ওয়ানডে ক্রিকেটের বর্তমান চ্যাম্পিয়ন ইংল্যান্ডকে হারিয়ে বিশ্বকাপের ১৩তম আসরে অঘটনের জন্ম দিলো যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশ আফগানিস্তান।
চলমান ওয়ানডে বিশ্বকাপে আজ নিজেদের তৃতীয় ম্যাচে ইংল্যান্ডকে ৬৯ রানে হারিয়েছে আফগানরা। ওয়ানডে ক্রিকেটে তিনবারের দেখায় ইংল্যান্ডের বিপক্ষে প্রথম জয়ের দেখা পেল আফগানরা। ২০১৫ সাল থেকে বিশ্বকাপের মঞ্চে টানা ১৪ ম্যাচ হারের পর অবশেষে জয়ের স্বাদ পেলো আফগানিস্তান। এছাড়া বিশ্বকাপ ইতিহাসে নিজেদের দ্বিতীয় জয় পেয়েছে আফগানিস্তান। এর আগে ২০১৫ সালে নিজেদের প্রথম বিশ্বকাপে গ্রুপ পর্বে স্কটল্যান্ডকে ১ উইকেটে হারিয়ে জয়ের সূচনা করেছিলো আফগানরা।
রহমানউল্লাহ গুরবাজ-ইকরাম আলিখিলের জোড়া হাফ-সেঞ্চুরিতে প্রথমে ব্যাট করে ৪৯ দশমিক ৫ ওভারে সব উইকেট হারিয়ে ২৮৪ রান করে আফগানিস্তান। গুরবাজ ৮০ ও আলিখিল ৫৮ রান করেন। জবাবে আফগানিস্তানের স্পিন বিষে ৫৭ বল বাকী থাকতে ২১৫ রানে অলআউট হয় ইংল্যান্ড। আফগানদের তিন স্পিনার মুজিব উর রহমান-রশিদ খান ৩টি করে এবং মোহাম্মদ নবি ২টি উইকেট নেন। বাংলাদেশ ও ভারতের কাছে হারের পর এবারের আসরে প্রথম জয় পেল আফগানিস্তান। নিউজিল্যান্ডের কাছে হারের পর বাংলাদেশকে উড়িয়ে প্রথম জয় পেয়েছিলো ইংল্যান্ড। এতে ৩ ম্যাচ শেষে সমান ২ পয়েন্ট করে আছে ইংল্যান্ড ও আফগানিস্তানের।
নয়া দিল্লিতে টস জিতে প্রথমে আফগানিস্তানকে ব্যাটিংয়ে পাঠায় ইংল্যান্ড। ইব্রাহিম জাদরানকে নিয়ে দুর্দান্ত সূচনা করেন রহমানউল্লাহ গুরবাজ। পাওয়ার প্লেতে বিশ্বকাপ ইতিহাসে নিজেদের সর্বোচ্চ ৭৯ রান তোলেন আফগানিস্তানের দুই ব্যাটার।
১১তম ওভারে ওয়ানডেতে তৃতীয় হাফ-সেঞ্চুরি পূর্ণ করেন গুরবাজ। এজন্য ৩৩ বল খেলেন তিনি। বিশ্বকাপে আফগানদের তৃতীয় ওপেনার হিসেবে অর্ধশতক করলেন গুরবাজ।
১৭তম ওভারে জাদরানকে ২৮ রানে থামিয়ে আফগানিস্তানের উদ্বোধনী জুটি ভাঙ্গেন স্পিনার আদিল রশিদ। ১০১ বলে বিশ্বকাপে আফগানিস্তানের তৃতীয় সর্বোচ্চ ১১৪ রানের জুটি গড়েন গুরবাজ-জাদরান।
