অর্থনীতি

১৭ প্রতিষ্ঠানসহ সালমান পরিবারের নথি তলবে ৭০ সংস্থায় চিঠি

সাবেক প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ বিষয়ক উপদেষ্টা ও বেক্সিমকো গ্রুপের চেয়ারম্যান সালমান এফ রহমান এবং তার পরিবারের অন্য সদস্যদের মালিকানাধীন ১৭ প্রতিষ্ঠানের ঋণসহ সংশ্লিষ্ট নথিপত্র তলব করে চিঠি দেওয়া হয়েছে।

তার বিরুদ্ধে প্রায় ৩৬ হাজার কোটি টাকা ঋণ গ্রহণপূর্বক আত্মসাতসহ হাজার হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচারের অভিযোগ রয়েছে।

মঙ্গলবার (২২ অক্টোবর) দুদকের প্রধান কার্যালয় থেকে দুদক উপ-পরিচালক ও অনুসন্ধান টিম প্রধান মো. মনজুর আলম ওই তলবি চিঠি দিয়েছেন বলে জানা গেছে। চিঠিতে ৬৩টি সরকারি-বেসরকারি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান, রাজউক, গণপূর্ত ও রেজিস্ট্রারসহ বিভিন্ন দপ্তরে পৃথক পৃথক চিঠিতে নথিপত্র তলব করা হয়েছে। যা আগামী চার কর্মদিবসের মধ্যে পাঠানোর অনুরোধ করা হয়েছে চিঠিতে।

চিঠিতে বলা হয়েছে, প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ বিষয়ক উপদেষ্টা ও চেয়ারম্যান সালমান এফ রহমান, তার ছেলে সৈয়দা রুবাবা রহমান ও আহমেদ শায়ান ফজলুর রহমানের ব্যক্তিগত নথিপত্র এবং বেক্সিমকো ও এর সহযোগী ১৭ প্রতিষ্ঠান অ্যাডভেঞ্চার গার্মেন্টস লিমিটেড, অ্যাপোলো অ্যাপারেলস লিমিটেড, অটাম লুপ অ্যাপারেলস লিমিটেড, বেক্সটেক্স গার্মেন্টস লিমিটেড, কসমোপলিটান অ্যাপারেলস লিমিটেড, কোজি অ্যাপারেলস লিমিটেড, এসেস ফ্যাশন লিমিটেড, ইন্টারন্যাশনাল নিটওয়্যার অ্যান্ড অ্যাপারেলস লিমিটেড, কাঁচপুর অ্যাপারেলস লিমিটেড, মিডওয়েস্ট গার্মেন্টেস লিমিটেড, পিয়ারলেস গার্মেন্টস লিমিটেড, পিঙ্ক মেকার গার্মেন্টস লিমিটেড, প্ল্যাটিনাম গার্মেন্টস লিমিটেড, স্কাইলেট অ্যাপারেলস লিমিটেড, স্প্রিংফুল অ্যাপারেলস লিমিটেড, আরবান ফ্যাশন লিমিটেড ও উইন্টার স্প্রিন্ট গার্মেন্টস লিমিটেডের নিজ ও যৌথ নামে ব্যাংক হিসাব, সঞ্চয়পত্র, ডিপিএস, ঋণ ক্রেডিট কার্ড ইত্যাদি নথিপত্র পাঠাতে হবে।

এ ছাড়া প্রতিষ্ঠানের ব্যাংক হিসাব খোলার ফর্ম, কেওয়াইসি ফর্ম, টিপি এবং হিসাব খোলার পর থেকে ৩১ অক্টোবর পর্যন্ত হিসাব বিবরণী, ঋণ হিসাব সংক্রান্ত বিস্তারিত তথ্য চাওয়া হয়েছে তলবি চিঠিতে।

এর আগে সালমান এফ রহমান ও তার পরিবারের অন্য সদস্যদের মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানগুলোর ঋণ সংক্রান্ত যাবতীয় নথিপত্র তলব করে গত ২৩ সেপ্টেম্বর ৮ ব্যাংককে চিঠি দেওয়া হয়েছিল। যার কিছু নথিপত্র দুদকে এসেছে বলে জানা গেছে।

ব্যাংকিং খাতে নানা অনিয়ম, দুর্নীতি আর লুটপাটের অভিযোগে বেক্সিমকো গ্রুপের কর্ণধার সালমান এফ রহমানের বিরুদ্ধে গত ২২ আগস্ট অনুসন্ধান শুরুর সিদ্ধান্ত নেয় দুদক। অভিযোগ রয়েছে, সাবেক প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ বিষয়ক উপদেষ্টা ও বেক্সিমকো গ্রুপের চেয়ারম্যান সালমান এফ রহমান ও অন্যদের বিরুদ্ধে শেয়ারবাজারে জালিয়াতি, প্লেসমেন্ট শেয়ার কারসাজি ও প্রতারণার মাধ্যমে শেয়ারহোল্ডারদের হাজার হাজার কোটি টাকা লোপাট, অবৈধ প্রভাব খাটিয়ে দেশের সরকারি ও বেসরকারি বিভিন্ন ব্যাংক থেকে প্রায় ৩৬ হাজার কোটি টাকা ঋণ গ্রহণপূর্বক আত্মসাতসহ হাজার হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচারের অভিযোগ রয়েছে।

