হার দিয়ে ১৩তম ওয়ানডে বিশ্বকাপ শেষ করলো বাংলাদেশ ক্রিকেট দল। শনিবার (১১ নভেম্বর) লিগ পর্বে নিজেদের নবম ও শেষ ম্যাচে অস্ট্রেলিয়ার কাছে ৮ উইকেটে হেরেছে টাইগাররা। এতে ৯ ম্যাচে ২ জয় ও ৭ হারে ৪ পয়েন্ট নিয়ে টেবিলের অষ্টমস্থানে থাকলো বাংলাদেশ। তারপরও ২০২৫ সালের আইসিসি চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে খেলা নিশ্চিত হয়নি টাইগারদের।
ইংল্যান্ড-পাকিস্তান ও আজ ভারত-নেদারল্যান্ডসের উপর নির্ভর করবে বাংলাদেশের চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির ভাগ্য। পাকিস্তানের বিপক্ষে ইংল্যান্ড জিতলে বা অল্প ব্যবধানে হারলে এবং আজ নেদারল্যান্ডস জিতলে, হৃদয় ভাঙ্গবে বাংলাদেশের। সেমিফাইনালে খেলার লক্ষ্য নিয়ে এবারের বিশ্বকাপে আসা বাংলাদেশের দু’টি জয় এসেছে আফগানিস্তান ও শ্রীলংকার বিপক্ষে।
এ ম্যাচে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে প্রথমে ব্যাট করে ৫০ ওভারে ৮ উইকেটে ৩০৬ রান করে বাংলাদেশ। ৭৯ বলে ৭৪ রান করেন তাওহিদ হৃদয়। জবাবে মিচেল মার্শের অনবদ্য ১৭৭ রানের সুবাদে ৩২ বল বাকী রেখে ৩০৭ রানের টার্গেট স্পর্শ করে অস্ট্রেলিয়া। বিশ্বকাপে নিজেদের সর্বোচ্চ রান তাড়া করে জয়ের রেকর্ড গড়লো অসিরা। এই জয়ে ৯ ম্যাচে ১৪ পয়েন্ট নিয়ে টেবিলের তৃতীয়স্থানে থেকে সেমিফাইনাল খেলবে অস্ট্রেলিয়া। আগামী ১৬ নভেম্বর দ্বিতীয় সেমিতে পয়েন্ট টেবিলে দ্বিতীয়স্থানে থাকা দক্ষিণ আফ্রিকার মুখোমুখি হবে অসিরা। ৯ ম্যাচে ১৪ পয়েন্ট নিয়ে রান রেটে এগিয়ে থেকে টেবিলের দ্বিতীয় স্থানে প্রোটিয়ারা।
পুনেতে টস হেরে প্রথমে ব্যাটিং করতে নামে বাংলাদেশ। ইনজুরি আক্রান্ত নিয়মিত অধিনায়ক সাকিব আল হাসানের পরিবর্তে বাংলাদেশের নেতৃত্ব দেন নাজমুল হোসেন শান্ত।
ব্যাট হাতে নেমে বাংলাদেশকে দারুন সূচনা এনে দেন দুই ওপেনার তানজিদ হাসান ও লিটন দাস। পাওয়ার প্লেতে ৬২ রান তুলেন তারা। এবারের বিশ্বকাপে এই নিয়ে দ্বিতীয় হাফ-সেঞ্চুরির উদ্বোধনী জুটি পেল টাইগাররা। এর আগে এই পুনেতেই ভারতের বিপক্ষে ৯৩ রান তুলেছিলেন তানজিদ ও লিটন।
