বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি

‘শান্ত’ অক্সিজেন হঠাৎ ‘ছটফটে’! নতুন রূপের সন্ধান

মোহনা অনলাইন

বাতাসে মিশে থাকা আমাদের সকলের চেনা গ্যাসের নাম অক্সিজেন। এর মাধ্যমেই মানুষ-সহ পৃথিবীর সকল প্রাণী নিশ্বাস নেয়। শ্বাসক্রিয়ায় অক্সিজেনের ভূমিকা একে প্রাণীজগতের কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ গ্যাসীয় পদার্থে পরিণত করেছে। তাকে হাতের তালুর মতোই চেনেন বিজ্ঞানীরা। কিন্তু সম্প্রতি সেই চেনা অক্সিজেনের অচেনা আচরণ ধরা পড়েছে। যা নিয়ে কৌতূহল ছড়িয়ে পড়েছে বিজ্ঞানীদের মধ্যে।

পদার্থবিজ্ঞানের তথ্য বলছে, অক্সিজেনের দু’টি পরমাণু দিয়ে একটি অণু গঠিত হয়, যাকে বিজ্ঞানের পরিভাষায় বলে ও২ (O২)। এত দিন এই অক্সিজেনকে হাতের তালুর মতোই চিনতেন বিজ্ঞানীরা। সম্প্রতি, সেই ধারণা অনেকটা বদলে গেছে।

পারিপার্শ্বিকের যাবতীয় অণু এবং পরমাণু নিয়ে বিজ্ঞানীদের চর্চা দীর্ঘ দিনের। অণুকে ভেঙে পরমাণু, পরমাণুকে ভেঙে ইলেকট্রন, প্রোটন, নিউট্রন আবিষ্কার অনেক আগেই হয়ে গিয়েছে। তবে সেগুলো নিয়ে গবেষণা থামেনি।

অক্সিজেনের পরমাণু সম্প্রতি বিজ্ঞানীদের ধারণা পালটে দিয়েছে। অক্সিজেনের এমন একটি আইসোটোপ বা সমস্থানিকের খোঁজ মিলেছে, যা এত দিনের ধারণা ওলটপালট করে দিয়েছে।

আইসোটোপ কী? কোনও পরমাণুর নিউক্লিয়াস গঠিত হয় নিউট্রন এবং সমসংখ্যক প্রোটন, ইলেকট্রন নিয়ে। এই নিউক্লিয়াসকে যদি বাইরে থেকে অধিক গতিসম্পন্ন কোনও কণা দিয়ে আঘাত করা হয়, তখন তৈরি হয় তার আইসোটোপ। আঘাতের ফলে নিউক্লিয়াস থেকে কিছু সংখ্যক নিউট্রন বেরিয়ে যায়। তখন নতুন নিউট্রন সংখ্যা সম্পন্ন ওই পরমাণুরই অন্য একটি রূপ তৈরি হয়। এক একটি রূপকে বলে এক একটি আইসোটোপ।

যে কোনও মৌলের পরমাণুর একাধিক আইসোটোপ থাকে। প্রোটন এবং নিউট্রন সংখ্যার যোগফল দিয়ে সেই আইসোটোপগুলির নামকরণ করা হয়। অক্সিজেনের তেমন একটি নতুন আইসোটোপের নাম অক্সিজেন-২৮।

২, ৮, ২০, ২৮, ৫০, ৮২ এবং ১২৬। পদার্থবিজ্ঞানের ভাষায় এগুলো হল ম্যাজিক সংখ্যা। কোনও পরমাণুকে এই সংখ্যক নিউট্রন থাকলে সেই আইসোটোপগুলি অন্যদের তুলনায় বেশি স্থিতিশীল হয়।

পদার্থবিদ্যার এই ‘প্রামাণ্য সত্য’কে এবার উল্টে দিয়েছে অক্সিজেন। অক্সিজেন-২৮ নামের নতুন আইসোটোপটি বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, এটি স্থিতিশীল নয়।

অক্সিজেনের প্রোটন এবং ইলেকট্রন সংখ্যা হল ৮। সুতরাং, অক্সিজেন-২৮-এ নিউট্রন থাকে ২০টি। এত দিন বিজ্ঞানীদের ধারণা ছিল, ২০টি নিউট্রন বিশিষ্ট অক্সিজেনের আইসোটোপ ‘শান্তশিষ্ট’, স্থিতিশীল।

আগস্ট মাসে নেচার পত্রিকায় প্রকাশিত একটি রিপোর্ট অনুযায়ী, অক্সিজেন-২৮ ‘ছটফটে’, ক্ষণস্থায়ী। সেকেন্ডের অতি ক্ষুদ্র ভগ্নাংশে তা ভেঙে অন্য আইসোটোপে পরিণত হয়ে গেছে।

অক্সিজেন-২৮ ভেঙে তৈরি হয়েছে অক্সিজেন-২৪। চারটি নিউট্রন সেটি থেকে বেরিয়ে গেছে। এতে সময় লেগেছে মাত্র ০.০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০১ সেকেন্ড। অঙ্কের ভাষায় একে বলে জেপটোসেকেন্ড।

অক্সিজেন-২৮-এর এই ‘অস্বাভাবিক’ আচরণে বিস্মিত বিজ্ঞানীরা। এর থেকে প্রমাণিত, নিউক্লিয়াসের গঠন এবং চরিত্র সম্পর্কে এত দিনের ধারণায় কিছু গলদ থেকে গেছে। প্রোটন, নিউট্রনের রয়াসন এখনও বিজ্ঞানীদের চমকে দেওয়ার ক্ষমতা রাখে।

অক্সিজেনের আইসোটোপ নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করে এই নতুন আচরণ আবিষ্কার করেছেন জাপানের এক দল বিজ্ঞানী। টোকিয়ো ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজির পদার্থবিদ ইয়োসুকে কোন্‌ডোর এই গবেষনার নেতৃত্ব দেন।

জাপানের এই বিজ্ঞানী দল প্রথমে ক্যালসিয়াম-৪৮ পরমাণু ভাঙতে বেরিলিয়াম ব্যবহার করেছিল। তা থেকে অপেক্ষাকৃত হালকা কয়েকটি আইসোটোপ তৈরি হয়। তার মধ্যে অন্যতম ছিল ফ্লোরিন-২৯।

এই ফ্লোরিন-২৯ একটি তরল হাইড্রোজেনের দিকে নিক্ষেপ করেন বিজ্ঞানীরা। একটি প্রোটন ছিটকে গিয়ে তৈরি হয় অক্সিজেন-২৮। সেখান থেকেই গবেষণার সূত্রপাত।

অক্সিজেনের অণু, পরমাণু নিয়ে আরও গবেষণা করবেন বিজ্ঞানীরা। অক্সিজেন-২৮-এর ‘ছটফটানি’র কারণ অনুসন্ধান করা হবে। প্রতি ক্ষেত্রেই সেটি এমন আচরণ করে কি না, দেখা হবে সেটিও। গবেষণা সম্পূর্ণ হলে বিজ্ঞানীরা এ বিষয়ে স্থির সিদ্ধান্তে উপনীত হবেন।

প্রাণীরা যে অক্সিজেনের মাধ্যমে শ্বাসকার্য চালায়, তা অবশ্য অক্সিজেন-২৮ নয়। তার নাম অক্সিজেন-১৬। সে ক্ষেত্রে অক্সিজেনের নিউক্লিয়াসে ৮টি প্রোটন এবং ৮টি নিউট্রন থাকে।

Show More

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button