প্রথম উইকেট পতনের পর ৮ রানের ব্যবধানে আরও দুই ব্যাটারকে হারায় আফগানিস্তান। ১৯তম ওভারে তিন নম্বরে নামা রহমত শাহকে ৩ রানে নিজের দ্বিতীয় শিকার বানান রশিদ। একই ওভারে রান আউট হন গুরবাজ। ক্যারিয়ারের ষষ্ঠ সেঞ্চুরির সম্ভাবনা জাগিয়ে ৮টি চার ও ৪টি ছক্কায় ৮০ রানে রান আউটের শিকার হয়ে থামেন গুরবাজ। বিশ^কাপে আফগানিস্তানের ওপেনার হিসেবে এটি সর্বোচ্চ ব্যক্তিগত রান।
১১৪ রানের শুরুর পর ১২২ রানে তৃতীয় উইকেট হারিয়ে চাপে পড়ে আফগানিস্তান। এ অবস্থায় মিডল অর্ডার ব্যাটাররা বড় জুটির চেষ্টা করেও সফল হননি। এতে ১৯০ রানে ষষ্ঠ উইকেট পতন হয় তাদের। আজমতুল্লাহ ওমারজাই ১৯, অধিনায়ক হাসমতুল্লাহ শাহিদি ১৪ ও মোহাম্মদ নবি ৯ রানে আউট হন। অকশেনাল স্পিনার হিসেবে আগের ম্যাচের ভারতের বিপক্ষে ৮০ রান করা শাহিদিকে বোল্ড করেন জো রুট।
এরপর সপ্তম উইকেটে রশিদ খানকে নিয়ে ৪৮ বলে ৪৩ এবং অষ্টম উইকেটে মুজিব উর রহমানের সাথে ২৫ বলে ঝড়ো ৪৪ রান যোগ করেন ছয় নম্বরে নামা ইকরাম আলিখিল। এই দুই জুটির কল্যাণে ৪৯ দশমিক ৫ ওভারে সব উইকেট হারিয়ে ২৮৪ রানের চ্যালেঞ্জিং সংগ্রহ পায় আফগানিস্তান। ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ওয়ানডেতে এটিই আফগানিস্তানের সর্বোচ্চ দলীয় রান। নিজেদের বিশ্বকাপ ইতিহাসে এটি দ্বিতীয় সর্বোচ্চ দলীয় রানও আফগানদের। গত বিশ্বকাপে লিডসে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে ২৮৮ রান, এখন অবধি বিশ্ব মঞ্চে আফগানিস্তানের সর্বোচ্চ দলীয় স্কোর।
৩টি চারে রশিদ ২২ বলে ২৩ রান, ৩টি চার ও ১টি ছক্কায় মুজিব ১৬ বলে ২৮ রান করেন। ওয়ানডে ক্যারিয়ারের তৃতীয় হাফ-সেঞ্চুরির ইনিংসে ৩টি চার ও ২টি ছক্কায় ৬৬ বলে ৫৮ রান করেন আলিখিল। ইংল্যান্ডের রশিদ ৪২ রানে ৩ এবং মার্ক উড ৫০ রানে ২ উইকেট নেন।
২৮৫ রানের টার্গেটে খেলতে নেমে দ্বিতীয় ওভারের প্রথম বলে হোচট খায় ইংল্যান্ড। জনি বেয়ারস্টোকে ২ রানে লেগ বিফোর আউট করেন পেসার ফজলহক ফারুকি। শুরুতেই বেয়ারস্টোকে হারানোর ধাক্কা সামলে জুটি গড়ার চেষ্টা করেন আরেক ওপেনার ডেভিড মালান ও রুট। ধীরে ধীরে বড় হতে যাওয়া জুটিতে ভাঙ্গন ধরান স্পিনার মুজিব। ১১ রান করা রুটকে বোল্ড করেন মুজিব।