অভিযোগ সূত্রে জানা যায়, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ বিষয়ক উপদেষ্টা ছিলেন সালমান এফ রহমান। দরবেশ খ্যাত এই ব্যক্তির নামে গত ১৫ বছরে আর্থিক খাতে নজিরবিহীন দুর্নীতি, লুটপাট, জালিয়াতি ও টাকা পাচারের অভিযোগ রয়েছে। ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে ফেরত না দেওয়ার পাশাপাশি পণ্য রপ্তানি করে দেশে টাকা না আনার অভিযোগও রয়েছে তার মালিকানাধীন বেক্সিমকো গ্রুপের বিরুদ্ধে। এভাবে নানা অনিয়ম করে হাজার হাজার কোটি টাকা আয় করেছেন সালমান এফ রহমান। তিনি কত টাকার মালিক তার প্রকৃত হিসাব কারো কাছে নেই। ২০০৬-২০০৭ সালে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে ঋণখেলাপিসহ নানা অভিযোগে জেলে গিয়েছিলেন সালমান এফ রহমান। এরপর জেল থেকে বের হয়ে নাম জড়ান ২০১০-১১ সালের শেয়ার বাজার কেলেঙ্কারিতে। এত কিছুর পরও তাকে স্পর্শ করার সাহস হয়নি কারও। ব্যাংক থেকে নামে-বেনামে প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে তার প্রতিষ্ঠান। এর মধ্যে একটি ব্যাংক থেকেই নেওয়া হয়েছে ২২ হাজার কোটি টাকা। পণ্য রপ্তানি করে সেই অর্থ দেশে না আনার অভিযোগও রয়েছে তার প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে।

অভিযোগ রয়েছে, গত ৩১ বছরে শেয়ারবাজারের প্রত্যেকটি বড় কেলেঙ্কারিতে সালমান এফ রহমান জড়িত। গত ৩ বছরে তিনি দৃশ্যমানভাবেই বাজার থেকে নিয়েছেন ৬ হাজার ৬০০ কোটি টাকা। আর অদৃশ্যভাবে হাতিয়ে নিয়েছেন ২০ হাজার কোটি টাকা। ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর বেপরোয়া হয়ে ওঠেন সালমান এফ রহমান। শিল্প প্রতিষ্ঠানের মালিক, ব্যবসায়ী নেতার পর ২০১৮ সালে এমপি ও টানা দুইবার প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা হন তিনি। হাজারো ব্যবসায়ীকে পথে বসানো শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারির এক অবিচ্ছেদ্য নাম সালমান এফ রহমান।

২০১০-১১ সালে শেয়ারবাজার ধসের পর এ বিষয়ে একটি তদন্ত কমিটি করা হয়েছিল। কমিটির প্রধান ছিলেন খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ। সেই রিপোর্টে পুঁজিবাজারে ফিক্সড প্রাইস, বুক-বিল্ডিং, রাইট শেয়ার, ডিরেক্ট লিস্টিং, সম্পদ পুনর্মূল্যায়ন, প্রেফারেন্স শেয়ারসহ সব ক্ষেত্রেই অনিয়ম হওয়ার এবং এর সঙ্গে সালমান এফ রহমানের সংশ্লিষ্টতা পাওয়া যায়। তাই খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ সেই রিপোর্টে সালমান এফ রহমান থেকে পুঁজিবাজারকে সতর্ক থাকার পরামর্শ দেন।

এ ছাড়া সালমান এফ রহমান বিভিন্ন কোম্পানির প্রাইভেট প্লেসমেন্টের মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ অর্থ হাতিয়ে নিয়েছেন বলেও প্রমাণ পায় সেই কমিটি। অথচ এসব অনিয়মের সঙ্গে সালমান এফ রহমানসহ আরও কয়েকজনের নামে জড়িত থাকার প্রমাণ পাওয়া গেলেও তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।

২০০৬-০৭ সালের দিকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে দুর্নীতিবিরোধী একটি টাস্কফোর্স করা হয়েছিল। টাস্কফোর্স বিভিন্ন দেশে অনুসন্ধান চালিয়ে তথ্য বের করে, ১২২ জন রাজনৈতিক নেতা ও আমলা দুর্নীতির মাধ্যমে বিভিন্ন দেশে ৪৫ হাজার কোটি টাকা পাচার করেছে। মালয়েশিয়া, কানাডা, সুইজারল্যান্ড, ভারত, চীন, থাইল্যান্ড, দুবাই, অস্ট্রেলিয়া ও সিঙ্গাপুরসহ মোট ১৭টি দেশে এসব অর্থ পাচার করা হয়েছে। পাচার হওয়া ৪৫ হাজার কোটি টাকার মধ্যে এক হাজার কোটি টাকা সালমান এফ রহমানের। আমেরিকায় রিয়েল এস্টেট ব্যবসার নামে এসব টাকা পাচার করা হয়েছিল।

 

 

Show More

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button