জাতীয়

এখনো মাথায় ৫৬ ছররা গুলি, নষ্ট হয়ে গেছে এক চোখ

সারা শরীরে ১৯০টিরও বেশি ছররা গুলির ক্ষত। এরমধ্যে দুই চোখসহ মাথায় রয়েছে ৫৬টি গুলি। উন্নত অপারেশনের অভাবে গুলিগুলো বের করা যায়নি। ইতোমধ্যে এক চোখের দৃষ্টি শক্তি হারিয়ে আরেক চোখও নষ্ট হওয়ার দ্বারপ্রান্তে। দিনে কিছুটা ভালো থাকলেও রাত নামতেই শুরু হয় তীব্র যন্ত্রণা। যেন একটু বেঁচে থাকার আর্তনাদেই কেটে যায় রাত। ব্যয়বহুল এই চিকিৎসার খরচ চালাতে শেষ সম্বল জমিটুকু বিক্রি করে নিঃস্ব প্রায় পরিবার।

মাদারীপুর পৌর শহরের ৭নং ওয়ার্ডের চর কুকরাইল এলাকার মো. সোহেল বেপারীর একমাত্র ছেলে শুভ বেপারী (২০)। শুভ মাদারীপুর সরকারি কলেজের একাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থী। পরিবারে তার মা-বাবা, বড় এক বোন ও ৭ বছর বয়সী এক ভাগ্নে রয়েছে।

সহপাঠীদের সঙ্গে মাদারীপুর শহরজুড়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার জুলাই আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন শুভ বেপারী। এ সময় পুলিশ নির্বিচারে গুলি ছুড়তে থাকলে ঝাঝড়া হয়ে যায় শুভর চোখ, মাথাসহ পুরো শরীর। পরে গুরুতর আহত অবস্থায় তাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিলেও তাৎক্ষণিক সুচিকিৎসা না পেয়ে বাম চোখের দৃষ্টিশক্তি হারান শুভ। বর্তমানে উন্নত চিকিৎসা ও অর্থাভাবে ডান চোখটিও হারাতে বসেছেন তিনি। পুনরায় দৃষ্টি শক্তি ফিরে পেতে দ্রুত উন্নত চিকিৎসার ব্যবস্থা করার জন্য অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছে দাবি জানিয়েছে শুভর পরিবার।

শুভ বেপারী ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমাদের একটা ছোট মুদি দোকান ছিল। সেই দোকানের আয়ের টাকায় আমাদের সংসারসহ আমার চিকিৎসা খরচ চলতো। কিন্তু দোকানটি সরকারি জায়গায় হওয়ায় সরকারের পক্ষ থেকে সেটা উচ্ছেদ করে দেওয়া হয়েছে। আমাদের একটা জমি ছিল সেটাও ৫ লাখ টাকায় বিক্রি করে আমার চিকিৎসা খরচ চালানো হয়েছে। পরে জুলাই স্মৃতি ফাউন্ডেশন ও সরকারের পক্ষ থেকে কিছু আর্থিক সহযোগিতা করেছিল। সেই টাকাও চিকিৎসার জন্য খরচ হয়ে গেছে। দোকান উচ্ছেদ করে দেওয়ার পর আমার বাবা ও আমি দুজনেই বেকার। কোনো রকম টেনেটুনে সংসার চলছে। এখন চিকিৎসা করাবো কীভাবে।

তিনি আরও বলেন, সরকারিভাবে চিকিৎসার জন্য একটা হাসপাতালে সিফট করেছিল, কিন্তু সেখানেও ভালো চিকিৎসা পাচ্ছি না। শুনেছি, গুরুতর আহতদের জন্য বিদেশে নিয়ে চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হবে। তবে তারও কোনো অগ্রগতি দেখছি না। এদিকে আমাদের মধ্যে চারজনের একটা করে চোখ নষ্ট হয়ে গেছে। এখনো আমাদের জন্য ভালো কোনো চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয় নাই। যত দিন যাচ্ছে আমরা আরও বেশি ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছি। শুধু আর্থিক সহযোগিতা বললে তো হবে না, দ্রুত আমাদের জন্য সুচিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে।