রুট ফিরলেও হ্যারি ব্রুককে নিয়ে রানের চাকা সচল করেন মালান। আগের ম্যাচে বাংলাদেশের বিপক্ষে সেঞ্চুরি করা মালানকে ৩২ রানে থামিয়ে আফগানিস্তানকে ব্রেক-থ্রু এনে দেন নবি। এমন অবস্থায় ১৩তম ওভারে ৬৮ রানের মধ্যে টপ অর্ডার ব্যাটারদের হারিয়ে চাপে পড়ে ইংল্যান্ড।
দলীয় রান ১শতে পা দেয়ার আগেই ইংলিশদের উপর চাপ আরও বাড়িয়ে দেন পেসার নাভিন উল হক। দারুন ইন সুইংয়ে ইংল্যান্ডের অধিনায়ক জশ বাটলারের উইকেট উপড়ে ফেলেন নাভিন। ১৮ বলে ৯ রান করে প্যাভিলিয়নের ফেরেন বাটলার।
এরপর ১৩৮ রানের মধ্যে ইংল্যান্ডের ষষ্ঠ উইকেট তুলে নিয়ে ম্যাচের লাগাম নেন রশিদ ও নবি। লিয়াম লিভিংস্টোনকে রশিদ এবং কারানকে শিকার করেন নবি। লিভিংস্টোন ও কারান ১০ রান করে করেন।
সতীর্থদের যাওয়া আসার মাঝে ৪৫ বলে ওয়ানডেতে দ্বিতীয় অধর্শতক করেন ব্রুক। তার হাফ-সেঞ্চুরির পর মুজিবের বলে ৯ রানে আউট হন ক্রিস ওকস। ১৬০ রানে ইংল্যান্ডের সপ্তম উইকেট পড়লেও, ব্রুককে নিয়ে চিন্তায় ছিলো আফগানিস্তান। অবশেষে ৩৫তম ওভারে ব্রুককে শিকার করেন মুজিব। উইকেটের পেছনে ক্যাচ দিয়ে ৬৬ রানে থামেন ব্রুক। ৬১ বল খেলে ৭টি চার ও ১টি ছক্কা মারেন ব্রুক।
১৬৯ রানে অষ্টম ব্যাটার হিসেবে ব্রুক ফেরার পর ইংল্যান্ডের হার সময়ের ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু লোয়ার অর্ডারের শেষ তিন ব্যাটার লড়াই চালিয়ে যান। নবম উইকেটে ২৯ রান তুলে আদিল রশিদ ও উড। দলীয় ১৯৮ রানে ইংল্যান্ডের রশিদকে (২০) শিকার করেন আফগান রশিদ।
শেষ উইকেটে আফগানিস্তানের বোলারদের সামনে প্রতিরোধ গড়ার চেষ্টা করেন উড ও রিচ টপলি। ১৭ রান যোগ করে দলের রান ২শ পার করেন তারা। ৪১তম ওভারের তৃতীয় বলে উডকে ১৮ রানে বোল্ড করে আফগানিস্তানকে ঐতিহাসিক জয়ের স্বাদ দেন রশিদ। ১৫ রানে অপরাজিত থাকেন টপলি। আফগানিস্তানের মুজিব ৫১ রানে ও রশিদ ৩৭ রানে ৩টি করে উইকেট নেন। ২ উইকেট শিকার করেন নবি।
ব্যাট হাতে ১৬ বলে ২৮ রান ও বল হাতে ৫১ রাতে তিন উইকেট নিয়ে ম্যাচ সেরা নির্বাচিত হন আফগানিস্তানের মুজিব।
সংক্ষিপ্ত স্কোর :
আফগানিস্তান : ২৮৪/১০, ৪৯.৫ ওভার (গুরবাজ ৮০, আলিখিল ৫৮, রশিদ ৩/৪২)
ইংল্যান্ড : ২১৫/১০, ৪০.৩ ওভার (ব্রুক ৬৬, মালান ৩২, রশিদ ৩/৩৭)।
ফল : আফগানিস্তান ৬৯ রানে জয়ী।