বিরাট কোহলির বিশ্ব রেকর্ডের ম্যাচে ওয়ানডে বিশ্বকাপের ফাইনাল নিশ্চিত করলো স্বাগতিক ভারত। বুধবার (১৫ নভেম্বর) টুর্নামেন্টের প্রথম সেমিফাইনালে ভারত ৭০ রানে হারিয়েছে গত দুই আসরের রানার্স-আপ নিউজিল্যান্ডকে। এর মাধ্যমে গত বিশ্বকাপ সেমিফাইনালে নিউজিল্যান্ডের কাছে হারের মধুর প্রতিশোধ নিলো ভারত। হাই স্কোরিং ম্যাচে দলের জয়ে গুরুত্বপুর্ন অবাদন রেখেছেন ৭ উইকেট নেয়া ভারতীয় পেসার মোহাম্মদ সামিও।
এ ম্যাচে ওয়ানডে ক্রিকেট ইতিহাসে সর্বোচ্চ ৫০তম সেঞ্চুরির বিশ্ব রেকর্ড গড়েন কোহলি। এতে ভেঙে যায় তার স্বদেশি শচীন টেন্ডুলকারের ৪৯টি সেঞ্চুরির রেকর্ড। বিশ্ব রেকর্ড গড়া সেঞ্চুরির ইনিংসে ১১৭ রান করেন কোহলি। শতক হাঁকিয়ে ১০৫ রান করেন শ্রেয়াস আইয়ার। জোড়া সেঞ্চুরিতে প্রথমে ব্যাট করে ৫০ ওভারে ৪ উইকেটে ৩৯৭ রানের পাহাড় গড়ে ভারত। জবাবে ড্যারিল মিচেলের সেঞ্চুরি সত্বেও পেসার সামির দুর্দান্ত বোলিংয়ে ৩২৭ রানে অলআউট হয় নিউজিল্যান্ড। ১৩৪ রান করেন মিচেল। ৫৭ রানে ৭ উইকেট নিয়ে ম্যাচ সেরা হন সামি।
মুম্বাইয়ের ওয়াংখেড়ে স্টেডিয়ামে টস জিতে প্রথমে ব্যাটিং করতে নামে ভারত। ইনিংসের শুরু থেকেই নিউজিল্যান্ডের বোলারদের উপর চড়াও হন ভারতের দুই ওপেনার অধিনায়ক রোহিত শর্মা ও শুভমান গিল। প্রথম ৮ ওভারে ৭০ রান পায় ভারত।
নবম ওভারের ভারতের উদ্বোধনী ভাঙেন নিউজিল্যান্ড পেসার টিম সাউদি। মিড অফে কিউই অধিনায়ক কেন উইলিয়ামসনকে ক্যাচ দিয়ে ফিরেন ৪টি করে চার-ছক্কায় ২৯ বলে ৪৭ রান করা রোহিত। এই ইনিংস খেলার পথে বিশ্বকাপে সর্বোচ্চ ছক্কার বিশ্ব রেকর্ড গড়েন হিট ম্যান। গিল-রোহিত ৫০ বলে ৭১ রানের জুটি গড়েন।
রোহিত ফেরার পর কোহলিকে নিয়ে রানের চাকা দ্রুত ঘুড়িয়েছেন গিল। ১৩তম ওভারে ছক্কা মেরে ভারতের রান তিন অংকে নেন গিল। পরের ওভারে ওয়ানডেতে ১৩তম হাফ-সেঞ্চুরি পূর্ণ করেন ৪১ বল খেলা গিল।
হাফ-সেঞ্চুরির পর সেঞ্চুরির পথেই ছিলেন তিনি। কিন্তু ২৩তম ওভারে পা’য়ে ক্র্যাম্প সমস্যায় পড়ে আহত অবসর নিয়ে মাঠ ছাড়েন গিল। এ সময় ৮টি চার ও ৩টি ছক্কায় ৬৫ বলে ৭৯ রানে অপরাজিত ছিলেন গিল। কোহলির সাথে দ্বিতীয় উইকেটে ৮৬ বলে অবিচ্ছিন্ন ৯৩ রান যোগ করেন এই ডান-হাতি ব্যাটার।
দলীয় ১৬৪ রানে গিলের বিদায়ে উইকেটে আসেন শ্রেয়াস আইয়ার। ২৭তম ওভারে ওয়ানডে ক্যারিয়ারের ৭২তম ও নক আউট ম্যাচে প্রথম অর্ধশতকের দেখা পান কোহলি।