জুলাই যোদ্ধা শুভ বেপারী ঢাকা পোস্টকে আরও বলেন, আমার পুরো শরীরে মোট ১৯০টির বেশি গুলি লেগেছে। শুধু দুই চোখ ও মাথার মধ্যেই রয়েছে ৫৬ থেকে ৫৭টি গুলি। অপারেশন করে শরীরের কিছু গুলি বের করতে পারলেও মাথার মধ্যে থাকা গুলিগুলো বের করতে পারেননি ডাক্তাররা। এজন্য রাতে ঘুমাতে পারি না। মাথার মধ্যে অনেক যন্ত্রণা হয়। চোখে যন্ত্রণা করে। বর্তমানে বাম চোখে কিছু দেখতে পারছি না এবং দ্রুত ভালো চিকিৎসা করাতে না পারলে ডান চোখটাও নষ্ট হয়ে যাবে।

তিনি বলেন, জুলাই আন্দোলনের মাধ্যমে নতুন সরকার ও বিভিন্ন রাজনৈতিক দল যারা সুযোগ পেয়েছে। তাদের কাছে ও বর্তমান সরকারের কাছে দাবি আমার জন্য যেন একটা সুব্যবস্থা করে দেওয়া হয়, যেন আমি আমার পরিবার নিয়ে ভালোভাবে চলতে পারি এবং চিকিৎসা করিয়ে আবার আমি চোখে দেখতে পাই।

আহত শুভ বেপারীর মা লিপি বেগম ঢাকা পোস্টকে বলেন, রাতে ঘুমের ভেতরে অসহ্য যন্ত্রণায় হঠাৎ চিৎকার করে ওঠে ছেলেটা। সন্তানের এমন কষ্ট আমি আর সহ্য করতে পারছি না। আমাদের একটা জায়গা ছিল। সেই শেষ সম্বলটুকু বিক্রি করে ছেলের চিকিৎসা করাইছি। দোকানটাও নাই, ওর বাবাও বেকার। এখন অন্যের জায়গায় বসবাস করতেছি। সরকারের কাছে অনুরোধ আমার ছেলেটার জন্য যেন দ্রুত সুচিকিৎসার ব্যবস্থা করে দেন এবং শুভকে একটা পুনর্বাসন ও ওর বাবাকে একটা কাজের ব্যবস্থা করে দেন। যাতে আমরা ডাল-ভাত খেয়ে বাঁচতে পারি। এর থেকে বেশি কিছু চাই না।

শুভ বেপারীর বাবা মো. সোহেল বেপারী ঢাকা পোস্টকে বলেন, বর্তমানে আমার কোনো কর্মসংস্থান নেই। ছেলেটার দ্রুত ভালো চিকিৎসা করানোর প্রয়োজন। সরকার যেন আমাকে অথবা আমার ছেলেকে কর্মসংস্থান ও পুনর্বাসনসহ আমার ছেলের উন্নত চিকিৎসার ব্যবস্থা করে দেয় এই দাবি জানাই।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন মাদারীপুর জেলা কমিটির যুগ্ম আহ্বায়ক আশিকুল তামিম আশিক ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমাদের অনেক ভাই-বোন জুলাই আন্দোলনে পুলিশের গুলিতে মারাত্মকভাবে আহত হয়েছেন। যাদেরকে এই দেশে চিকিৎসা করিয়ে সুস্থ করা সম্ভব হচ্ছে না, তাদেরকে বিদেশ নিয়ে উন্নত চিকিৎসা করানোর জন্য প্রজেক্ট হাতে নিয়েছে সরকার। ঢাকায় ১৬০০ ফ্লাটের পুনর্বাসনেরও কাজ চলমান রয়েছে। আহতদের এ, বি, সি ৩ ক্যাটাগরিতে ভাগ করে আর্থিক সহায়তা প্রদান করা হচ্ছে। এ ছাড়া প্রতি পরিবারের একজনকে সরকারি-বেসরকারি কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করে দেওয়া হবে। আশা করি, সবকিছুই দ্রুত বাস্তবায়ন করবেন সরকার।

Show More

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button