দেশে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে রেকর্ড রোগী হাসপাতালে ভর্তি ও মৃত্যু হয়েছে চলতি বছর। প্রায় প্রতিদিনই বাড়ছে রোগীর সংখ্যা। মৃত্যুর হারও আশঙ্কাজনক। এরই মধ্যে রাজধানীর ২০টি সরকারি ও ৫৭টি বেসরকারি হাসপাতালকে ডেঙ্গু চিকিৎসার জন্য নির্ধারণ করে দিয়েছে সরকার। তবে অর্ধেকের বেশি রোগী চিকিৎসা নিচ্ছে সরকারি হাসপাতালগুলোয়। বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রগুলোয় চিকিৎসা ব্যয় বেশি। ফলে সবচেয়ে বেশি চাপ সামলাতে হাচ্ছে রাজধানীর পাঁচ সরকারি হাসপাতালকে।
সরকারের ডেঙ্গুবিষয়ক তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে গতকাল পর্যন্ত সারা দেশে ১ লাখ ৭৩ হাজার ৭৯৫ ডেঙ্গু রোগী চিকিৎসা নিতে হাসপাতালে ভর্তি হয়। এর মধ্যে ঢাকায় ৭৪ হাজার ৯৭৬ ও ঢাকার বাইরে ভর্তি হয় ৯৮ হাজার ৮১৯ জন। আর রাজধানীর নির্ধারিত ২০ সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছে ৪৩ হাজার ৮৮০ ডেঙ্গু রোগী। এর মধ্যে কেবল পাঁচটি হাসপাতালেই চিকিৎসা নিয়েছে মোট ৩১ হাজার ৯০৪ রোগী, যা ঢাকার সরকারি হাসপাতালে ভর্তি ডেঙ্গু রোগীর ৭৩ শতাংশ। রোগী ভর্তিতে শীর্ষে রয়েছে মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল। সরকারি এ বিশেষায়িত স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানে গতকাল পর্যন্ত ভর্তি হয়েছে ১০ হাজার ৪০৯ ডেঙ্গু রোগী। এছাড়া ঢাকা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে ৫ হাজার ৭৭০, স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ ও মিটফোর্ড হাসপাতালে ৫ হাজার ৯১৮, কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে ৪ হাজার ৪২৯ ও ডিএনসিসি ডেডিকেটেড কভিড-১৯ হাসপাতালে ৫ হাজার ৩৭৬ রোগী ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নিয়েছে।
রাজধানীর ৫৭টি বেসরকারি হাসপাতালে এখন পর্যন্ত ৩১ হাজার ৯৬ ডেঙ্গু রোগী ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নিয়েছে। এর মধ্যে ৭ হাজার ৭৪৫ জন চিকিৎসা নিয়েছে শীর্ষ পাঁচ হাসপাতালে, যা বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নেয়া রোগীর ২৫ শতাংশ। বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ডেঙ্গু রোগীকে চিকিৎসা দিয়েছে হলি ফ্যামিলি রেড ক্রিসেন্ট মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল। এ হাসপাতালে গতকাল পর্যন্ত ১ হাজার ৯৭০ রোগী ভর্তি হয়েছে। এছাড়া ইসলামী ব্যাংক সেন্ট্রাল হাসপাতালের কাকরাইল ও মুগদা শাখায় ১ হাজার ৬৬৮, আজগর আলী হাসপাতালে ১ হাজার ৪৮৮, উত্তরা আধুনিক মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ১ হাজার ৪৫৪ এবং বাংলাদেশ মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে ১ হাজার ১৬৫ ডেঙ্গু রোগী ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নিয়েছে।
নানা সংকট থাকার পরও স্বল্প খরচে চিকিৎসাসেবা মেলায় সরকারি হাসপাতালগুলোয় বেশি রোগী ভর্তি হচ্ছে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। তারা বলছেন, সরকারি হাসপাতালগুলো থেকে রোগী ফেরত দেয়া যায় না; যেভাবেই হোক চিকিৎসা দেয়া হয়। ফলে শয্যার বাইরে কয়েক গুণ বেশি রোগী ভর্তি করা হয়। একই সঙ্গে বেসরকারিতে চিকিৎসা ব্যয় সরকারের নিয়ন্ত্রণে না থাকায় নিম্ন ও মধ্যবিত্ত পরিবারের সদস্যরা চিকিৎসা নিতে যাচ্ছে না। ফলে শয্যা থাকার পরও বেসরকারি হাসপাতালে রোগী কম যাচ্ছে চিকিৎসা নিতে।
