাজটি বাস্তবায়নের পূর্বে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি যিনি আছেন তাকে আমরা জানিয়েছি যে গোপালগঞ্জে একটা শুকনো মৌসুমেই কাজ করা যায়। এই জমিগুলো এক ফসলী এবং ফসল যখন জমিতে সেই মুহূর্তেই কাজটা হবে। এ কারণে কৃষকরা কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে এ বিষয়ে আগেই আমরা সংশ্লিষ্ট ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান কে জানিয়েছিলাম। তারপরও মাঠ পর্যায়ে কৃষকদের ক্ষতি কিছুটা হচ্ছে। কিন্তু আমাদের ডিজাইন, এস্টিমেট এখানে কোথাও ক্ষতিপূরণ দেওয়ার সুযোগ নেই। তাই আমরা কৃষকদের কোন ক্ষতিপূরণ দেয়ার ব্যবস্থা নিতে পারব না। ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে তাদের জমিতে সেচের জন্য এতটুকু ক্ষতি মেনে নিতে কৃষকদের অনুরোধ করছি। #