Top Newsআন্তর্জাতিক

বাংলাদেশি পাসপোর্ট মানেই ‘সন্দেহ’, বন্ধ হচ্ছে ভিসা

মোহনা অনলাইন

বাংলাদেশি পাসপোর্ট এখন আন্তর্জাতিকভাবে ‘রিস্ক পাসপোর্ট’ হিসেবে দেখা হচ্ছে। থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, ভারতসহ একাধিক দেশ ভিসা প্রক্রিয়া কঠোর করছে। কেন এই অনীহা? কীভাবে ফিরিয়ে আনা যাবে বাংলাদেশের পাসপোর্টের মর্যাদা?

একসময় বিশ্ব ভ্রমণের প্রতীক ছিল পাসপোর্টের পাতায় জমে থাকা নানা দেশের ভিসা স্ট্যাম্প। কিন্তু আজ বাংলাদেশের সবুজ মলাটের পাসপোর্ট দেখলেই সন্দেহ জাগে ইমিগ্রেশন কর্মকর্তাদের চোখে। দক্ষিণ এশিয়া থেকে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া—প্রায় প্রতিটি দেশেই বাংলাদেশি নাগরিকদের ভিসা পেতে হচ্ছে অতিরিক্ত যাচাই-বাছাইয়ের মুখোমুখি। এমনকি অন-অ্যারাইভাল সুবিধা থাকা দেশগুলোও বিমানবন্দরেই যাত্রীদের ফিরিয়ে দিচ্ছে।

২০২৪ থেকে ২০২৫ সালের মধ্যে ভারত, কাতার, মিশর, ভিয়েতনাম, দুবাই, বাহরাইন, এমনকি পর্যটননির্ভর থাইল্যান্ড ও শ্রীলঙ্কাও বাংলাদেশিদের ভিসা প্রদানে কড়াকড়ি শুরু করেছে।

থাইল্যান্ড এখন ভিসা দিতে ৪৫ থেকে ৫০ দিন সময় নিচ্ছে; সিঙ্গাপুরের ভিসা রিজেকশন হার বেড়েছে, মালয়েশিয়া বিমানবন্দর থেকেই ফেরত পাঠাচ্ছে শতাধিক যাত্রীকে।

ইমিগ্রেশন রেকর্ড অনুযায়ী,

গত জুলাই ও আগস্ট মাসে মালয়েশিয়ায় প্রবেশের চেষ্টা করা শতাধিক বাংলাদেশিকে ফিরিয়ে দেয়া হয়েছে, কারণ তাদের হোটেল বুকিং বা ভ্রমণ পরিকল্পনা সন্দেহজনক ছিল।

অভিবাসন বিশেষজ্ঞদের মতে,

সংকটের মূল উৎস দেশের অভ্যন্তরে সক্রিয় দালালচক্র। তারা সাধারণ মানুষকে “ট্যুরিস্ট ভিসা”য় কাজের প্রলোভন দেখিয়ে বিদেশে পাঠায়। অনেকে পর্যটক পরিচয়ে মালয়েশিয়া বা সংযুক্ত আরব আমিরাতে প্রবেশ করে আর দেশে ফেরেন না।আবার কেউ কেউ সেখান থেকে লিবিয়া বা ইউরোপের পথে অবৈধভাবে পাড়ি দেন। বাংলাদেশ পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চ সূত্রে জানা গেছে, দালালরা যাত্রীদের “ইমিগ্রেশন এড়ানোর কৌশল” শেখায়—যেমন লাইন থেকে সরে গিয়ে শিফট পরিবর্তনের পর পুনরায় দাঁড়ানো, ভুয়া বুকিং ব্যবহার ইত্যাদি। এই প্রবণতাই বিদেশি কর্তৃপক্ষের চোখে বাংলাদেশি পাসপোর্টকে অবিশ্বস্ত করে তুলেছে।

এছাড়া, কিছু দেশ অভিযোগ করছে যে বাংলাদেশি পর্যটক বা সাধারণ ভিসাধারীরা এই রুট ব্যবহার করে অবৈধভাবে অন্য দেশে পাড়ি জমাচ্ছেন।