রাজধানীতে ডেঙ্গুর চিকিৎসায় শীর্ষ পাঁচ সরকারি হাসপাতালের মধ্যে তিনটি হাসপাতালের পরিচালক জানিয়েছেন, তাদের ওখানে যেসব রোগী আসছে তার বেশির ভাগই কোনো না কোনো বেসরকারি বা সরকারি হাসপাতাল থেকে রেফার হওয়া। কোনো কোনো রোগী এসেছে সংকটাপন্ন অবস্থায়। মানুষের একধরনের আস্থা যে সরকারিতে রোগীকে ফেরত দেয়া হবে না। আর এসব চিকিৎসার ক্ষেত্রে খরচ বড় একটি প্রতিবন্ধক হয়ে কাজ করে। সারা দেশে ডেঙ্গু রোগীর চিকিৎসায় শীর্ষে রয়েছে মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল। এ হাসপাতালের পরিচালক ডা. মো. নিয়াতুজ্জামান বণিক বার্তাকে বলেন, ‘কোনো রোগীকে ফেরত পাঠানোর সুযোগ আমাদের নেই। আমরা যেভাবেই হোক তাদের চিকিৎসা দিই। ৫০০ শয্যার হাসপাতালে বর্তমানে ডেঙ্গু রোগীই রয়েছে আড়াইশর বেশি। ডেঙ্গুসহ অন্যান্য বিভাগ মিলিয়ে দেড়-দুই হাজার রোগী নিয়মিত ভর্তি থাকছে এ হাসপাতালে। তাছাড়া আমাদের হাসপাতালে যেসব রোগী রয়েছে তার অর্ধেক বিভিন্ন হাসপাতাল থেকে সংকটাপন্ন অবস্থায় পাঠানো হয়েছে। দেখা গেছে, বেসরকারি হাসপাতালে দুদিন রেখে তারপর সরকারি হাসপাতালে পাঠানো হয়। রাজধানীর বাইরের বিভিন্ন অঞ্চল থেকেও রোগীরা এ হাসপাতালে আসছে। দেখা যায়, কেউ কেউ আংশিক চিকিৎসা নিয়ে এসেছে।’
ডেঙ্গু আক্রান্ত হওয়ার শুরুতে রোগীরা নিকটস্থ স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানে যাচ্ছে না বলে মন্তব্য করেন স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ ও মিটফোর্ড হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ডা. কাজী মো. রশিদ-উন-নবী। তিনি বলেন, ‘শুরুতে চিকিৎসার আওতায় এলে ডেঙ্গু রোগী সহজেই নিরাময় লাভ করে। আমাদের হাসপাতালের বেশির ভাগ রোগী কোনো না কোনো হাসপাতাল থেকে রেফার হয়ে এসেছে।’
রাজধানীতে ডেঙ্গু রোগীদের ভর্তিতে শীর্ষ অবস্থানে থাকা হলি ফ্যামিলি রেড ক্রিসেন্ট মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. হুমায়ুন কবির বণিক বার্তাকে বলেন, ‘আমরা শুরু থেকেই ডেঙ্গুর চিকিৎসা দিয়ে আসছি। এর জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপও নেয়া হয়েছে। আমাদের হাসপাতালে মোট ভর্তি রোগীর মধ্যে ছয়জনের মৃত্যু হয়েছে। মৃত্যুহারও কম। একই সঙ্গে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের একটি ব্লাড ব্যাংক রয়েছে। ফলে জরুরি প্রয়োজনে রোগীর স্বজনদের কোথাও ছোটাছুটি করতে হয় না। অন্যান্য বেসরকারি হাসপাতালের চেয়েও অনেক কম খরচে চিকিৎসাসেবা দিই আমরা।’
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানিয়েছে, গতকাল পর্যন্ত সারা দেশে হাসপাতালগুলোয় ভর্তি রোগীদের মধ্যে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছে ১ লাখ ৬২ হাজার ৮৪৭ জন। এর মধ্যে ঢাকায় ৭০ হাজার ৫৮৪ ও ঢাকার বাইরের ৯২ হাজার ২৬৩ জন। চলতি বছর ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে এ পর্যন্ত ৮৪৬ জনের মৃত্যু হয়েছে। গতকাল সর্বশেষ আরো ৩ হাজার ২৭ ডেঙ্গু রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে, মারা গেছে সাতজন। বর্তমানে দেশের বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে মোট ১০ হাজার ১০২ ডেঙ্গু রোগী চিকিৎসাধীন।