২৯তম ওভারে ভারতের রান ২শতে নেন কোহলি-আইয়ার। ৩৪তম ওভারে এবারের বিশ্বকাপে ৬৭৪ রান পূর্ণ করেন কোহলি। এ ক্ষেত্রে বিশ্বকাপের এক আসরে সবচেয়ে বেশি রান করা স্বদেশী টেন্ডুলকারের রেকর্ড ভাঙেন কোহলি। ২০০৩ আসরে সর্বোচ্চ ৬৭৩ রান করেছিলেন টেন্ডুলকার।
৩৭তম ওভারে এবারের বিশ^কাপে টানা চতুর্থ ৫০এর বেশির রানের ইনিংস ও ওয়ানডেতে ১৮তম অর্ধশতকের দেখা পান আইয়ার। ভারতের পঞ্চম ব্যাটার হিসেবে এই নজির গড়লেন তিনি।
৪২তম ওভারের চতুর্থ বলে ওয়ানডেতে সর্বোচ্চ সেঞ্চুরির বিশ্ব রেকর্ড গড়েন কোহলি। নিউজিল্যান্ডের পেসার লুকি ফার্গুসনের বলে ব্যাকওয়ার্ড স্কয়ার লেগে ঠেলে দিয়ে ২ রান নিয়ে ওয়ানডেতে ৫০তম সেঞ্চুরির স্বাদ নেন কোহলি। এতে ভেঙে যায় টেন্ডুলকারের বিশ^ রেকর্ড। এতোদিন ওয়ানডেতে ৪৯টি সেঞ্চুরি নিয়ে রেকর্ডের মালিক ছিলেন টেন্ডুলকার।
১০৬ বলে বিশ্ব রেকর্ড গড়া সেঞ্চুরির পর ৪৪তম ওভারে বিদায় নেন কোহলি। সাউদির করা ওভারের শেষ বলে ডেভন কনওয়েকে ক্যাচ দিয়ে সাজ ঘরে ফেরেন ৯টি চার ও ২টি ছক্কায় ১১৩ বলে ১১৭ রান করা কোহলি। আইয়ারের সাথে ১২৮ বলে ১৬৩ রান যোগ করেন কিং কোহলি। নক আউট পর্বে ভারতের পক্ষে এটিই সর্বোচ্চ রানের জুটি।
দলীয় ৩২৭ রানে কোহলি যখন আউট হন তখন ৫৭ বলে ৭৭ রানে দাঁড়িয়ে সেঞ্চুরির স্বপ্ন দেখছিলেন আইয়ার। ৪৮তম ওভারের দ্বিতীয় বলে ওয়ানডেতে পঞ্চম ও টানা দ্বিতীয় ম্যাচে সেঞ্চুরি পূর্ন করেন ৬৭ বল খেলা আইয়ার। ভারতের তৃতীয় ব্যাটার হিসেবে বিশ্বকাপে টানা দ্বিতীয় শতক করলেন এই ডান হাতি ব্যাটার।
৪৯তম ওভারে দলীয় ৩৮১ রানে উইকেট পতনের তালিকায় নাম তুলেন আইয়ার। বোল্টের বলে মিচেলকে ক্যাচ দেন ৪টি চার ও ৮টি ছক্কায় ৭০ বলে ১০৫ রান করা আইয়ার।
কোহলি-আইয়ারের জোড়া সেঞ্চুরির পর পাঁচ নম্বরে নামা লোকেশ রাহুলের ক্যামিও ইনিংসের সুবাদে ৫০ ওভারে ৪ উইকেটে ৩৯৭ রানের পাহাড় গড়ে ভারত। বিশ্বকাপের নক আউটে এবং নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে এটিই ভারতের সর্বোচ্চ দলীয় রান। শেষ ১০ ওভারে ১১০ রান যোগ করে ভারত।
৫টি চার ও ২টি ছক্কায় ২০ বলে অপরাজিত ৩৯ রান করেন রাহুল। ইনিংসের ৫ বল বাকী থাকতে পুনরায় ব্যাটিংয়ে নামেন গিল। ৮টি চার ও ৩টি ছক্কায় ৬৬ বলে ৮০ রানে অপরাজিত থাকেন তিনি।
নিউজিল্যান্ডের সাউদি ১০ ওভারে ১০০ রানে ৩ উইকেট নেন। ৩৯৮ রানের টার্গেটে ব্যাট করতে নেমে বড় ইনিংস খেলতে ব্যর্থ হন নিউজিল্যান্ডের দুই ওপেনার ডেভন কনওয়ে ও রাচিন রবীন্দ্র। অষ্টম ওভারে দলীয় ৩৯ রানের মধ্যে বিদায় নেন তারা। ৩০ রানের উদ্বোধনী জুটির পর ষষ্ঠ ওভারে কনওয়েকে ১৩ রানে থামান ভারতীয় পেসার মোহাম্মদ সামি। অষ্টম ওভাওে ফর্মের তুঙ্গে থাকা রবীন্দ্রকেও ১৩ রানে বিদায় করেন সামি।