১২তম ওভারে পেসার সিন অ্যাবটের বাউন্সার সামলাতে না পেরে বোলারকেই ক্যাচ দিয়ে আউট হন ৬টি চারে ৩৪ বলে ৩৬ রান করা তানজিদ। দলীয় ৭৬ রানে তানজিদ ফেরার পর ভারপ্রাপ্ত অধিনায়ক শান্তকে নিয়ে দলের রান ১৬তম ওভারে ১শ পার করেন লিটন। ১৫তম ওভারে স্পিনার এডাম জাম্পার বলে অস্ট্রেলিয়ার প্যাট কামিন্সের হাতে ব্যক্তিগত ৩৪ রানে জীবন পান লিটন। তবে জীবন পেয়ে বেশি দূর যেতে পারেননি তিনি। সেই জাম্পার বলে লং অনে মার্নাস লাবুশেনকে ক্যাচ দিয়ে বিদায় নেন ৫টি চারে ৪৫ বলে ৩৬ রান করা লিটন। শান্ত-লিটন যোগ করেন ৩০ রান।
লিটনের বিদায়ে ক্রিজে শান্তর সঙ্গী হন তাওহিদ হৃদয়। বলের সাথে পাল্লা দিয়ে রান তুলেছেন তারা। উইকেটে সেট হয়ে দলের বড় স্কোরের ভিত গড়তে থাকেন শান্ত ও হৃদয়। হাফ-সেঞ্চুরির কাছে পৌঁছেও যান শান্ত। কিন্তু দুর্ভাগ্য শান্তর। দ্বিতীয় রান নিতে গিয়ে লাবুশেনের দারুন ফিল্ডিংয়ে রান আউট হন তিনি। শান্তর ব্যাট থেকে ৬টি বাউন্ডারিতে ৫৭ বলে ৪৫ রান আসে। তৃতীয় উইকেটে দলকে ৬৬ বলে ৬৩ রান উপহার দেন শান্ত-হৃদয়।
এরপর মাহমুদুল্লাহ রিয়াদ, মুশফিকুর রহিম ও মেহেদি হাসান মিরাজকে নিয়ে বড় জুটির চেষ্টা করেন হৃদয়। কিন্তু কোন জুটিই হাফ-সেঞ্চুরির গন্ডি পার করতে পারেনি। চতুর্থ উইকেটে মাহমুদুল্লাহর সাথে ৪৮ বলে ৪৪ রানের জুটিতে ৩২তম ওভারে ২শ রান পেয়ে যায় বাংলাদেশ। আক্রমনাত্মক মেজাজে থাকা মাহমুদুল্লাহ ৩টি ছক্কাও আদায় করে নেন। কিন্তু আবারও লাবুশেনের দারুণ ফিল্ডিংয়ে শেষ হয় মাহমুদুল্লাহর ২৮ বলে ৩২ রানের জুটিটি। তার ইনিংসে ১টি চার ও ৩টি ছক্কা ছিলো।
পঞ্চম উইকেটে মুশফিকের সাথে ৩৯ বলে ৩৭ রানের জুটি গড়ার পথে ওয়ানডে ক্যারিয়ারের ষষ্ঠ হাফ-সেঞ্চুরির দেখা পান হৃদয়। এই জুটিতে দলের রান আড়াইশ পার করে থামেন মুশি। জাম্পার বলে মিড উইকেটে কামিন্সকে ক্যাচ দেন ১টি ছক্কায় ২৪ বলে ২১ রান করা মুশফিক। এই শিকারে শ্রীলংকার দিলশান মাদুশঙ্কাকে সরিয়ে এই বিশ^কাপে সর্বোচ্চ ২২ উইকেটের মালিক হন জাম্পা। সেই সাথে ব্র্যাড হগকে সরিয়ে এক আসরে অস্ট্রেলিয়ার স্পিনার হিসেবে সর্বোচ্চ উইকেটের মালিক হলেন জাম্পা।
৪৩তম ওভারে দলীয় ২৫১ রানে মুশফিক ফেরার পর বাংলাদেশের রানের চাকা সচল রাখেন হৃদয়। নিজের ইনিংসটাও বড় করছিলেন তিনি। কিন্তু ৪৭তম ওভারে পেসার মার্কাস স্টয়নিসের বলে মিড উইকেটে লাবুশেনকে ক্যাচ দিয়ে ফিরেন ৫টি চার ও ২টি ছক্কায় ৭৯ বলে ৭৪ রান করা হৃদয়।