চলতি বছরের ১১ জুলাই ৯৬ জন, ১৩ জুলাই ১২৩ জন, ২৬ জুলাই ৮০ জন এবং আগস্ট মাসের এক দিনে সর্বোচ্চ ৯৮ জন বাংলাদেশিকে বিমানবন্দরে আটকে পরবর্তী ফ্লাইটে দেশে ফেরত পাঠানো হয়েছে। মালয়েশিয়ার ইমিগ্রেশন পুলিশের বরাত দিয়ে দেশটির দৈনিক দ্য স্ট্রেইটস টাইম জানিয়েছে, পর্যটন ভিসা নিয়ে মালয়েশিয়ায় প্রবেশের অন্যতম শর্ত হলো বৈধ হোটেল বুকিংয়ের কাগজপত্র সঙ্গে রাখা। ফেরত পাঠানো বাংলাদেশিদের হোটেল বুকিং সন্দেহজনক ছিল; তারা এ বিষয়ে সন্তোষজনক উত্তর দিতে পারছিলেন না। এছাড়া, তাদের সঙ্গে পর্যাপ্ত ভ্রমণকালীন অর্থও ছিল না।

আবার অনেক ক্ষেত্রে পর্যটন ভিসায় আসা যাত্রীরা আত্মীয়ের বাড়িতে থাকার কথা জানালেও আত্মীয়ের আমন্ত্রণপত্র বা ঠিকানা দিতে ব্যর্থ হন। এসব অসঙ্গতির কারণে কর্মকর্তাদের সন্দেহ হয় যে যাত্রী হয়তো অবৈধভাবে কাজ করতে এসেছেন।

অন্যদিকে পর্যটননির্ভর দেশ থাইল্যান্ড প্রতিবেশী ভারতীয়দের ভিসা অন-অ্যারাইভালের সুযোগ দিচ্ছে। অথচ বাংলাদেশিদের কাছ থেকে একগাদা নথিপত্র নিয়েও মাসের পর মাস সময় নিচ্ছে ভিসা দিতে। পাসপোর্টের কপির সঙ্গে আবেদনকারীর ছয় মাসের ব্যাংক স্টেটমেন্ট, সলভেন্সি সার্টিফিকেট, ট্রেড লাইসেন্স, অফিসের অনাপত্তিপত্রসহ ডজনখানেক নথিপত্র জমা নেয় তারা। কাগজে-কলমে ভিসা পেতে সাত থেকে ১০ কার্যদিবস লাগলেও বর্তমানে তা ৪৫ দিনে গিয়ে ঠেকেছে।

ট্যুর অপারেটররা অভিযোগ করছেন, বর্তমানে থাইল্যান্ড ই-ভিসা চালু করেছে। যে কেউ নিজেই নিজের ভিসার জন্য আবেদন করতে পারেন। তবে, বাংলাদেশিদের ক্ষেত্রে দীর্ঘসূত্রিতার অভিযোগ উঠেছে। নতুন পাসপোর্টে ভিসা দেওয়া, না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিতে প্রায় ৪৫-৫০ দিন সময় নিচ্ছে দেশটি। অনেক ক্ষেত্রে এর চেয়েও বেশি সময় নিচ্ছে। দীর্ঘসূত্রিতার কারণে অনেকের ট্যুর ভেস্তে যাচ্ছে।

বাংলাদেশি পাসপোর্টের প্রতি বৈশ্বিক অনীহা কেবল বিদেশি নীতির ফল নয়, এটি দেশের অভ্যন্তরীণ সংকটের প্রতিফলন।আমাদের নাগরিক আচরণ, অভিবাসন শৃঙ্খলা, এবং রাষ্ট্রের কূটনৈতিক সক্ষমতা—সবকিছু মিলেই নির্ধারণ করবে ভবিষ্যতের পথ। যদি বাংলাদেশ নিজ নাগরিকদের সুশৃঙ্খল অভিবাসন ও ইতিবাচক আন্তর্জাতিক ইমেজ গঠনে সফল হয়, তবে সেই সবুজ পাসপোর্ট আবারও হতে পারে আস্থার প্রতীক, সন্দেহের নয়।

Show More

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button