শুরুর ধাক্কা কাটিয়ে উঠতে তৃতীয় উইকেটে জুটি গড়ার চেষ্টায় সফল হন অধিনায়ক কেন উইলিয়ামসন ও ড্যারিল মিচেল। উইকেটে দ্রুতই সেট হয়ে রানের গতি বাড়িয়েছেন দু’জনে। ৪৯ বলে ওয়ানডেতে ষষ্ঠ ও বিশ্বকাপে চতুর্থ হাফ-সেঞ্চুরির দেখা পান মিচেল।
মিচেলের পর ৫৮ বলে ওয়ানডেতে ৪৫তম হাফ-সেঞ্চুরি করেন উইলিয়ামসন। জোড়া হাফ-সেঞ্চুরিতে উইকেটে জমে যান উইলিয়ামসন ও মিচেল। ২৯তম ওভারে বুমরাহর বলে সামিকে ক্যাচ দিয়ে ৫২ রানে জীবন পান উইলিয়ামসন। ৩১তম ওভারে নিউজিল্যান্ডের রান ২শ স্পর্শ করে।
৩৩তম ওভারের প্রথম ডেলিভারিতে ওয়ানডেতে ষষ্ঠ সেঞ্চুরি তুলে নেন ৮৫ বল খেলা মিচেল। তার সেঞ্চুরির পরের ডেলিভারিতে ভারতকে আবারো ব্রেক-থ্রু এনে দেন সামি। ৮টি চার ও ১টি ছক্কায় ৭৩ বলে ৬৯ রান করা উইলিয়ামসনকে শিকার করেন সামি। এই শিকারে সপ্তম ও ভারতের প্রথম বোলার হিসেবে বিশ্বকাপে ৫০ উইকেট পূর্ণ করেন সামি। মিচেলের সাথে তৃতীয় উইকেটে ১৪৯ বলে ১৮১ রান যোগ করে নিউজিল্যান্ডকে লড়াইয়ে রাখেন উইলিয়ামসন। একই ওভারের চতুর্থ বলে নতুন ব্যাটার টম শুন্য রানেই লাথামকে লেগ বিফোর আউট করেন সামি।
২২০ রানে চতুর্থ উইকেট পতনের পরও নিউজিল্যান্ডকে লড়াইয়ে রাখেন মিচেল ও গ্লেন ফিলিপস। এই জুটি ভাঙতে মরিয়া হয়ে ওঠে ভারত। ৪৩তম ওভারে ফিলিপসকে শিকার করেন জুটি ভাঙেন বুমরাহ। ৩৩ বলে ৪টি চার ও ২টি ছক্কায় ৪১ রান করেন ফিলিপস। জুটিতে ৬১ বলে ৭৫ রান যোগ করেন মিচেল ও ফিলিপস।
এরপর মার্ক চাপম্যানকে ২ রানে কুলদীপ এবং মিচেলকে ১৩৪ রানে থামিয়ে দেন সামি। মিচেলকে শিকার করে ইনিংসে পঞ্চম উইকেট পুর্ন কওে শততম ম্যাচ খেলতে নামা সামি। ওয়ানডেতে এই নিয়ে পঞ্চম ও এই বিশ্বকাপে তৃতীয়বার ইনিংসে পাঁচ উইকেট নিলেন সামি। ৯টি চার ও ৭টি ছক্কায় ১১৯ বলে ক্যারিয়ার সেরা ১৩৪ রান করেন মিচেল।
মিচেলের আউটের পর ৭ বল বাকী থাকতে ৩২৭ রানে গুটিয়ে যায় নিউজিল্যান্ড। সামি ৯ দশমিক ৫ ওভারে ক্যারিয়ার সেরা ৫৭ রানে ৭ উইকেট নেন। বিশ্বকাপে পঞ্চম ও প্রথম ভারতীয় হিসেবে বিশ্বকাপ ম্যাচে ইনিংসে ৭ উইকেট নিলেন সামি।
আগামী ১৯ নভেম্বর অনুষ্ঠিতব্য ফাইনালে অস্ট্রেলিয়া ও দক্ষিণ আফ্রিকার মধ্যকার দ্বিতীয় সেমিফাইনালের বিজয়ী দলের বিপক্ষে শিরোপা নির্ধারনী ম্যাচ খেলতে নামবে ভারত।