শেষদিকে মেহেদি হাসান মিরাজের ২০ বলে ৪টি বাউন্ডারিতে ২৯ রানের সুবাদে ৩শ রানের কোটা পার করে বাংলাদেশ। ৫০ ওভারে ৮ উইকেটে ৩০৬ রানের সংগ্রহ পায় টাইগাররা। এবারের বিশ^কাপে প্রথমবারের মত ৩শ রানের কোটা পার করলো বাংলাদেশ। এই নিয়ে পঞ্চমবার বিশ^কাপের মঞ্চে ৩শ রানের দেখা পেল টাইগাররা। বিশ্বকাপে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে এটি দ্বিতীয় সর্বোচ্চ রান বাংলাদেশের। অস্ট্রেলিয়ার পক্ষে অ্যাবট-জাম্পা ২টি করে এবং স্টয়নিস ১টি উইকেট নেন।
অস্ট্রেলিয়াকে ৩০৭ রানের টার্গেট ছুঁড়ে দিয়ে তৃতীয় ওভারেই বাংলাদেশকে সাফল্য এনে দেন পেসার তাসকিন আহমেদ। ১০ রান করা হেডকে বোল্ড করেন তাসকিন।
শুরুর ধাক্কায় ভড়কে না গিয়ে অস্ট্রেলিয়াকে খেলায় ফেরান আরেক ওপেনার ডেভিড ওয়ার্নার ও মিচেল মার্শ। আগ্রাসী ব্যাটিংয়ে ১৫তম ওভারেই দলের রান তিন অংকে নেন তারা। ঐ ওভারেই ১৯তম হাফ-সেঞ্চুরি পুর্ন করেন ৩৬ বল খেলা মার্শ। ১৯তম ওভারে ওয়ানডেতে ৩৩তম অর্ধশতকের দেখা পেতে ৫২ বল খেলেন ওয়ার্নার। এই নিয়ে ১১বার বিশ্বকাপে অন্তত ৫০ রানের ইনিংস খেললেন ওয়ার্নার। এর মাধ্যমে সাবেক সতীর্থ শীর্ষে থাকা রিকি পন্টিংয়ের রেকর্ড স্পর্শ করেন তিনি।
২৩তম ওভারে ওয়ার্নারকে শিকার করে জুটি ভাঙ্গেন পেসার মুস্তাফিজুর রহমান। ৬টি চারে ৬১ বলে ৫৩ রান করেন ওয়ার্নার। দ্বিতীয় উইকেটে ১১৬ বলে ১২০ রান যোগ করেন ওয়ার্নার-মার্শ।
দলীয় ১৩২ রানে ওয়ার্নার ফেরার পর ক্রিজে আসেন স্টিভেন স্মিথ। মার্শকে নিয়ে দলের জয়ের পথ সহজ করেন স্মিথ। ৩১তম ওভারের তৃতীয় বলে ওয়ানডেতে তৃতীয় ও বিশ^কাপে দ্বিতীয় শতক পূর্ণ ৮৭ বল খেলা করেন মার্শ। এবারের বিশ^কাপে এটি অস্ট্রেলিয়ার ব্যাটারদের সপ্তম সেঞ্চুরি। ২০০৭ সালের বিশ^কাপে করা ৬টি সেঞ্চুরির রেকর্ড এবারের আসরে ভাঙ্গলো তারা।
সেঞ্চুরির পরও মারমুখী মেজাজ অব্যাহত রাখেন মার্শ। সেঞ্চুরি থেকে দেড়শ রানে যেতে ৩০ বল খেলেন তিনি। ক্যারিয়ারে প্রথমবারের মত দেড়শ রান স্পর্শ করতে ১১৭ বল খেলেন মার্শ। ৪১তম ওভারে ওয়ানডেতে ৩২তম হাফ-সেঞ্চুরির স্বাদ নেন স্মিথ। এতে অস্ট্রেলিয়ার জয়ের পথ সহজ হয়ে যায়। ৪৪তম ওভারের চতুর্থ বলেই বাউন্ডারি মেরে অস্ট্রেলিয়ার জয় নিশ্চিত করেন স্মিথ। তৃতীয় উইকেটে ১৩৫ বলে অবিচ্ছিন্ন ১৭৫ রান তুলেন মার্শ-স্মিথ।
১৭টি চার ও ৯টি ছক্কায় ১৩২ বলে ১৭৭ রানে অপরাজিত থাকেন ম্যাচ সেরা নির্বাচিত হওয়া মার্শ। ৬৪ বল খেলে ৪টি চার ও ১টি ছক্কায় অনবদ্য ৬৩ রান করেন স্মিথ। বাংলাদেশের তাসকিন ৬১ রানে ও মুস্তাফিজ ৭৬ রানে ১টি করে উইকেট নেন।